বাঘা তেঁতল-পুলিশ ও মিডিয়া by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কিরণ বেদি ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্তদের একজন। তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ভারতের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। মানুষের সেবা ও সংস্কারমূলক কাজ করে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, শিল্পা শেঠি ও ক্যাটরিনা কাইফের চেয়ে কম বিখ্যাত নন। খ্যাতি তাঁর রূপের জন্য নয়, কথার জন্যও নয়, কাজের জন্য।
যদি শুধু খেলাধুলা নিয়ে থাকতেন, তাহলে সানিয়া মির্জার মতোই খ্যাতি পেতেন।
১৯৭২ সালে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যে ৭০ জন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র নারী কিরণ বেদি। দিল্লির তিহার কারাগারের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করার সময় মিডিয়া তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন করতে থাকে। কুখ্যাত কয়েদি ও কারাগার সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তাকে তিনি ভুল প্রমাণের জন্য সংস্কারে হাত দেন। তাতে শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আসে। ১৯৯৪ সালে এশিয়ার নোবেল ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কিরণ বেদি ঢাকায় এসেছিলেন কারা সংস্কার বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। চাকরিজীবনে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেই তিনি প্রশংসিত হন। সরকারি দলের কোনো এমপিকে অপরাধের অভিযোগ থেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা তো দূরের কথা, নিয়মবহির্ভূত পার্ক করায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গাড়িকেও আটক করতে দ্বিধা করেননি। তবে তাঁর দেশও দেবদূতদের দেশ নয়। সেখানেও অবিচার, হিংসা বা পেশাগত প্রতিযোগিতা আছে। ২০০৭ সালে যখন তাঁকে ডিঙিয়ে তাঁর দুই বছরের জুনিয়র এক কর্মকর্তাকে দিল্লির পুলিশ কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান। অবসরে গিয়েই কনসালটেন্সি ফার্ম খোলেননি অথবা কোনো এনজিওর ব্যবসা ফেঁদে বসেননি। চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নবজ্যোতি’ নামের একটি সংগঠন, যার কাজ মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসন। ভিশন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন নামেও একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
কিরণ বেদি যখন ঢাকায়, তখন আমাদের মহানগর পুলিশ প্রশাসনে কিছু রদবদল হয়। মহানগর পুলিশ কমিশনারকে পদোন্নতি দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি করা হয়। তাঁর জায়গায় এসেছেন নতুন কমিশনার।
কয়েক বছর ধরে ঢাকার সব পুলিশ কমিশনারই ভারতের স্টার প্লাসের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আপ কা কাচেরি’র উপস্থাপক কিরণ বেদির চেয়ে বেশি খ্যাতিমান। তাঁরা দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ ও ভালো-মন্দ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অব্যাহত বক্তব্য দেন। কারও কারও কথা বলার ভাষা সরকারপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো। গণতান্ত্রিক বাক্স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সংবাদমাধ্যম তাঁদের দিচ্ছে পূর্ণ সহযোগিতা। তা সত্ত্বেও বাংলার সংবাদমাধ্যম বঙ্গীয় পুলিশের মন জয় করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
যুবলীগের নেতা ইব্রাহিম কীভাবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, তা শুধু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। তবে তাঁর পক্ষে পুলিশ কমিশনারই বলে দিলেন, এটা স্রেফ ‘আত্মহত্যা’। আমাদের কুখ্যাত সংবাদমাধ্যমের লোকজন কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না। মৃত্যুটি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। কার গাড়িতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন? কার পিস্তলটিকে খেলনা মনে করে শিশুর মতো নাড়াচাড়া করছিলেন? মৃত্যুর জন্য পিস্তলওয়ালা বিন্দুমাত্র দায়ী নন। পিস্তলের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ নেই। পিস্তলের স্বত্বাধিকারী যে নির্দোষ, তা আল্লাহকে হাজেরনাজের মেনে ঘোষণা করা হলো। মিডিয়া এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল, যা করা উচিত হয়নি।
আমরা রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে ১৮৯ বছর ধরে সংবাদপত্র বের করছি। এই সময়ের মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে প্রশংসা করে ও দোষারোপ করে বহু মানুষ তাঁদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু গত বুধবারই প্রথম একজন পুলিশ কর্মকর্তা রাজনৈতিক দার্শনিকের মতো উপদেশ দিলেন: ‘একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে পুলিশ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ এত দিন পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম দুইযোগে কাজ করায় গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
যে কারও যেকোনো উপদেশ শিরোধার্য। এবং সে উপদেশ বা নির্দেশ যদি আসে কোনো বলবানের মুখ থেকে, তা অমান্য করার সাধ্য কার? কিন্তু শুধু উপদেশ নয়, বিদায়ী কমিশনার আরও বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার সারদা পুলিশ একাডেমিতে গিয়ে নতুন ৭৬৭ জন এসআইয়ের কাছে মিডিয়া সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তাঁরা সবাই নেতিবাচক মতামত দেন। পরে মিডিয়ার ব্যাপারে বোঝানো হলে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়।’
সাকল্যে ৭৬৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে একজনও ছিলেন না, যিনি ক্ষীণ কণ্ঠেও সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে ইতিবাচক একটা কথা বলতে পারেন। বাংলাদেশের উচ্ছল মিডিয়া-জগতের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হয় না। তবে বিদায়ী কমিশনারের কাছে আমরা ঋণী এ জন্য যে তিনি তাঁদের বুঝিয়েছেন, ফলে তাঁদের ‘দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন’ ঘটে থাকতে পারে। মিডিয়া সম্পর্কে পৃথিবীতে বহু জনমত জরিপ হয়েছে, কিন্তু বৃহস্পতিবারের জরিপটিই নির্ভুল। সুতরাং সর্বশ্রেষ্ঠ।
নতুন কমিশনারের মূল্যবান দীর্ঘ বক্তব্যও টেলিভিশনে দেখলাম ও শুনলাম। তাঁর কথা যদি মানা যায়, তাহলে দেশে অপরাধ শুধু নয়; ঢাকার যানজট পর্যন্ত থাকবে না। তিনিও একাকী চুপি চুপি নয়, মন্দ মিডিয়ার লোকজন নিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। সুতরাং মিডিয়ার অধঃপতন হলেও তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
১৯৭২ সালে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যে ৭০ জন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র নারী কিরণ বেদি। দিল্লির তিহার কারাগারের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করার সময় মিডিয়া তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন করতে থাকে। কুখ্যাত কয়েদি ও কারাগার সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তাকে তিনি ভুল প্রমাণের জন্য সংস্কারে হাত দেন। তাতে শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আসে। ১৯৯৪ সালে এশিয়ার নোবেল ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কিরণ বেদি ঢাকায় এসেছিলেন কারা সংস্কার বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। চাকরিজীবনে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেই তিনি প্রশংসিত হন। সরকারি দলের কোনো এমপিকে অপরাধের অভিযোগ থেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা তো দূরের কথা, নিয়মবহির্ভূত পার্ক করায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গাড়িকেও আটক করতে দ্বিধা করেননি। তবে তাঁর দেশও দেবদূতদের দেশ নয়। সেখানেও অবিচার, হিংসা বা পেশাগত প্রতিযোগিতা আছে। ২০০৭ সালে যখন তাঁকে ডিঙিয়ে তাঁর দুই বছরের জুনিয়র এক কর্মকর্তাকে দিল্লির পুলিশ কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান। অবসরে গিয়েই কনসালটেন্সি ফার্ম খোলেননি অথবা কোনো এনজিওর ব্যবসা ফেঁদে বসেননি। চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নবজ্যোতি’ নামের একটি সংগঠন, যার কাজ মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসন। ভিশন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন নামেও একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
কিরণ বেদি যখন ঢাকায়, তখন আমাদের মহানগর পুলিশ প্রশাসনে কিছু রদবদল হয়। মহানগর পুলিশ কমিশনারকে পদোন্নতি দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি করা হয়। তাঁর জায়গায় এসেছেন নতুন কমিশনার।
কয়েক বছর ধরে ঢাকার সব পুলিশ কমিশনারই ভারতের স্টার প্লাসের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আপ কা কাচেরি’র উপস্থাপক কিরণ বেদির চেয়ে বেশি খ্যাতিমান। তাঁরা দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ ও ভালো-মন্দ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অব্যাহত বক্তব্য দেন। কারও কারও কথা বলার ভাষা সরকারপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো। গণতান্ত্রিক বাক্স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সংবাদমাধ্যম তাঁদের দিচ্ছে পূর্ণ সহযোগিতা। তা সত্ত্বেও বাংলার সংবাদমাধ্যম বঙ্গীয় পুলিশের মন জয় করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
যুবলীগের নেতা ইব্রাহিম কীভাবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, তা শুধু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। তবে তাঁর পক্ষে পুলিশ কমিশনারই বলে দিলেন, এটা স্রেফ ‘আত্মহত্যা’। আমাদের কুখ্যাত সংবাদমাধ্যমের লোকজন কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না। মৃত্যুটি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। কার গাড়িতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন? কার পিস্তলটিকে খেলনা মনে করে শিশুর মতো নাড়াচাড়া করছিলেন? মৃত্যুর জন্য পিস্তলওয়ালা বিন্দুমাত্র দায়ী নন। পিস্তলের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ নেই। পিস্তলের স্বত্বাধিকারী যে নির্দোষ, তা আল্লাহকে হাজেরনাজের মেনে ঘোষণা করা হলো। মিডিয়া এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল, যা করা উচিত হয়নি।
আমরা রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে ১৮৯ বছর ধরে সংবাদপত্র বের করছি। এই সময়ের মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে প্রশংসা করে ও দোষারোপ করে বহু মানুষ তাঁদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু গত বুধবারই প্রথম একজন পুলিশ কর্মকর্তা রাজনৈতিক দার্শনিকের মতো উপদেশ দিলেন: ‘একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে পুলিশ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ এত দিন পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম দুইযোগে কাজ করায় গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
যে কারও যেকোনো উপদেশ শিরোধার্য। এবং সে উপদেশ বা নির্দেশ যদি আসে কোনো বলবানের মুখ থেকে, তা অমান্য করার সাধ্য কার? কিন্তু শুধু উপদেশ নয়, বিদায়ী কমিশনার আরও বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার সারদা পুলিশ একাডেমিতে গিয়ে নতুন ৭৬৭ জন এসআইয়ের কাছে মিডিয়া সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তাঁরা সবাই নেতিবাচক মতামত দেন। পরে মিডিয়ার ব্যাপারে বোঝানো হলে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়।’
সাকল্যে ৭৬৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে একজনও ছিলেন না, যিনি ক্ষীণ কণ্ঠেও সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে ইতিবাচক একটা কথা বলতে পারেন। বাংলাদেশের উচ্ছল মিডিয়া-জগতের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হয় না। তবে বিদায়ী কমিশনারের কাছে আমরা ঋণী এ জন্য যে তিনি তাঁদের বুঝিয়েছেন, ফলে তাঁদের ‘দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন’ ঘটে থাকতে পারে। মিডিয়া সম্পর্কে পৃথিবীতে বহু জনমত জরিপ হয়েছে, কিন্তু বৃহস্পতিবারের জরিপটিই নির্ভুল। সুতরাং সর্বশ্রেষ্ঠ।
নতুন কমিশনারের মূল্যবান দীর্ঘ বক্তব্যও টেলিভিশনে দেখলাম ও শুনলাম। তাঁর কথা যদি মানা যায়, তাহলে দেশে অপরাধ শুধু নয়; ঢাকার যানজট পর্যন্ত থাকবে না। তিনিও একাকী চুপি চুপি নয়, মন্দ মিডিয়ার লোকজন নিয়েই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। সুতরাং মিডিয়ার অধঃপতন হলেও তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments