সংসদকে খোঁয়াড় বানাবেন না by বাহাউদ্দীন চৌধুরী
কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে
লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারী দল ও বিরোধী দল অশালীন কুৎসিত
ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করে।
তাদের ভাষা ছিল কদর্য ও
কুরুচিপূর্ণ। এ ভাষা ব্যবহারে ৰুব্ধ হয়ে স্পীকার আবদুল হামিদ বলতে বাধ্য
হয়েছেন, 'সংসদে যা ঘটেছে তা জাতির জন্য লজ্জাকর। ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে
প্রমাণিত হয় কে কোথা থেকে উঠে এসেছেন।' এর চাইতে কঠোর সমালোচনা আর কি হতে
পারে? আমরাও এই বিষয়ে স্পীকারের সঙ্গে একমত। স্পীকার আরও বলেছেন ,
'আলস্নাহর ওয়াস্তে সংসদের মান-মর্যাদা রৰা করুন। এমনভাবে কথা বলুন যাতে
সংসদ কার্যকর হয়।' মারামারি করতে চাইলে তিনি সংসদ সংসদ্যদের গায়ে তেল মেখে
পল্টন ময়দানে যাওয়ার উপদেশ দেন। সত্যি কথা হলো, সংসদ সদস্যগণ যে ভাষায় কথা
বলেন তা পল্টন ময়দানের মেঠো ভাষার চাইতেও নিম্নস্তরের। তাতে স্পীকারের
ইঙ্গিতই যথার্থ বলে মনে হয়। এক সময় সংসদকে শুয়োরের খোঁয়াড় বলেও আখ্যায়িত
করা হয়েছে। বর্তমান সংসদের সদস্যবৃন্দ যেন এই কথাটা প্রমাণেই নিয়োজিত আছেন।
তাতে তাদের কোন লজ্জা-শরম নেই।
সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টেও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তার জন্য কয়েকজন সদস্যকে শাসত্মি দিয়ে সদস্যপদ স্থগিত রাখা হয়েছে। ইতোপূর্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিসত্মান আইনসভায় ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মর্মান্তিক মৃতু্য হয়েছে। সেই অজুহাতে সামরিক শাসন জারি হয়। আমাদের পার্লামেন্টে অবশ্য এখনও সেই পরিস্থিতি হয় নাই। তবে অশুভ আলামত দেখা যাচ্ছে। এভাবে সংসদকে অকার্যকর করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অচল করলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। জিয়াউর রহমান বা এরশাদের মতো সামরিক শাসন প্রবর্তনের অবস্থা দেশে নাই। জনগণ সামরিক শাসন মেনে নেবে না। সামরিক ছত্রছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্য কলাপে জাতি হতাশ তাই যেমন করেই হোক, সংসদীয় গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে। স্বৈরাচারী সেনা শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল জাতীয় সংসদের অবাধ নিরপেৰ নির্বাচন। এরশাদের পতনের পরে সব দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। এত লড়াইয়ের পরে যে সংসদীয় গণতন্ত্র দেশে বর্তমানে চলছে তা যেন হুমকির মুখে। এই বিষয়ে সব দলের সংসদ সদস্যদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এখনও দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নাই। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্থায়ীরূপ দেয়ার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। তারা সেকথা ভুলে সংসদকে গালাগালির আখড়ায় পরিণত করেছেন। এর চাইতে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। তাদের এই অসভ্য আচরণে তারা মোটেই অনুতপ্ত নন। বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক বলেন, 'ভাল আচরণের জন্যই আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এতদিন পরে স্পীকার আমাদের আচরণ শেখাবার কে?' স্পীকারের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর অভিযোগও আনা হয়। স্পীকার অবশ্য বলেছেন, তিনি ভয় দেখাবার জন্য কিছু বলেন নাই। তিনি কাউকে শিৰাও দিতে চান নাই। সংসদ সদস্যদের মনে রাখতে হবে, তাদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে তাঁরা জাতির কাছে দায়ী থাকবেন।
আমরা কখনও পাকিস্তানী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ফিরে যেতে পারি না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্পদিন পরেই পাকিস্তান সেনাপতি শাসকদের দখলে চলে যায়। তাদের স্বৈরাচারী শাসনে গণতন্ত্র বিসর্জিত হয়। দীর্ঘদিন তারা একটি সংবিধান রচনা করতে পারেনি। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়, সবরকম গণতান্ত্রিক অধিকার লুপ্ত হয়। বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেৰিত হয়। বাঙালী বিৰুব্ধ হয়। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে পাকিস্তানী রাজনৈতিক ধারা পুনরায় প্রবর্তনের চক্রান্ত হয়। সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ধমীয় মৌলবাদীদের পুনর্বাসিত করেন। এই দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়। তারা দেশে পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা প্রবর্তনের আন্দোলন এবং দেশটাকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চায়। জিয়াউর রহমান তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেন। ভারতবিরোধী নীতি গ্রহণ করে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। অথচ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাত্তরে গণহত্যা করে, পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ বাঙালী প্রাণ হারায়, তিন লাখ নারী ইজ্জত হারায়। ভারত সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দেয়, প্রায় এক কোটি বাঙালী শরণাথীকে আশ্রয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা অস্বীকার অকৃতজ্ঞতা ও বেইমানী। জিয়াউর রহমান সেই কাজটিই করেন। তার উত্তরসূরি আর এক সেনাপতি শাসক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে রচিত বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষিত হয় : ধর্মনিরপেৰতা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। স্বৈর শাসকরা সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেৰতা ও সমাজতন্ত্র বাতিল করে। উপরন্তু রাষ্ট্র ধর্মরূপে ইসলাম সংযোজিত হয়। মোট কথা, সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণ বিসর্জিত হয়। উচ্চ আদালতে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করায় বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্প্রবর্তিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আবেগের বশবতী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি উঠেছে। দেশের মানুষকে ভাল করে বোঝাতে হবে যে, ধর্মনিরপেৰতা ধর্মহীনতা নয়। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের ভুল বুঝানো খুবই সহজ। এমনিতেই তো বিএনপি বলে আসছে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব মসজিদ মন্দির হয়ে যাবে। দেশে ইসলাম বিপন্ন হবে। এ রকম ধর্মের দোহাই দিয়েই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালী নিধন করেছে, নির্বিচারে নারী নির্যাতন করেছে। তাই দেশে ধমীয় মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন জোদার করতে হবে।
বিএনপি নিঃসন্দেহে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। দেশে তাদের কোটি কোটি সমর্থক আছে। বিগত নির্বাচনে তারা কম আসন পেলেও ভোট তত কম পায় নাই। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবল সমর্থক। তাদের সহায়তায়ই জামায়াতের সাহস বেড়ে গেছে। তারা আবার হত্যার রাজনীতি শুরু করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ধর্মীয় জঙ্গীদের প্রস্তুতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। তারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যতই এগিয়ে আসছে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই আপাতত বাহাত্তরের সংবিধান প্রবর্তনের চিন্তা না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি সমাপ্ত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের পৰে প্রবল জনমত আছে। তাই দ্রুত এই কাজটি করতে হবে।
আগেই বলেছি, সংসদে যা ঘটেছে তা দুঃখজনক। বিশেষত মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা অমানবিক কাজ। তাদের কবর নিয়ে মন্তব্য অতিশয় নিম্নমানের পরিচায়ক। দেশে অনেক সমস্যা আছে। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, বিদ্যুত ও গ্যাস সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বিরোধী দল এসব সমস্যার কথা না বলে অহেতুক জাতির পিতার ভাবমূর্তি ৰুণ্ন করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাৰরে লিখিত থাকবে। তার সঙ্গে কারুরই তুলনা হতে পারে না। আশা করব, স্পীকারের উপদেশমতো সংসদ সদস্যগণ সভ্য আচরণ করবেন এবং দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবদান রাখবেন।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টেও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তার জন্য কয়েকজন সদস্যকে শাসত্মি দিয়ে সদস্যপদ স্থগিত রাখা হয়েছে। ইতোপূর্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিসত্মান আইনসভায় ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মর্মান্তিক মৃতু্য হয়েছে। সেই অজুহাতে সামরিক শাসন জারি হয়। আমাদের পার্লামেন্টে অবশ্য এখনও সেই পরিস্থিতি হয় নাই। তবে অশুভ আলামত দেখা যাচ্ছে। এভাবে সংসদকে অকার্যকর করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অচল করলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। জিয়াউর রহমান বা এরশাদের মতো সামরিক শাসন প্রবর্তনের অবস্থা দেশে নাই। জনগণ সামরিক শাসন মেনে নেবে না। সামরিক ছত্রছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্য কলাপে জাতি হতাশ তাই যেমন করেই হোক, সংসদীয় গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে। স্বৈরাচারী সেনা শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল জাতীয় সংসদের অবাধ নিরপেৰ নির্বাচন। এরশাদের পতনের পরে সব দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। এত লড়াইয়ের পরে যে সংসদীয় গণতন্ত্র দেশে বর্তমানে চলছে তা যেন হুমকির মুখে। এই বিষয়ে সব দলের সংসদ সদস্যদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এখনও দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নাই। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্থায়ীরূপ দেয়ার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। তারা সেকথা ভুলে সংসদকে গালাগালির আখড়ায় পরিণত করেছেন। এর চাইতে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। তাদের এই অসভ্য আচরণে তারা মোটেই অনুতপ্ত নন। বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক বলেন, 'ভাল আচরণের জন্যই আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এতদিন পরে স্পীকার আমাদের আচরণ শেখাবার কে?' স্পীকারের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর অভিযোগও আনা হয়। স্পীকার অবশ্য বলেছেন, তিনি ভয় দেখাবার জন্য কিছু বলেন নাই। তিনি কাউকে শিৰাও দিতে চান নাই। সংসদ সদস্যদের মনে রাখতে হবে, তাদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে তাঁরা জাতির কাছে দায়ী থাকবেন।
আমরা কখনও পাকিস্তানী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ফিরে যেতে পারি না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্পদিন পরেই পাকিস্তান সেনাপতি শাসকদের দখলে চলে যায়। তাদের স্বৈরাচারী শাসনে গণতন্ত্র বিসর্জিত হয়। দীর্ঘদিন তারা একটি সংবিধান রচনা করতে পারেনি। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়, সবরকম গণতান্ত্রিক অধিকার লুপ্ত হয়। বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেৰিত হয়। বাঙালী বিৰুব্ধ হয়। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে পাকিস্তানী রাজনৈতিক ধারা পুনরায় প্রবর্তনের চক্রান্ত হয়। সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ধমীয় মৌলবাদীদের পুনর্বাসিত করেন। এই দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়। তারা দেশে পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা প্রবর্তনের আন্দোলন এবং দেশটাকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চায়। জিয়াউর রহমান তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেন। ভারতবিরোধী নীতি গ্রহণ করে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। অথচ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাত্তরে গণহত্যা করে, পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ বাঙালী প্রাণ হারায়, তিন লাখ নারী ইজ্জত হারায়। ভারত সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দেয়, প্রায় এক কোটি বাঙালী শরণাথীকে আশ্রয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা অস্বীকার অকৃতজ্ঞতা ও বেইমানী। জিয়াউর রহমান সেই কাজটিই করেন। তার উত্তরসূরি আর এক সেনাপতি শাসক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে রচিত বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘোষিত হয় : ধর্মনিরপেৰতা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। স্বৈর শাসকরা সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেৰতা ও সমাজতন্ত্র বাতিল করে। উপরন্তু রাষ্ট্র ধর্মরূপে ইসলাম সংযোজিত হয়। মোট কথা, সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণ বিসর্জিত হয়। উচ্চ আদালতে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করায় বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্প্রবর্তিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আবেগের বশবতী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি উঠেছে। দেশের মানুষকে ভাল করে বোঝাতে হবে যে, ধর্মনিরপেৰতা ধর্মহীনতা নয়। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের ভুল বুঝানো খুবই সহজ। এমনিতেই তো বিএনপি বলে আসছে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব মসজিদ মন্দির হয়ে যাবে। দেশে ইসলাম বিপন্ন হবে। এ রকম ধর্মের দোহাই দিয়েই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালী নিধন করেছে, নির্বিচারে নারী নির্যাতন করেছে। তাই দেশে ধমীয় মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন জোদার করতে হবে।
বিএনপি নিঃসন্দেহে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। দেশে তাদের কোটি কোটি সমর্থক আছে। বিগত নির্বাচনে তারা কম আসন পেলেও ভোট তত কম পায় নাই। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবল সমর্থক। তাদের সহায়তায়ই জামায়াতের সাহস বেড়ে গেছে। তারা আবার হত্যার রাজনীতি শুরু করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ধর্মীয় জঙ্গীদের প্রস্তুতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। তারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যতই এগিয়ে আসছে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই আপাতত বাহাত্তরের সংবিধান প্রবর্তনের চিন্তা না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি সমাপ্ত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের পৰে প্রবল জনমত আছে। তাই দ্রুত এই কাজটি করতে হবে।
আগেই বলেছি, সংসদে যা ঘটেছে তা দুঃখজনক। বিশেষত মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা অমানবিক কাজ। তাদের কবর নিয়ে মন্তব্য অতিশয় নিম্নমানের পরিচায়ক। দেশে অনেক সমস্যা আছে। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, বিদ্যুত ও গ্যাস সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বিরোধী দল এসব সমস্যার কথা না বলে অহেতুক জাতির পিতার ভাবমূর্তি ৰুণ্ন করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাৰরে লিখিত থাকবে। তার সঙ্গে কারুরই তুলনা হতে পারে না। আশা করব, স্পীকারের উপদেশমতো সংসদ সদস্যগণ সভ্য আচরণ করবেন এবং দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবদান রাখবেন।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
No comments