সপ্তাহের হালচাল-রাজনৈতিক সহিংসতা দেশকে কোথায় নিয়ে চলেছে by আব্দুল কাইয়ুম
সকালে পত্রিকা খুলতে ভয় হয়। না জানি কোথায় কয়জন খুন হয়ে গেল। সিরাজগঞ্জের ঘটনা গতকালের পত্রিকায় শিরোনামে এসেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জনসভাস্থলের কাছে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের হকচকিত করে। এটা হয়তো নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু বিএনপি তা মানবে কেন?
তারা এর পেছনেও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করবে। খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সমাবেশ পণ্ড করার চেষ্টা চালিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত মানুষজন ট্রেনে আগুন দিয়েছে। ট্রেনচালক ও গার্ডদের মেরে আহত করেছে। প্রশ্ন ওঠে, রেললাইনের পাশে জনসভার স্থান বেছে নেওয়া কি উচিত হয়েছে? সমাবেশ কেন রেললাইনের পাশে করতে হবে?
৫ অক্টোবর প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি এনামুল হকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলছিলেন, ১১ তারিখ না জানি কী হয়! কেন? কারণ, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। কয়েক দিন আগে ইউনিয়ন বিএনপির একজন নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রেললাইনের পাশে ওই নেতার এলাকায় বিএনপি প্রতিবাদ সভা করতে চেয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগও একই স্থানে সভা ডেকে বিএনপির সভা ভণ্ডুল করে দেয়। এরপর এরই কাছাকাছি স্থানে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ফলে সেই সভা নিয়ে একটা কিছু ঘটে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু সোমবার সকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ শান্ত। কোনো শঙ্কা ছিল না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা ছিল না।
অথচ তারপরও এমন একটা অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গেল। ট্রেনের ধাক্কায় আহত একজন বলেছেন, সমাবেশের মাইকের প্রচণ্ড শব্দের কারণে রেলগাড়ির হুইসেলের শব্দ রেললাইনে অবস্থানরত মানুষ শুনতে পায়নি। ফলে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখতে হবে।
কিন্তু তাও কথা থাকবে। নাটোরে হত্যাকাণ্ডের পর সিরাজগঞ্জের এই ঘটনা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। এটা উদ্বেগজনক। কারণ, রাজনীতি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। কোথায় চলেছে দেশ? বুধবার ৬ অক্টোবর সংসদের শরৎকালীন অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানালেন। কিন্তু এক দিন পরই নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বিএনপির নেতা সানাউল্লাহ নূরকে হত্যা করা হলো। মনে হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই মানুষকে কষ্ট দিতে উন্মুখ হয়ে আছেন। না হলে কেন প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মানুষ মারবে তারা? আর বিএনপির নেতাদের মারলে তারা কি বসে থাকবে? এভাবে নাটোরে হরতাল ডেকে আনা হয়েছে। নাটোরের ঘটনার এক দিন পরই আবার ছাত্রলীগের সহিংসতা। রংপুরে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাল্টাপাল্টি মিছিল। সংঘর্ষের আশঙ্কায় রংপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ। একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলে সংঘর্ষ। পরপর ঘটে চলেছে রাজনৈতিক সহিংসতা। অভিযোগ সরকারদলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে। মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য বিরোধী দলকে আহ্বান জানানো সত্যিই পরিহাসের মতো শোনায়।
কেউ হয়তো বলবেন, সন্ত্রাস শুধু ক্ষমতাসীনেরাই করছে না, বিরোধী দলও করছে। কুমিল্লায় তারা দিনে-দুপুরে মুখে কাপড় বেঁধে তাদেরই দলের লোকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। যুবদলের সম্মেলন রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে ওদেরই সশস্ত্র ক্যাডাররা। মানলাম বিরোধী দলও সন্ত্রাস করছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না কেন? ওদের ছবি উঠেছে পত্রিকায়। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেবে, পুলিশ কিছু বলবে না? সরকারি দলের লোক সন্ত্রাস করলেও পুলিশ কিছু বলে না, বিরোধী দল করলেও ধরে না। তাহলে এই পুলিশের দরকার কী?
এটা পুলিশের দোষ নয়। পুলিশকে কী সংকেত দেওয়া হচ্ছে, সেটাই আসল কথা। সরকারি দলের ক্যাডারদের ধরতে গেলে জাত যায়, তাই উচ্চপর্যায় থেকে আশ্বাসের অপেক্ষায় পুলিশকে থাকতে হয়। আর বিরোধী দল যদি নিজেদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত বাধায়, তাহলেও পুলিশকে সক্রিয় হতে উচ্চমহলের মাথা নাড়ানি লাগবে। কারণ, বিরোধী দলের নাম খারাপ হলে তো সরকারের লাভ।
নাটোরের সহিংস ঘটনার বিষয়ে কথা বলছিলাম ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে। তিনি বললেন, নেত্রীর সদিচ্ছা আছে, কিন্তু দলের মধ্যে কিছু নব্য আওয়ামী লীগার সরকারের সাফল্য নষ্ট করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাটোরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভিডিওচিত্র দেখে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। ঘটনার পরদিন একজন সন্দেহভাজন ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ২৭ আসামির মধ্যে মাত্র একজন গ্রেপ্তার কেন?
এত বড় একটা ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটেছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যেত। প্রধানমন্ত্রী তখন দলীয় সভায় বলতে পারতেন, মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তাহলে অন্তত বোঝা যেত সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিজ দলের লোকজনকেও আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। সেটা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করত। কিন্তু সেটা হয়নি। বস্তুত, এই বিলম্ব ছিল প্রকৃত আসামিদের গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার কৌশলী ব্যবস্থা। মূল আসামিরা সরে পড়েছেন। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে সেটা করা কঠিন। শুধু সদিচ্ছা দিয়েই সুবিচার হয় না।
হয়তো আরও কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হবেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিচার চলবে। কিন্তু কত দিন ধরে চলবে? একটা সময়সীমা থাকা দরকার। নাটোরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে খুনোখুনি চলছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। ১৯৮০ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সাংসদ রফিক সরকারকে দুর্বৃত্তরা খুন করে। সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি। মামলার নথিপত্র পর্যন্ত লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। অনেকের মতে, তখন থেকেই সেখানে হত্যার রাজনীতি শুরু। এরপর ২০০২ সালের ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় যুবলীগের সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন স্থানীয় বিএনপির নেতা এম এ আলীম। এই খুনের বদলা নিতে ওই রাতেই বিএনপির সশস্ত্র ক্যাডাররা বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আইনাল হককে কুপিয়ে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। এই মামলা এখনো চলছে।
বড়াইগ্রামে ২০০২ সালে করুণ হত্যাকাণ্ডের শিকার আওয়ামী লীগ নেতা আইনাল হকের ছেলে হলেন জাকির হোসেন। এই জাকির হোসেন ও তাঁর দুই ভাইসহ দলীয় লোকজন সানাউল্লাহ নূর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি। তিনি ২০০৩ সালে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিএনপির বিক্ষুব্ধ প্রার্থী, সম্প্রতি নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। একদিকে বাবার হত্যার প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে চেয়ারম্যান নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি। হয়তো এসব উপাদান সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে। অর্থাৎ নাটোরে চলছে খুনের বদলে খুন, রক্তের বদলে রক্ত। কোনো সভ্য দেশে এ রকম চলতে পারে না।
নাটোরের এই খুনোখুনি শুধু ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। আসল ব্যাপার হলো, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। অবৈধ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক চোরাচালানসহ যাবতীয় অপকর্ম অনায়াসে চালানোর জন্য দরকার একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই রাজনৈতিক সহিংসতার নামে যা চলছে তা বন্ধ করতে চাইলে এসব অপকর্ম বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
এই নাটোরকে ২০০৩ সালে সরকারি উদ্যোগে ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে ওই বছরের ৩১ মার্চ নাটোর শহরের কানাইখালী মাঠে মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের আগে কিছু ফেনসিডিলের বোতল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল মাদকের কবর রচনা। সমাবেশস্থলে সমবেত লোকজনের মধ্যে সেদিন কিন্তু তেমন কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা যায়নি। বরং সমাবেশের প্রথম দু-তিন সারিতে বসে থাকা মুখচেনা সন্ত্রাসীদের প্রতি লক্ষ করে সভায় উপস্থিত লোকজন বলাবলি করছিলেন, সন্ত্রাসীদের দিয়ে কি সন্ত্রাস দূর করা যাবে?
এরপর বছর না ঘুরতেই তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামাকে সদর উপজেলার রামশাকাজিপুরে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এর পরপরই শাহপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ১৬টি বাড়িতে বিএনপির ক্যাডাররা গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়। অনেককে পিটিয়ে আধমরা করা হয়। আসলে তখন সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত জেলা ঘোষণা করা হলেও নাটোরে চলছিল নির্বিচার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকের উপদ্রব।
নাটোরে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে দলমত-নির্বিশেষে সবাই মিলে লাঠি-বাঁশি সমিতি গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রথমে কেউ ভাবতে পারেনি যে সামান্য বাঁশি বাজিয়ে আর লাঠি সম্বল করে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল আন্দোলন বেশ সফল। যেখানে চাঁদাবাজি, সেখানেই লাঠি-বাঁশি। সমগ্র নাটোরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে এল। মানুষও খুশি। ২০০১ সালে যেখানে নাটোর থানায় মাসে গড়ে ২৩০টি অপরাধের মামলা হতো, তা ক্রমে কমে এল। পরবর্তী তিন বছরে মামলার সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে, কোনো কোনো মাসে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এই লাঠি-বাঁশি সমিতি যে শুধু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াল তা-ই নয়, তারা নানা ধরনের সামাজিক কাজও শুরু করল। তারা মোবাইল ব্লাডব্যাংক গঠন করল। সাড়ে চার হাজার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে তারা মুমূর্ষু মানুষের সেবা দিতে এগিয়ে গেল।
কিন্তু এই সাফল্য অনেকের সহ্য হলো না। ২০০৫ সালে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলা হলো, লাঠি-বাঁশি সমিতি ভালো কাজ করছে, আইনশৃঙ্খলা এখন নিয়ন্ত্রণে, তাই এ সমিতির আর প্রয়োজন নেই। তারা এটাও বলল, লাঠি-বাঁশি যদি সবকিছু করে, তাহলে থানার পুলিশ কী করবে? ফলে তখন লাঠি-বাঁশি সমিতির মূল নেতা আবদুস সালামসহ অন্য নেতাদের সরিয়ে একটা অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হলো, যা কালক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখন লাঠি-বাঁশি সমিতির অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে নাটোর থানায় বিভিন্ন অপরাধে মাসে মামলার সংখ্যা গড়ে ১০০ থেকে ১৫০।
নাটোরে সন্ত্রাস হয়তো চলতেই থাকবে। কারণ, সেখানে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ব্যাপার চলছে। এর প্রতিকারের একটি উপায়, যেটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। তিনি যখন এই প্রতিজ্ঞা করেছেন, আমরা আশা করব তা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু সেই বিচার যেন অনাদিকাল ধরে না চলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের সক্রিয় উদ্যোগও প্রয়োজন। এসব নিয়ে সরকারকেই ভাবতে হবে।
এ ব্যাপারে সোমবার লাঠি-বাঁশি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুস সালামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, সানাউল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর নাটোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন তাঁকে ফোন করে বলছেন, আমাদের বাঁচান, লাঠি-বাঁশি সমিতি আবার শুরু করুন। প্রধানমন্ত্রী নাটোরের সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার যে সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, তা সফল করতে এ ব্যবস্থাটি ভালো ফল দিতে পারে।
এটা মোটেও বাড়তি আশা নয়। মাস পাঁচেক আগে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাটোরে লাঠি-বাঁশি সমিতির নেতা আবদুস সালামের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সমিতির কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে গেছেন। পুলিশ একাডেমি সম্ভবত লাঠি-বাঁশি সমিতির কার্যক্রমের ওপর গবেষণা পরিচালনা করছে। যদি এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে খুব ভালো একটি কাজ হবে। কারণ, সন্ত্রাসীরা বহুরূপী। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয় আবার নিজেরাই সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দেয়। তখন মানুষ পেছনের সারিতে চলে যায়। এই মানুষকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। পুলিশ, প্রশাসন ও গণমানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে তুললে সন্ত্রাসের বহুরূপী গডফাদাররা টিকতে পারে না। অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে।
সরকার নাটোরের লাঠি-বাঁশি সমিতিকে একটি রোল-মডেল (অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত) হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সরকারেরই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। আর এ জন্য লাঠি-বাঁশি সমিতিকে স্বাধীন ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিলে সরকার দশে দশে না হলেও আট-নয় তো পাবেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
৫ অক্টোবর প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি এনামুল হকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলছিলেন, ১১ তারিখ না জানি কী হয়! কেন? কারণ, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। কয়েক দিন আগে ইউনিয়ন বিএনপির একজন নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রেললাইনের পাশে ওই নেতার এলাকায় বিএনপি প্রতিবাদ সভা করতে চেয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগও একই স্থানে সভা ডেকে বিএনপির সভা ভণ্ডুল করে দেয়। এরপর এরই কাছাকাছি স্থানে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ফলে সেই সভা নিয়ে একটা কিছু ঘটে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু সোমবার সকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ শান্ত। কোনো শঙ্কা ছিল না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা ছিল না।
অথচ তারপরও এমন একটা অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গেল। ট্রেনের ধাক্কায় আহত একজন বলেছেন, সমাবেশের মাইকের প্রচণ্ড শব্দের কারণে রেলগাড়ির হুইসেলের শব্দ রেললাইনে অবস্থানরত মানুষ শুনতে পায়নি। ফলে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখতে হবে।
কিন্তু তাও কথা থাকবে। নাটোরে হত্যাকাণ্ডের পর সিরাজগঞ্জের এই ঘটনা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। এটা উদ্বেগজনক। কারণ, রাজনীতি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। কোথায় চলেছে দেশ? বুধবার ৬ অক্টোবর সংসদের শরৎকালীন অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানালেন। কিন্তু এক দিন পরই নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বিএনপির নেতা সানাউল্লাহ নূরকে হত্যা করা হলো। মনে হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই মানুষকে কষ্ট দিতে উন্মুখ হয়ে আছেন। না হলে কেন প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মানুষ মারবে তারা? আর বিএনপির নেতাদের মারলে তারা কি বসে থাকবে? এভাবে নাটোরে হরতাল ডেকে আনা হয়েছে। নাটোরের ঘটনার এক দিন পরই আবার ছাত্রলীগের সহিংসতা। রংপুরে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাল্টাপাল্টি মিছিল। সংঘর্ষের আশঙ্কায় রংপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ। একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলে সংঘর্ষ। পরপর ঘটে চলেছে রাজনৈতিক সহিংসতা। অভিযোগ সরকারদলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে। মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য বিরোধী দলকে আহ্বান জানানো সত্যিই পরিহাসের মতো শোনায়।
কেউ হয়তো বলবেন, সন্ত্রাস শুধু ক্ষমতাসীনেরাই করছে না, বিরোধী দলও করছে। কুমিল্লায় তারা দিনে-দুপুরে মুখে কাপড় বেঁধে তাদেরই দলের লোকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। যুবদলের সম্মেলন রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে ওদেরই সশস্ত্র ক্যাডাররা। মানলাম বিরোধী দলও সন্ত্রাস করছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না কেন? ওদের ছবি উঠেছে পত্রিকায়। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেবে, পুলিশ কিছু বলবে না? সরকারি দলের লোক সন্ত্রাস করলেও পুলিশ কিছু বলে না, বিরোধী দল করলেও ধরে না। তাহলে এই পুলিশের দরকার কী?
এটা পুলিশের দোষ নয়। পুলিশকে কী সংকেত দেওয়া হচ্ছে, সেটাই আসল কথা। সরকারি দলের ক্যাডারদের ধরতে গেলে জাত যায়, তাই উচ্চপর্যায় থেকে আশ্বাসের অপেক্ষায় পুলিশকে থাকতে হয়। আর বিরোধী দল যদি নিজেদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত বাধায়, তাহলেও পুলিশকে সক্রিয় হতে উচ্চমহলের মাথা নাড়ানি লাগবে। কারণ, বিরোধী দলের নাম খারাপ হলে তো সরকারের লাভ।
নাটোরের সহিংস ঘটনার বিষয়ে কথা বলছিলাম ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে। তিনি বললেন, নেত্রীর সদিচ্ছা আছে, কিন্তু দলের মধ্যে কিছু নব্য আওয়ামী লীগার সরকারের সাফল্য নষ্ট করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাটোরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভিডিওচিত্র দেখে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। ঘটনার পরদিন একজন সন্দেহভাজন ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ২৭ আসামির মধ্যে মাত্র একজন গ্রেপ্তার কেন?
এত বড় একটা ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটেছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যেত। প্রধানমন্ত্রী তখন দলীয় সভায় বলতে পারতেন, মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তাহলে অন্তত বোঝা যেত সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিজ দলের লোকজনকেও আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। সেটা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করত। কিন্তু সেটা হয়নি। বস্তুত, এই বিলম্ব ছিল প্রকৃত আসামিদের গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার কৌশলী ব্যবস্থা। মূল আসামিরা সরে পড়েছেন। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে সেটা করা কঠিন। শুধু সদিচ্ছা দিয়েই সুবিচার হয় না।
হয়তো আরও কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হবেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিচার চলবে। কিন্তু কত দিন ধরে চলবে? একটা সময়সীমা থাকা দরকার। নাটোরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে খুনোখুনি চলছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। ১৯৮০ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সাংসদ রফিক সরকারকে দুর্বৃত্তরা খুন করে। সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি। মামলার নথিপত্র পর্যন্ত লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। অনেকের মতে, তখন থেকেই সেখানে হত্যার রাজনীতি শুরু। এরপর ২০০২ সালের ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় যুবলীগের সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন স্থানীয় বিএনপির নেতা এম এ আলীম। এই খুনের বদলা নিতে ওই রাতেই বিএনপির সশস্ত্র ক্যাডাররা বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আইনাল হককে কুপিয়ে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। এই মামলা এখনো চলছে।
বড়াইগ্রামে ২০০২ সালে করুণ হত্যাকাণ্ডের শিকার আওয়ামী লীগ নেতা আইনাল হকের ছেলে হলেন জাকির হোসেন। এই জাকির হোসেন ও তাঁর দুই ভাইসহ দলীয় লোকজন সানাউল্লাহ নূর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি। তিনি ২০০৩ সালে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিএনপির বিক্ষুব্ধ প্রার্থী, সম্প্রতি নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। একদিকে বাবার হত্যার প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে চেয়ারম্যান নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি। হয়তো এসব উপাদান সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে। অর্থাৎ নাটোরে চলছে খুনের বদলে খুন, রক্তের বদলে রক্ত। কোনো সভ্য দেশে এ রকম চলতে পারে না।
নাটোরের এই খুনোখুনি শুধু ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। আসল ব্যাপার হলো, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। অবৈধ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক চোরাচালানসহ যাবতীয় অপকর্ম অনায়াসে চালানোর জন্য দরকার একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই রাজনৈতিক সহিংসতার নামে যা চলছে তা বন্ধ করতে চাইলে এসব অপকর্ম বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
এই নাটোরকে ২০০৩ সালে সরকারি উদ্যোগে ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে ওই বছরের ৩১ মার্চ নাটোর শহরের কানাইখালী মাঠে মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের আগে কিছু ফেনসিডিলের বোতল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল মাদকের কবর রচনা। সমাবেশস্থলে সমবেত লোকজনের মধ্যে সেদিন কিন্তু তেমন কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা যায়নি। বরং সমাবেশের প্রথম দু-তিন সারিতে বসে থাকা মুখচেনা সন্ত্রাসীদের প্রতি লক্ষ করে সভায় উপস্থিত লোকজন বলাবলি করছিলেন, সন্ত্রাসীদের দিয়ে কি সন্ত্রাস দূর করা যাবে?
এরপর বছর না ঘুরতেই তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামাকে সদর উপজেলার রামশাকাজিপুরে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এর পরপরই শাহপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ১৬টি বাড়িতে বিএনপির ক্যাডাররা গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়। অনেককে পিটিয়ে আধমরা করা হয়। আসলে তখন সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত জেলা ঘোষণা করা হলেও নাটোরে চলছিল নির্বিচার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকের উপদ্রব।
নাটোরে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে দলমত-নির্বিশেষে সবাই মিলে লাঠি-বাঁশি সমিতি গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রথমে কেউ ভাবতে পারেনি যে সামান্য বাঁশি বাজিয়ে আর লাঠি সম্বল করে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল আন্দোলন বেশ সফল। যেখানে চাঁদাবাজি, সেখানেই লাঠি-বাঁশি। সমগ্র নাটোরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে এল। মানুষও খুশি। ২০০১ সালে যেখানে নাটোর থানায় মাসে গড়ে ২৩০টি অপরাধের মামলা হতো, তা ক্রমে কমে এল। পরবর্তী তিন বছরে মামলার সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে, কোনো কোনো মাসে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এই লাঠি-বাঁশি সমিতি যে শুধু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াল তা-ই নয়, তারা নানা ধরনের সামাজিক কাজও শুরু করল। তারা মোবাইল ব্লাডব্যাংক গঠন করল। সাড়ে চার হাজার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে তারা মুমূর্ষু মানুষের সেবা দিতে এগিয়ে গেল।
কিন্তু এই সাফল্য অনেকের সহ্য হলো না। ২০০৫ সালে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলা হলো, লাঠি-বাঁশি সমিতি ভালো কাজ করছে, আইনশৃঙ্খলা এখন নিয়ন্ত্রণে, তাই এ সমিতির আর প্রয়োজন নেই। তারা এটাও বলল, লাঠি-বাঁশি যদি সবকিছু করে, তাহলে থানার পুলিশ কী করবে? ফলে তখন লাঠি-বাঁশি সমিতির মূল নেতা আবদুস সালামসহ অন্য নেতাদের সরিয়ে একটা অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হলো, যা কালক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখন লাঠি-বাঁশি সমিতির অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে নাটোর থানায় বিভিন্ন অপরাধে মাসে মামলার সংখ্যা গড়ে ১০০ থেকে ১৫০।
নাটোরে সন্ত্রাস হয়তো চলতেই থাকবে। কারণ, সেখানে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ব্যাপার চলছে। এর প্রতিকারের একটি উপায়, যেটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। তিনি যখন এই প্রতিজ্ঞা করেছেন, আমরা আশা করব তা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু সেই বিচার যেন অনাদিকাল ধরে না চলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের সক্রিয় উদ্যোগও প্রয়োজন। এসব নিয়ে সরকারকেই ভাবতে হবে।
এ ব্যাপারে সোমবার লাঠি-বাঁশি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুস সালামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, সানাউল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর নাটোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন তাঁকে ফোন করে বলছেন, আমাদের বাঁচান, লাঠি-বাঁশি সমিতি আবার শুরু করুন। প্রধানমন্ত্রী নাটোরের সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার যে সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, তা সফল করতে এ ব্যবস্থাটি ভালো ফল দিতে পারে।
এটা মোটেও বাড়তি আশা নয়। মাস পাঁচেক আগে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাটোরে লাঠি-বাঁশি সমিতির নেতা আবদুস সালামের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সমিতির কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে গেছেন। পুলিশ একাডেমি সম্ভবত লাঠি-বাঁশি সমিতির কার্যক্রমের ওপর গবেষণা পরিচালনা করছে। যদি এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে খুব ভালো একটি কাজ হবে। কারণ, সন্ত্রাসীরা বহুরূপী। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয় আবার নিজেরাই সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দেয়। তখন মানুষ পেছনের সারিতে চলে যায়। এই মানুষকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। পুলিশ, প্রশাসন ও গণমানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে তুললে সন্ত্রাসের বহুরূপী গডফাদাররা টিকতে পারে না। অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে।
সরকার নাটোরের লাঠি-বাঁশি সমিতিকে একটি রোল-মডেল (অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত) হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সরকারেরই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। আর এ জন্য লাঠি-বাঁশি সমিতিকে স্বাধীন ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিলে সরকার দশে দশে না হলেও আট-নয় তো পাবেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments