মানুষের মুখ-সব মানুষও মানুষ না! by এম আর আলম

‘জগতে সব মানুষ সমান না, সব মানুষ মানুষও না!’ পথের মাঝে এমন বাণী লেখার উদ্দেশ্য কী? শত প্রশ্ন করেও উত্তর মিলল না। বরং আপন মনেই এঁকে চলেছিলেন তিনি। হাতের লেখা বেশ ভালো, সুন্দর। তবে সেই শিল্পিত লেখা কোনো ক্যানভাস কিংবা বোর্ডে নয়। পিচঢালা কালো পথে চক, ইটের টুকরো, কাঠের কয়লা দিয়ে আঁকিবুকি।


লোকটা পাগল নাকি! এমন প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মেলে না। হতেও পারেন মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা ভবঘুরে। তাতে কী আসে-যায়। বেশ কয়েক দিন ধরে লোকটিকে দেখা যাচ্ছে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে শহীদ স্মৃতি পার্কের পাশে, সময় পেলেই তিনি পিচঢালা পথে আঁকতে বসে যান।
পথটা এগিয়েছে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানার প্রধান গেটের দিকে। ওই পথেই রোমান ক্যাথলিকদের গির্জা, রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কার্যালয়, কারখানা গেট বাজার। বড় ব্যস্ততা ওই সড়কজুড়ে। লোকজনের ভিড়কে তেমন পাত্তা দিতে চান না আঁকিয়ে লোকটি। ঘটনাটি ২ অক্টোবরের।
পথের মাঝে এবার লিখলেন তিনি ‘কে বা এই সমাধান করবে, সব মানুষের ঘরে ঘরে সমস্যার আগুন এখনো জ্বলছে।’
এরপর আঁকলেন ফুল-পাতা, প্রকৃতি, যে দৃশ্য দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় করে। আবার লেখেন, ‘দেখা হলে চলে যান, অযথা ভিড় করবেন না।’
সত্যি সত্যি এ কথা লেখা দেখে চলে যান, যাঁরা দীর্ঘক্ষণ জটলা করছিলেন। তবে কেউ কেউ আঁকিয়ের আঁকিবুকি দেখার জন্য দাঁড়িয়েও থাকেন।
ইট-কয়লার মিশ্রণে এত সুন্দর শিল্পকর্ম হয়, তা সরাসরি না দেখলে বোঝা যাবে না।
তোমার বাড়ি কই গো?
এক বৃদ্ধা প্রশ্ন করেন?
কথাটা ঠিকই শুনলেন আঁকিয়ে লোকটি। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। লিখলেন পিচের রাস্তায় ‘বাড়ি ছিল মোরেলগঞ্জ, বিশাল এক নদীর কূলে, জেলা: বাগেরহাট।’
এখন সৈয়দপুরেই অবস্থান ওই চারণ শিল্পীর। রাতে তিনি শুয়ে থাকেন শহীদ স্মৃতি পার্কের ওই বড় গাছটার নিচে, নয়তো মুর্তজা ইনস্টিটিউটের উঠোনে।
হন্তদন্ত হয়ে এ সময় সেখানে ছুটে এলেন রেলওয়ের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা শহীদুল ইসলাম। তিনি ওই আঁকিয়েকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘ভালোই তো লেখালেখি তোমার, নাম কী, বাবা?’
এবার লিখলেন নাম: রতন।
আর কিছু লিখলেন না।
একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন রতন। চোখ-মুখ বিমর্ষ-মলিন। মাথায় শীতের চাদর। শরীরে গাঢ় বেগুনি রঙের টি-শার্ট। আর পরনে লুঙ্গি। পলিথিন ব্যাগের পুঁটলিতে কেবলই ইট-কয়লার মজুদ। কয়েকটা সাদা ও রঙিন চকও রয়েছে পুঁটলিতে। এসব তাঁর আঁকাআঁকির উপকরণ। শিল্পীরা অনেক মাধ্যমে আঁকেন। রতনের মাধ্যম ইট-কয়লা।
কবে থেকে পথে পথে আঁকেন রতন, তা তিনি জানাতে চান না। এ প্রশ্নের কোনো উত্তরও লেখেন না পথে। অনেক কথার মাঝে একপর্যায়ে আবার লেখা শুরু হলো তাঁর। এবার লিখলেন, ‘খাবার আশায় কত না হোটেলে যাই, সবাই তাড়িয়ে দেয়।’
মর্মার্থ বুঝলেন পথচারীরা। অনেকে ১০-২০ টাকা ছুড়ে দিলেন রতনকে লক্ষ্য করে। এসব টাকা কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করলেন রতন। হয়তো ওই চারণ শিল্পীর কদর করলেন পথচারী সমঝদারেরা ছুড়ে দেওয়া টাকায়। মনে হলো এতেই সন্তুষ্ট রতন। কারণ তাঁর ক্ষুধার্ত শরীর তো খাদ্য চাইতেই পারে। টাকা না হলে তো খাবার জোটে না।
চল্লিশের কোঠায় বয়স হবে রতনের। অনেকের ধারণা, তিনি শিক্ষিত। হয়তো সিডর-আইলায় দক্ষিণের ওই শিল্পীর সংসার উজাড় করেছে। তাই তো পথে নামা। কিন্তু কেন নীরব তিনি? পৃথিবীর মানুষের প্রতি কেনই বা তাঁর এত বিদ্বেষ। কেন তিনি পথের মাঝে লিখলেন, ‘জগতে সব মানুষ সমান না, সব মানুষও মানুষ না!’

No comments

Powered by Blogger.