বিশেষ সাক্ষাৎকার-দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে by মেহেদী আহমেদ আনসারী
মেহেদী আহমেদ আনসারী ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে একই বিভাগে যোগ দেন। তিনি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শহরের দুর্যোগ নিরসন নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তিনি বুয়েট-জিডপাস (জাপান ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন অ্যান্ড আরবান সেফটি) ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বাংলাদেশ ভূমিকম্প সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব এবং ওয়ার্ল্ড সিসমিক সেফটি ইনিশিয়েটিভের (ডব্লিউএসএসআই) অন্যতম পরিচালক। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটিরও সদস্য।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহসান হাবীব
প্রথম আলো কোনো ভূমিকম্প ছাড়াই ২০০৪ সালে শাঁখারীবাজারের একটি প্রাচীন বাড়ি, ২০০৫ সালে সাভারে পোশাকশিল্প কারখানা, ২০০৬ সালে তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন, আর এ বছর বেগুনবাড়িতে বাড়িধসে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আবার বেশ কিছু আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে। এসব দুর্যোগ নিয়ে জনগণের উদ্বেগ থাকলেও উদ্ধারকাজে পীড়াদায়ক বিলম্ব দেখা গেছে। সমস্যাটা কোথায়?
মেহেদী আহমেদ আনসারী পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো একটি দোতলা বাসার ওপর আরও চারতলা নির্মাণ করা হয়। পাশে নতুন বাসা করতে গিয়ে মাটি কাটা হলে পুরো ভবনটা ভেঙে যায়। ভবনটিতে ৩১ জন লোক ছিল, ১৮ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়, আর একজন পরে মারা যায়। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের নয় দিন লেগেছিল। ২০০৫ সালে সাভারে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটল, তবে খোলা এলাকায়। একটি আটতলা ভবন যথাযথভাবে নির্মাণ না করায় ভেঙে পড়ে। এখানেও উদ্ধারকাজে সাত-আট দিন লাগে। ঢাকা থেকে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন অনেককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
আগুনের বড় ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ২০০৫ সালে কেটিএস গার্মেন্টস এবং এ বছর ঢাকার নিমতলীর ঘটনা। বহুবিধ কারণে উদ্ধারকাজ বা অগ্নিনির্বাপণে দেরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ঘটনাস্থলে দর্শক জমে যাওয়া। এতে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হয়। নিমতলীর ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কাছে হওয়া সত্ত্বেও সরু রাস্তা এবং পানিস্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে। তা ছাড়া, রাস্তায় যানজটের সমস্যা আছে। আমার মনে হয়, এসব বিলম্বের পেছনে পারিপার্শ্বিক কারণই মুখ্য এবং ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় ঘাটতি ছিল না।
প্রথম আলো মানবসৃষ্ট নানা বিপর্যয়, যেমন—আগুন, ভবনধস, শিল্পকারখানার দূষণ, রাসায়নিক-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা রাজধানী ঢাকায় যেভাবে ঘটে চলেছে, তা ভয়াবহ বাস্তবতার ইঙ্গিতবাহী। ঢাকাবাসীকে সব সময় বিপর্যয়ের ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা আসলে কতটা প্রস্তুত?
মেহেদী আহমেদ আনসারী ঢাকা এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে দুর্যোগ রোধে সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। নগর কর্তৃপক্ষের হাতে ডেটাবেজ না থাকায় তাদের পক্ষে কিছু করার সামর্থ্য খুব কম। সিটি করপোরেশনের আর্কাইভিং বলতে কিছু নেই। সিটি করপোরেশন ঢাকাকে ১০টি জোনে ভাগ করেছে। জোনাল অফিস আছে, সংস্থাটি রাজস্ব আদায় করছে। তাই সব জোনের সমস্ত উপাত্ত থাকার কথা। কিন্তু কোনো উপাত্ত পাওয়া যায় না। তাহলে তারা নগরবাসীর নিরাপত্তা কীভাবে দেবে? ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কীভাবে করবে?
অন্যদিকে রাজউকের অবস্থাও ভালো নয়। বিভিন্ন ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানি নানা জায়গায় জমি ভরাট করছে। সর্বশেষ প্রায় দুই যুগ আগে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে ভূমি উন্নয়ন বিষয়ে নতুন গেজেট করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে এবং সেই ছাড়পত্র থাকা সাপেক্ষে রাজউক অনুমোদন দেবে। কিন্তু অনুমোদন ছাড়াই জমি বিক্রি হচ্ছে এবং ভবন উঠে যাচ্ছে।
ঢাকায় দমকল বাহিনীর স্টেশন আছে মাত্র ১৩টি। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটি ব্লকে একটি করে দমকল বাহিনীর স্টেশন থাকে। কিন্তু ঢাকার ৯০টি ওয়ার্ডে যতটি স্টেশন থাকার কথা, তার ধারেকাছেও নেই। আগুন লাগলে তাই দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে পারে না।
প্রথম আলো আমাদের শহরগুলো কতটা নিরাপদ?
মেহেদী আহমেদ আনসারী ঢাকার মূল সমস্যা হলো আগুন, বন্যা, ভূমিকম্প, শিল্পকারখানার দূষণ, রাসায়নিক-সংশ্লিষ্ট সমস্যা। এসবের সঙ্গে আমি সন্ত্রাসবাদকেও যোগ করতে চাই। এটি একটি নতুন মাত্রা, কিন্তু হচ্ছে তো। এসব সমস্যা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়ানো। তবে সব শহরের ঝুঁকি এক রকম নয়। চট্টগ্রাম বা সিলেটের ক্ষেত্রে ভূমিধস একটা বড় সমস্যা। উপকূলীয় শহরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের সমস্যা আছে। শহরের সমস্যা অনেক।
প্রথম আলো শহরগুলোর দুর্যোগ বা দুর্যোগ মোকাবিলার অবস্থাটা কী?
মেহেদী আহমেদ আনসারী বাংলাদেশে একটি স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার (এসওডি) আছে। কোনো দুর্যোগ হলে সরকার কী ভূমিকা নেবে, বিভিন্ন সংস্থার কী ভূমিকা হবে, তা এতে লেখা আছে। খুব কম লোকই এটি সম্পর্কে জানে। ফলে কী করতে হবে, অনেক সময় তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগে কারিগরি দিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কারিগরি দিক থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধ্যয়নের কোনো পাঠ্যক্রম নেই। প্রকৌশলীরা যদি সবকিছু ঠিকমতো দেখেন, তাহলে শহরের রেজিলিয়েন্স বাড়ে। ঢাকার ক্ষেত্রে রেজিলিয়েন্স বাড়ছে না কোনোভাবেই। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব আছে। এসওডিতে কিছু দিকনির্দেশনা আছে। এসওডিকে ডিজিটাল করার জন্য আমরা বারবার চাপ দিচ্ছি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের জন্য বেশ কিছু সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরঞ্জাম কেনার চেয়ে ভবন মজবুতকরণ বা মাটিকে ঠিকভাবে দুরমুশ করা গেলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। তা ছাড়া প্লাবন ভূমিগুলো মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। খাল না থাকলে পানি কোথায় দিয়ে যাবে? এগুলো কাঠামোগত বা প্রকৌশলগত সমাধানের বিষয়। আর অকাঠামোগত সমাধান হচ্ছে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এই কোমল দিকটি নিয়ে এনজিওগুলো কাজ করছে। কিন্তু কারিগরি দিকটিতে আমরা খুবই দুর্বল।
প্রথম আলো প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ঘটলে কার্যকর ও দ্রুত জরুরি প্রতিক্রিয়া দেখানোর সক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে?
মেহেদী আহমেদ আনসারী কোনো ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমাদের সরঞ্জাম আছে। এর ব্যবহারও বেশ সহজ। রাজউকের করণীয় হলো ভবনগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতেই কি না, তা যাচাই করা। কিন্তু এ কাজ করার মতো প্রশিক্ষিত লোকজল রাজউকের নেই। ঢাকায় এখন তিন লাখ ২৬ হাজার ৭০০ (গত বছরের হিসাব) ভবন আছে। রাজউক এখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলতে পারে, সবাইকে আলাদাভাবে এগুলো পরীক্ষা করে রাজউকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের সামর্থ্য বা লোকবল বাড়ানোর দরকার নেই—আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। বাংলাদেশে এটা করার মতো বহু কোম্পানি আছে। তারা এই প্রতিবেদনটা দেবে। যদি পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে এটাকে মজবুতকরণ করা। রাজউক এখনো এই মোডালিটি গ্রহণ করেনি, কিন্তু এই মোডালিটিতে না গিয়ে রাজউকের কোনো উপায় নেই। কারণ, রাজউকের পক্ষে এই তিন লাখ ২৬ হাজার বাড়ি পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ভবনের ফায়ার সেফটি অডিটের কাজ শুরু করেছে। এর সঙ্গে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। আমরা সেসব ভবনের পরীক্ষা করেছি, তাতে প্রায় ৯০ শতাংশ সুউচ্চ ভবনেই ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী আগুন থেকে সুরক্ষার নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।
প্রথম আলো বড় আকারের কোনো দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে সেটা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের কতটুকু?
মেহেদী আহমেদ আনসারী দুর্যোগ মোকাবিলায় শহরের সামর্থ্য দেখতে হবে তিনটি সংস্থা—ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সামর্থ্যের ভিত্তিতে। সিটি করপোরেশন ও রাজউকের বিষয়ে আগেই বলেছি। ফায়ার সার্ভিস বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু তারা কিছু অকারিগরি দিক নিয়ে কাজ করছে—ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের যেটি কোমল দিক, অর্থাৎ স্মোক ডিটেক্টর আছে কি না, সিঁড়ি কতখানি হওয়া উচিত, দুটি সিঁড়ি আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে। এ কাজগুলো অন্যরাও করতে পারবে।
আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়ে আগেই কিছু বলা হয়েছে। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য মাটিকে সবল করা এবং ভবনের কাঠামোকে ঝুঁকিমুক্ত করা প্রয়োজন। সব কটিই হয় মাটি, নয়তো ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মাটিকে যদি আমরা ঠিকমতো দুরমুশ করে তৈরি করি, তাহলে মাটি দাববে না। ভবন উপযুক্ত নিয়মে তৈরি করলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ভাঙার কথা নয়। ভাঙলেও মানুষ বের হওয়ার মতো সময় পাবে। আমাদের ব্যর্থতার শেষ নেই। এগুলো নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। আমাদের কিছু অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তো আছে। যথাযথ নিয়ম মেনে, মান বজায় রেখে ভবনগুলো নির্মাণ করা হলে দুর্যোগের ক্ষতি অনেক কম হবে।
দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অগ্রগতি আছে। ইউএনডিপির সহায়তায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের জিআইএস মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এখন সিটি করপোরেশন, রাজউককে এটাকে প্রতিবছর হালনাগাদ করা এবং দেখভাল করার হাল ধরতে হবে।
প্রথম আলো ভূমিকম্প মোকাবিলায় আশু কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
মেহেদী আহমেদ আনসারী দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ—দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো, ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান ঠিক থাকলে উদ্ধারকাজের নির্দেশনা, কাজ সম্পাদন এবং আহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা দেওয়া সহজ হয়। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার মজবুতীকরণ করা প্রয়োজন। ভবনকে মজবুত করার পাশাপাশি ভেঙে পড়লে কি করতে হবে তার পরিকল্পনা থাকতে হবে। স্থানীয় লোকজনকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সরকার ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অনেক ক্ষেত্রে আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখার অঙ্গীকার করলেও তা মানা হয় না। আবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলেও মানুষকে সচেতন করা হয় না। মহড়া খুব জরুরি। বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা যায় এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। ভূমিধস আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা। ল্যান্ডস্লাইড জোনিং ম্যাপ আমাদের থাকতে হবে। যে জায়গা ভূমিধসের ঝুঁকিতে, সেখানে কোনো মানুষকে বসবাস করতে দেওয়া যাবে না।
প্রথম আলো শহরের দুর্যোগগুলো বহুমাত্রিক। সে অনুযায়ী আমাদের বিদ্যমান দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা কি ততটা বহুমাত্রিক?
মেহেদী আহমেদ আনসারী পরিকল্পনার প্রকৌশলগত, স্থাপত্য ও সামাজিক দিক—সবগুলো একসঙ্গে নিয়ে ভাবতে হবে। যেকোনো নগরকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধান করতে গেলে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের এখানে আমলারা সিদ্ধান্ত নেন, অথবা সরকার প্রকৌশলগত দিক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। বিদেশে সাধারণত পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, সামাজিক বিজ্ঞানী—সবাই মিলে কমিটি গঠন করেন। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাঁদের পরামর্শ নেয়। আমলাদের পক্ষে তো সব সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
তা ছাড়া মহানগরের জন্য একটি মানচিত্রে আগুন, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি তথ্য একসঙ্গে থাকলে আমরা খুব দ্রুত যেকোনো তথ্য পেতে পারব। এ জন্য যদি আমাদের জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (ডিআইএস)-ভিত্তিক একটা বেস ম্যাপ থাকে, তাহলে আমরা এ সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি। ওয়ার্ডভিত্তিক বা মৌজার মানচিত্র থাকলে তার মধ্যে আমাদের বসতির ধরন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিদ্যালয় ও হাসপাতালের অবস্থান, সড়কের সংযোগ, সেতু, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ সবকিছুই রাখা সম্ভব। আলাদা আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে রাজউক ও সিটি করপোরেশন উভয়ই এটি করার চিন্তা করছে। সিটি করপোরেশন, রাজউক এগুলো আলাদাভাবে করার তো কোনো মানে নেই। একটা অভিন্ন প্লাটফর্মে সরকারের এ কাজগুলো করা উচিত। নইলে সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করতে গেলে সমস্যা দেখা দেবে।
প্রথম আলো নগরের সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যাটি কোথায়?
মেহেদী আহমেদ আনসারী প্রধান সমস্যা পরিকল্পনার। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে যুক্ত করা উচিত। তা ছাড়া বর্তমানে ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে একজন আমলাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান সাধারণত থাকে না। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজের সূত্রে যুক্ত না থাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক কখনোই গড়ে ওঠে না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করার জন্য এটা ভালো জায়গা। কিন্তু কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এ সমস্যা দূর করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্যাডার তৈরি করা দরকার। সমন্বয়হীনতা আমাদের আরেকটি গুরুতর সমস্যা। সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কাজের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।
আমাদের দেশে গত ৮০ বছরে কোনো বড় মাপের ভূমিকস্প হয়নি। এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্যাটার্ন অনুযায়ী শিগগিরই বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে পারে। নানা বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করার পাশাপাশি প্রতিটি ভবনের ভূমিকম্প ও আগুনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি নিয়ে রাজউকের কাছে ভবনের মালিক কর্তৃক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করার নীতি গ্রহণ করা উচিত। আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলে ভূমিকম্পের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী আহমেদ আনসারী ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহসান হাবীব
প্রথম আলো কোনো ভূমিকম্প ছাড়াই ২০০৪ সালে শাঁখারীবাজারের একটি প্রাচীন বাড়ি, ২০০৫ সালে সাভারে পোশাকশিল্প কারখানা, ২০০৬ সালে তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন, আর এ বছর বেগুনবাড়িতে বাড়িধসে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আবার বেশ কিছু আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে। এসব দুর্যোগ নিয়ে জনগণের উদ্বেগ থাকলেও উদ্ধারকাজে পীড়াদায়ক বিলম্ব দেখা গেছে। সমস্যাটা কোথায়?
মেহেদী আহমেদ আনসারী পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো একটি দোতলা বাসার ওপর আরও চারতলা নির্মাণ করা হয়। পাশে নতুন বাসা করতে গিয়ে মাটি কাটা হলে পুরো ভবনটা ভেঙে যায়। ভবনটিতে ৩১ জন লোক ছিল, ১৮ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়, আর একজন পরে মারা যায়। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের নয় দিন লেগেছিল। ২০০৫ সালে সাভারে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটল, তবে খোলা এলাকায়। একটি আটতলা ভবন যথাযথভাবে নির্মাণ না করায় ভেঙে পড়ে। এখানেও উদ্ধারকাজে সাত-আট দিন লাগে। ঢাকা থেকে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন অনেককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
আগুনের বড় ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ২০০৫ সালে কেটিএস গার্মেন্টস এবং এ বছর ঢাকার নিমতলীর ঘটনা। বহুবিধ কারণে উদ্ধারকাজ বা অগ্নিনির্বাপণে দেরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ঘটনাস্থলে দর্শক জমে যাওয়া। এতে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হয়। নিমতলীর ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কাছে হওয়া সত্ত্বেও সরু রাস্তা এবং পানিস্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে। তা ছাড়া, রাস্তায় যানজটের সমস্যা আছে। আমার মনে হয়, এসব বিলম্বের পেছনে পারিপার্শ্বিক কারণই মুখ্য এবং ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় ঘাটতি ছিল না।
প্রথম আলো মানবসৃষ্ট নানা বিপর্যয়, যেমন—আগুন, ভবনধস, শিল্পকারখানার দূষণ, রাসায়নিক-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা রাজধানী ঢাকায় যেভাবে ঘটে চলেছে, তা ভয়াবহ বাস্তবতার ইঙ্গিতবাহী। ঢাকাবাসীকে সব সময় বিপর্যয়ের ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা আসলে কতটা প্রস্তুত?
মেহেদী আহমেদ আনসারী ঢাকা এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে দুর্যোগ রোধে সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। নগর কর্তৃপক্ষের হাতে ডেটাবেজ না থাকায় তাদের পক্ষে কিছু করার সামর্থ্য খুব কম। সিটি করপোরেশনের আর্কাইভিং বলতে কিছু নেই। সিটি করপোরেশন ঢাকাকে ১০টি জোনে ভাগ করেছে। জোনাল অফিস আছে, সংস্থাটি রাজস্ব আদায় করছে। তাই সব জোনের সমস্ত উপাত্ত থাকার কথা। কিন্তু কোনো উপাত্ত পাওয়া যায় না। তাহলে তারা নগরবাসীর নিরাপত্তা কীভাবে দেবে? ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কীভাবে করবে?
অন্যদিকে রাজউকের অবস্থাও ভালো নয়। বিভিন্ন ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানি নানা জায়গায় জমি ভরাট করছে। সর্বশেষ প্রায় দুই যুগ আগে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে ভূমি উন্নয়ন বিষয়ে নতুন গেজেট করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে এবং সেই ছাড়পত্র থাকা সাপেক্ষে রাজউক অনুমোদন দেবে। কিন্তু অনুমোদন ছাড়াই জমি বিক্রি হচ্ছে এবং ভবন উঠে যাচ্ছে।
ঢাকায় দমকল বাহিনীর স্টেশন আছে মাত্র ১৩টি। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটি ব্লকে একটি করে দমকল বাহিনীর স্টেশন থাকে। কিন্তু ঢাকার ৯০টি ওয়ার্ডে যতটি স্টেশন থাকার কথা, তার ধারেকাছেও নেই। আগুন লাগলে তাই দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে পারে না।
প্রথম আলো আমাদের শহরগুলো কতটা নিরাপদ?
মেহেদী আহমেদ আনসারী ঢাকার মূল সমস্যা হলো আগুন, বন্যা, ভূমিকম্প, শিল্পকারখানার দূষণ, রাসায়নিক-সংশ্লিষ্ট সমস্যা। এসবের সঙ্গে আমি সন্ত্রাসবাদকেও যোগ করতে চাই। এটি একটি নতুন মাত্রা, কিন্তু হচ্ছে তো। এসব সমস্যা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়ানো। তবে সব শহরের ঝুঁকি এক রকম নয়। চট্টগ্রাম বা সিলেটের ক্ষেত্রে ভূমিধস একটা বড় সমস্যা। উপকূলীয় শহরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের সমস্যা আছে। শহরের সমস্যা অনেক।
প্রথম আলো শহরগুলোর দুর্যোগ বা দুর্যোগ মোকাবিলার অবস্থাটা কী?
মেহেদী আহমেদ আনসারী বাংলাদেশে একটি স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার (এসওডি) আছে। কোনো দুর্যোগ হলে সরকার কী ভূমিকা নেবে, বিভিন্ন সংস্থার কী ভূমিকা হবে, তা এতে লেখা আছে। খুব কম লোকই এটি সম্পর্কে জানে। ফলে কী করতে হবে, অনেক সময় তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগে কারিগরি দিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কারিগরি দিক থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধ্যয়নের কোনো পাঠ্যক্রম নেই। প্রকৌশলীরা যদি সবকিছু ঠিকমতো দেখেন, তাহলে শহরের রেজিলিয়েন্স বাড়ে। ঢাকার ক্ষেত্রে রেজিলিয়েন্স বাড়ছে না কোনোভাবেই। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব আছে। এসওডিতে কিছু দিকনির্দেশনা আছে। এসওডিকে ডিজিটাল করার জন্য আমরা বারবার চাপ দিচ্ছি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের জন্য বেশ কিছু সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরঞ্জাম কেনার চেয়ে ভবন মজবুতকরণ বা মাটিকে ঠিকভাবে দুরমুশ করা গেলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। তা ছাড়া প্লাবন ভূমিগুলো মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। খাল না থাকলে পানি কোথায় দিয়ে যাবে? এগুলো কাঠামোগত বা প্রকৌশলগত সমাধানের বিষয়। আর অকাঠামোগত সমাধান হচ্ছে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এই কোমল দিকটি নিয়ে এনজিওগুলো কাজ করছে। কিন্তু কারিগরি দিকটিতে আমরা খুবই দুর্বল।
প্রথম আলো প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ঘটলে কার্যকর ও দ্রুত জরুরি প্রতিক্রিয়া দেখানোর সক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে?
মেহেদী আহমেদ আনসারী কোনো ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমাদের সরঞ্জাম আছে। এর ব্যবহারও বেশ সহজ। রাজউকের করণীয় হলো ভবনগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতেই কি না, তা যাচাই করা। কিন্তু এ কাজ করার মতো প্রশিক্ষিত লোকজল রাজউকের নেই। ঢাকায় এখন তিন লাখ ২৬ হাজার ৭০০ (গত বছরের হিসাব) ভবন আছে। রাজউক এখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলতে পারে, সবাইকে আলাদাভাবে এগুলো পরীক্ষা করে রাজউকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের সামর্থ্য বা লোকবল বাড়ানোর দরকার নেই—আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। বাংলাদেশে এটা করার মতো বহু কোম্পানি আছে। তারা এই প্রতিবেদনটা দেবে। যদি পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে এটাকে মজবুতকরণ করা। রাজউক এখনো এই মোডালিটি গ্রহণ করেনি, কিন্তু এই মোডালিটিতে না গিয়ে রাজউকের কোনো উপায় নেই। কারণ, রাজউকের পক্ষে এই তিন লাখ ২৬ হাজার বাড়ি পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ভবনের ফায়ার সেফটি অডিটের কাজ শুরু করেছে। এর সঙ্গে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। আমরা সেসব ভবনের পরীক্ষা করেছি, তাতে প্রায় ৯০ শতাংশ সুউচ্চ ভবনেই ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী আগুন থেকে সুরক্ষার নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।
প্রথম আলো বড় আকারের কোনো দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে সেটা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের কতটুকু?
মেহেদী আহমেদ আনসারী দুর্যোগ মোকাবিলায় শহরের সামর্থ্য দেখতে হবে তিনটি সংস্থা—ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সামর্থ্যের ভিত্তিতে। সিটি করপোরেশন ও রাজউকের বিষয়ে আগেই বলেছি। ফায়ার সার্ভিস বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু তারা কিছু অকারিগরি দিক নিয়ে কাজ করছে—ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের যেটি কোমল দিক, অর্থাৎ স্মোক ডিটেক্টর আছে কি না, সিঁড়ি কতখানি হওয়া উচিত, দুটি সিঁড়ি আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে। এ কাজগুলো অন্যরাও করতে পারবে।
আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়ে আগেই কিছু বলা হয়েছে। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য মাটিকে সবল করা এবং ভবনের কাঠামোকে ঝুঁকিমুক্ত করা প্রয়োজন। সব কটিই হয় মাটি, নয়তো ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মাটিকে যদি আমরা ঠিকমতো দুরমুশ করে তৈরি করি, তাহলে মাটি দাববে না। ভবন উপযুক্ত নিয়মে তৈরি করলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ভাঙার কথা নয়। ভাঙলেও মানুষ বের হওয়ার মতো সময় পাবে। আমাদের ব্যর্থতার শেষ নেই। এগুলো নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। আমাদের কিছু অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তো আছে। যথাযথ নিয়ম মেনে, মান বজায় রেখে ভবনগুলো নির্মাণ করা হলে দুর্যোগের ক্ষতি অনেক কম হবে।
দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অগ্রগতি আছে। ইউএনডিপির সহায়তায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের জিআইএস মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এখন সিটি করপোরেশন, রাজউককে এটাকে প্রতিবছর হালনাগাদ করা এবং দেখভাল করার হাল ধরতে হবে।
প্রথম আলো ভূমিকম্প মোকাবিলায় আশু কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
মেহেদী আহমেদ আনসারী দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ—দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো, ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান ঠিক থাকলে উদ্ধারকাজের নির্দেশনা, কাজ সম্পাদন এবং আহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা দেওয়া সহজ হয়। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার মজবুতীকরণ করা প্রয়োজন। ভবনকে মজবুত করার পাশাপাশি ভেঙে পড়লে কি করতে হবে তার পরিকল্পনা থাকতে হবে। স্থানীয় লোকজনকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সরকার ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অনেক ক্ষেত্রে আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখার অঙ্গীকার করলেও তা মানা হয় না। আবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলেও মানুষকে সচেতন করা হয় না। মহড়া খুব জরুরি। বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা যায় এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। ভূমিধস আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা। ল্যান্ডস্লাইড জোনিং ম্যাপ আমাদের থাকতে হবে। যে জায়গা ভূমিধসের ঝুঁকিতে, সেখানে কোনো মানুষকে বসবাস করতে দেওয়া যাবে না।
প্রথম আলো শহরের দুর্যোগগুলো বহুমাত্রিক। সে অনুযায়ী আমাদের বিদ্যমান দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা কি ততটা বহুমাত্রিক?
মেহেদী আহমেদ আনসারী পরিকল্পনার প্রকৌশলগত, স্থাপত্য ও সামাজিক দিক—সবগুলো একসঙ্গে নিয়ে ভাবতে হবে। যেকোনো নগরকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধান করতে গেলে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের এখানে আমলারা সিদ্ধান্ত নেন, অথবা সরকার প্রকৌশলগত দিক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। বিদেশে সাধারণত পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, সামাজিক বিজ্ঞানী—সবাই মিলে কমিটি গঠন করেন। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাঁদের পরামর্শ নেয়। আমলাদের পক্ষে তো সব সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
তা ছাড়া মহানগরের জন্য একটি মানচিত্রে আগুন, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি তথ্য একসঙ্গে থাকলে আমরা খুব দ্রুত যেকোনো তথ্য পেতে পারব। এ জন্য যদি আমাদের জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (ডিআইএস)-ভিত্তিক একটা বেস ম্যাপ থাকে, তাহলে আমরা এ সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি। ওয়ার্ডভিত্তিক বা মৌজার মানচিত্র থাকলে তার মধ্যে আমাদের বসতির ধরন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিদ্যালয় ও হাসপাতালের অবস্থান, সড়কের সংযোগ, সেতু, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ সবকিছুই রাখা সম্ভব। আলাদা আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে রাজউক ও সিটি করপোরেশন উভয়ই এটি করার চিন্তা করছে। সিটি করপোরেশন, রাজউক এগুলো আলাদাভাবে করার তো কোনো মানে নেই। একটা অভিন্ন প্লাটফর্মে সরকারের এ কাজগুলো করা উচিত। নইলে সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করতে গেলে সমস্যা দেখা দেবে।
প্রথম আলো নগরের সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যাটি কোথায়?
মেহেদী আহমেদ আনসারী প্রধান সমস্যা পরিকল্পনার। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে যুক্ত করা উচিত। তা ছাড়া বর্তমানে ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে একজন আমলাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান সাধারণত থাকে না। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজের সূত্রে যুক্ত না থাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক কখনোই গড়ে ওঠে না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করার জন্য এটা ভালো জায়গা। কিন্তু কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এ সমস্যা দূর করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্যাডার তৈরি করা দরকার। সমন্বয়হীনতা আমাদের আরেকটি গুরুতর সমস্যা। সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কাজের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।
আমাদের দেশে গত ৮০ বছরে কোনো বড় মাপের ভূমিকস্প হয়নি। এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্যাটার্ন অনুযায়ী শিগগিরই বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে পারে। নানা বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করার পাশাপাশি প্রতিটি ভবনের ভূমিকম্প ও আগুনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি নিয়ে রাজউকের কাছে ভবনের মালিক কর্তৃক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করার নীতি গ্রহণ করা উচিত। আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলে ভূমিকম্পের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী আহমেদ আনসারী ধন্যবাদ।
No comments