আমাদের স্বপ্ন ॥ শান্তি সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির স্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম by ইকবাল আজিজ
যেখানে সবুজ পাহাড় আছে আকাশে হেলান দিয়ে;
অরণ্য বৃক্ষ আর নিসর্গের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যায়, হ্রদে হাঁস-বক ভেসে বেড়ায়
আর পাহাড়ে উপত্যকায় শান্তি সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির স্বর্গ হয়ে ডাক দেয়
পার্বত্য চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে এ দেশের লাখ লাখ মানুষের মতো আমারও এই একটিই
অভিন্ন স্বপ্ন। এ দেশের সামান্য কিছু বিপথগামী মানুষ হয়ত সেখানে বিভাজন,
বিভেদ ও বিরোধ দেখতে চায়; কোন কোন বিদেশী শক্তির ইশারায় এরা চায় এ স্বপ্নময়
শান্তির স্বর্গে যেন বছরের পর বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে আর সেখানে যেন
সর্বদাই বিরাজ করে অস্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অংশ এভাবে প্রতি মুহূর্তে বিরোধ ও সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হলে কার লাভ? একথা
সবাইকে ভাবতে হবে। প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালীকে এ কথা গভীরভাবে ভাবতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হানাদার পাকিস্তানীদের কবল থেকে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। বহু গোত্র, বংশ ও উপজাতির সংমিশ্রণে প্রায় তিন হাজার বছরের আবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে বৃহত্তর ও কল্যাণকামী বাঙালী জাতীয়তাবাদই ছিল আমাদের প্রধান প্রেরণা। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় পরিচয় আমরা মুছে ফেলতে চাই না। স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ী এলাকায় অংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র ও উপজাতির বসবাস। কখনও ধর্ম, কখনওবা ভাষা অথবা সামাজিক সম্পর্ককে ভিত্তি করে তাদের মধ্যে অবিরত সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং কালক্রমে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি মহাজাতিসত্তা হিসেবে বাঙালীর আবির্ভাব ঘটেছে। প্রধানত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই এ জাতির মূল ভিত্তি। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, পশ্চিমে বিহার-উড়িষ্যা এবং দৰিণে আরাকান ও বঙ্গোপসাগর। এই বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল বাঙালীর বসবাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মূলত এই এলাকা নিয়েই 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি' গড়ে উঠেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে তা ভেঙ্গে যায় এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় তা পুনরায় দ্বিখণ্ডিত হয়। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র আবির্ভূত হয়েছে, সেখানে চট্টগ্রামের 'পার্বত্য অঞ্চল' অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত।
১৯৬৪ সালে আমার শৈশবে বাবা ও মায়ের সাথে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার বিয়েতে যোগদানই ছিল এ ভ্রমণের লক্ষ্য। উঠেছিলাম চন্দনপুরায় আমার এক প্রকৌশলী চাচার বাসায়। রাস্তার ওপারে পাহাড়ের ওপর ফজলুল কাদের চৌধুরীর রূপকথার মতো সুন্দর বাড়ি; একটু দূরে বেলা বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত গনি মিয়ার বেকারি ও জয়া পাহাড়। তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল বাস্তবিকই রূপকথার মতো সুন্দর ও ছিমছাম। যাই হোক সেই আত্মীয়ার বিয়ের পর আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো। বাবা আমাকে তিন দিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন রাঙ্গামাটি। সেই আমার প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ। এই প্রথম পরিচিত হলাম আমাদের অতিশয় আপন কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে। প্রায় তিনদিকে হ্রদ ও মাঝখানে রাঙ্গামাটি শহর। হ্রদে স্পিডবোটে ভ্রমণ। মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মধ্যে এক আশ্চর্য সুখের কাব্যময় শহর এ রাঙ্গামাটি। এরপর সেখানে যাই ১৯৮২ সালে আমার প্রথম চাকরির কাজে। এবার বাইরের সৌন্দর্যের আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে অনুভব করি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত কয়েকজন উপজাতীয় রাজা ও গোত্রপ্রধানদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাকিস্তানী আমলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সেই কৌশলগত ধারাটি অব্যাহত থেকেছে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা কেবলমাত্র সেখানকার রাজা ও গোত্রপ্রধানদের কাছ থেকে আনুগত্য চেয়েছেন এবং উপজাতীয় জনজীবনে সরাসরি হস্তেক্ষেপ করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ফলে উপজাতীয় রাজা ও হেডম্যানরা যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন; উপজাতীয় জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল সেখানে ব্যাপকভাবে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কল্যাণময় বাঙালী জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় সংগঠিত করতে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের প্রতিটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে বিশ্বাসঘাতক সবদেশেই থাকে। এই লড়াইয়ে গোলাম আযম, মওলানা মান্নান প্রমুখ যেমন পাকিস্তানী বাহিনীর দালাল ছিলেন; তেমনই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও তার দু'একজন সহযোগী চেয়েছিলেন এদেশে পাকিস্তানী শাসন অব্যাহত রাখতে। কিন্তু বিপথগামী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দেশপ্রেমিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যায়ন উচিত নয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শোচনীয় ও অপমানজনক পরাজয়ের পরে এদেশের কিছু কিছু পাকিস্তানপন্থীর বিভাজনমূলক তৎপরতা 'সুখ সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির স্বর্গ' পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এরাই সহজ সরল উপজাতীয়দের নানাভাবে বিভ্রান্ত করেছে ও তাদের বাঙালীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের এ ধরনের অপতৎপরতা আরও বৃদ্ধি করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে তুচ্ছ ভূমিবিরোধকে কেন্দ্র করে যে রহস্যময় ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। মধ্যরাতে প্রায় একই সময় পাহাড়ী বা বাঙালীদের গুচ্ছগ্রামে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। এ নিয়ে পরের দিন প্রায় সারাদিনই পাহাড়ী, বাঙালী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেদিন আরও অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক স্থানের মতো বাঘাইছড়িতেও জমি নিয়ে বাঙালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে অল্প বিস্তর বিরোধ ছিল। কিন্তু তা যে হঠাৎ করে এমন সহিংস রূপ নিতে পারে তা কেউই অনুমান করতে পারেনি। এই রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের জন্য পাহাড়ী ও বাঙালী একে অপরকে দোষারোপ করে এবং পরদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এ ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, একটি গোষ্ঠী উস্কানিমূলকভাবে পাহাড়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যতদূর জানা যায়, বাঘাইছড়ির ঐ এলাকায় শান্তিচুক্তিবিরোধী 'ইউপিডিএ'-এর শক্ত অবস্থান রয়েছে। আবার এখানকার বসতি স্থাপনকারী বাঙালীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। সুতরাং বর্তমান মহাজোট সরকারকে গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতের কারণ কী? এর পেছনে কারা মদদ যুগিয়েছে? পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে তারা কি গোটা দেশকেই অস্থিতিশীল করতে চায়?
আমি প্রায়ই ভাবি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ 'পার্বত্য চট্টগ্রাম' নিয়ে তথাকথিত 'সুশীল সমাজের' এত আগ্রহ কেন? তারা প্রায়শই এমন ধরনের বক্তব্য রাখেন যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম মোটেই কোন বিরোধপূর্ণ এলাকা নয়। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে যেমন বেশকিছু বিরোধপূর্ণ এলাকা আছে, বাংলাদেশে তেমন একটিও নেই। ভারতের রয়েছে কাশ্মীর এবং অসম, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডসহ কিছু সংঘাতপূর্ণ এলাকা; তেমনি পাকিস্তানের আছে বেলুচিসত্মান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কিছু বিক্ষুব্ধ ও বিরোধপূর্ণ এলাকা। ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে প্রায়শই তাদের এসব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সেনা অভিযান চালাতে হয়। বাংলাদেশে পশ্চিমা কোন কোন দেশ ও কয়েকটি এনজিও প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে থাকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সচেতনতা ও প্রাজ্ঞতার অভাবের কারণে এভাবে পশ্চিমা দেশসমূহ 'সুশীল সমাজ' ও এনজিওদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নাক গলাতে সাহসী হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উচিত সমগ্র দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া। রংপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ঢাকা, সিলেট যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; তেমনই পার্বত্য চট্টগ্রামও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে। এরা বৃহত্তর বাঙালী জাতিসত্তার অন্যতম বর্ণাঢ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই, খেয়াং, বমসহ নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। এরা বাঙালীর অতি আপন ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের বাদ দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের কথা ভাবাই যায় না। সাম্রাজ্যবাদী কয়েকটি দেশ ও তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু এনজিও সর্বদা '১৫ কোটি বাঙালীর' মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে তৎপর। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই'। এরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধ ও বিভাজন সৃষ্টিতে তৎপর।
ভাষাগত জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৫ কোটি বাঙালী ও অখ- বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এৰেত্রে আমাদের সত্তার অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজাতিকে আপন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা 'আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী' বইটি আমাদের এক সময় বাঙ্গালীত্বের সাধনায় ব্যাপকভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' বিষয়ক তত্ত্ব আমাকে খুবই উদ্বিগ্ন করেছিল। বাঙালীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী গবেষকদের এ ছিল এক অতিশয় সুপরিকল্পিত কৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় গ্রুপগুলোকে তবে কী নামে ডাকা যায়?
এক সময় গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হলো। ১৯৯৫ সালে পাক্ষিক 'শৈলীর' পৰে তাঁকে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলাম উত্তরায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। কথা প্রসঙ্গে 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বলেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়তাদের কী নামে ডাকা যায়?' আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তখনই জবাব দিয়েছিলেন, 'আদি বাঙালী।' 'ওরাই হলো আদি বাঙালী। এ ধরনের বহু উপজাতীয় গ্রুপের সংমিশ্রণে আজকের বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে।'
আগামীতে সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির বিজয় অবশ্যম্ভাবী। রূপময় পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের গৌরব। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক ও অভিন্ন। বিদেশীদের পরামর্শে যে কোন বিভাজনমূলক নীতি হবে আমাদের জন্যে আত্মঘাতী। সেখানে জমি ক্রয় ও আবাসনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় মানুষ সেখানে অবাধে বসবাসের সুযোগ পাবে। তেমনই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশের যে কোন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবে। নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণের পর একজন বাঙালী পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের চেয়েও সৌন্দর্যময় ও আকর্ষণীয়।' কেবলমাত্র পর্যটনের বিকাশের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে বাংদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ। এছাড়া এখানকার আনারস ও পেঁপে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজতকরণের মধ্য দিয়ে বিদেশে রফতানি করা যায়। আনারস থেকে জ্যাম ও জেলি তৈরির জন্য বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠতে পারে। বান্দরবান কিংবা রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মানের একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জামায়াতে ইসলামী, শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে হবে। এ ব্যাপারে এতটুকু দেরি করলে চলবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এদেশের আদি বাঙালী ও বাঙালী সবারই গৌরবের ধন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর যেন পাহাড়ী-বাঙালী সংঘাতে এই এলাকার পবিত্র ভূমি কলঙ্কিত না হয়। আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি। মারমা কবি ক্যা শৈ প্রশ্ন রচিত একটি কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করি : 'জনসাধারণ, সকল শ্রমজীবী সুখী হোক/ সকল হৃদয় অপার আনন্দে উন্মোচিত হোক।'
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হানাদার পাকিস্তানীদের কবল থেকে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। বহু গোত্র, বংশ ও উপজাতির সংমিশ্রণে প্রায় তিন হাজার বছরের আবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে বৃহত্তর ও কল্যাণকামী বাঙালী জাতীয়তাবাদই ছিল আমাদের প্রধান প্রেরণা। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় পরিচয় আমরা মুছে ফেলতে চাই না। স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ী এলাকায় অংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র ও উপজাতির বসবাস। কখনও ধর্ম, কখনওবা ভাষা অথবা সামাজিক সম্পর্ককে ভিত্তি করে তাদের মধ্যে অবিরত সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং কালক্রমে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি মহাজাতিসত্তা হিসেবে বাঙালীর আবির্ভাব ঘটেছে। প্রধানত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই এ জাতির মূল ভিত্তি। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, পশ্চিমে বিহার-উড়িষ্যা এবং দৰিণে আরাকান ও বঙ্গোপসাগর। এই বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল বাঙালীর বসবাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মূলত এই এলাকা নিয়েই 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি' গড়ে উঠেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে তা ভেঙ্গে যায় এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় তা পুনরায় দ্বিখণ্ডিত হয়। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র আবির্ভূত হয়েছে, সেখানে চট্টগ্রামের 'পার্বত্য অঞ্চল' অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত।
১৯৬৪ সালে আমার শৈশবে বাবা ও মায়ের সাথে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার বিয়েতে যোগদানই ছিল এ ভ্রমণের লক্ষ্য। উঠেছিলাম চন্দনপুরায় আমার এক প্রকৌশলী চাচার বাসায়। রাস্তার ওপারে পাহাড়ের ওপর ফজলুল কাদের চৌধুরীর রূপকথার মতো সুন্দর বাড়ি; একটু দূরে বেলা বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত গনি মিয়ার বেকারি ও জয়া পাহাড়। তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল বাস্তবিকই রূপকথার মতো সুন্দর ও ছিমছাম। যাই হোক সেই আত্মীয়ার বিয়ের পর আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো। বাবা আমাকে তিন দিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন রাঙ্গামাটি। সেই আমার প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ। এই প্রথম পরিচিত হলাম আমাদের অতিশয় আপন কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে। প্রায় তিনদিকে হ্রদ ও মাঝখানে রাঙ্গামাটি শহর। হ্রদে স্পিডবোটে ভ্রমণ। মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মধ্যে এক আশ্চর্য সুখের কাব্যময় শহর এ রাঙ্গামাটি। এরপর সেখানে যাই ১৯৮২ সালে আমার প্রথম চাকরির কাজে। এবার বাইরের সৌন্দর্যের আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে অনুভব করি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত কয়েকজন উপজাতীয় রাজা ও গোত্রপ্রধানদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাকিস্তানী আমলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সেই কৌশলগত ধারাটি অব্যাহত থেকেছে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকরা কেবলমাত্র সেখানকার রাজা ও গোত্রপ্রধানদের কাছ থেকে আনুগত্য চেয়েছেন এবং উপজাতীয় জনজীবনে সরাসরি হস্তেক্ষেপ করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ফলে উপজাতীয় রাজা ও হেডম্যানরা যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন; উপজাতীয় জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল সেখানে ব্যাপকভাবে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কল্যাণময় বাঙালী জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় সংগঠিত করতে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের প্রতিটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে বিশ্বাসঘাতক সবদেশেই থাকে। এই লড়াইয়ে গোলাম আযম, মওলানা মান্নান প্রমুখ যেমন পাকিস্তানী বাহিনীর দালাল ছিলেন; তেমনই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও তার দু'একজন সহযোগী চেয়েছিলেন এদেশে পাকিস্তানী শাসন অব্যাহত রাখতে। কিন্তু বিপথগামী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দেশপ্রেমিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যায়ন উচিত নয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শোচনীয় ও অপমানজনক পরাজয়ের পরে এদেশের কিছু কিছু পাকিস্তানপন্থীর বিভাজনমূলক তৎপরতা 'সুখ সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির স্বর্গ' পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এরাই সহজ সরল উপজাতীয়দের নানাভাবে বিভ্রান্ত করেছে ও তাদের বাঙালীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের এ ধরনের অপতৎপরতা আরও বৃদ্ধি করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে তুচ্ছ ভূমিবিরোধকে কেন্দ্র করে যে রহস্যময় ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। মধ্যরাতে প্রায় একই সময় পাহাড়ী বা বাঙালীদের গুচ্ছগ্রামে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। এ নিয়ে পরের দিন প্রায় সারাদিনই পাহাড়ী, বাঙালী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেদিন আরও অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক স্থানের মতো বাঘাইছড়িতেও জমি নিয়ে বাঙালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে অল্প বিস্তর বিরোধ ছিল। কিন্তু তা যে হঠাৎ করে এমন সহিংস রূপ নিতে পারে তা কেউই অনুমান করতে পারেনি। এই রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের জন্য পাহাড়ী ও বাঙালী একে অপরকে দোষারোপ করে এবং পরদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এ ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, একটি গোষ্ঠী উস্কানিমূলকভাবে পাহাড়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যতদূর জানা যায়, বাঘাইছড়ির ঐ এলাকায় শান্তিচুক্তিবিরোধী 'ইউপিডিএ'-এর শক্ত অবস্থান রয়েছে। আবার এখানকার বসতি স্থাপনকারী বাঙালীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। সুতরাং বর্তমান মহাজোট সরকারকে গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতের কারণ কী? এর পেছনে কারা মদদ যুগিয়েছে? পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে তারা কি গোটা দেশকেই অস্থিতিশীল করতে চায়?
আমি প্রায়ই ভাবি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ 'পার্বত্য চট্টগ্রাম' নিয়ে তথাকথিত 'সুশীল সমাজের' এত আগ্রহ কেন? তারা প্রায়শই এমন ধরনের বক্তব্য রাখেন যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম মোটেই কোন বিরোধপূর্ণ এলাকা নয়। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে যেমন বেশকিছু বিরোধপূর্ণ এলাকা আছে, বাংলাদেশে তেমন একটিও নেই। ভারতের রয়েছে কাশ্মীর এবং অসম, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডসহ কিছু সংঘাতপূর্ণ এলাকা; তেমনি পাকিস্তানের আছে বেলুচিসত্মান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কিছু বিক্ষুব্ধ ও বিরোধপূর্ণ এলাকা। ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে প্রায়শই তাদের এসব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সেনা অভিযান চালাতে হয়। বাংলাদেশে পশ্চিমা কোন কোন দেশ ও কয়েকটি এনজিও প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে থাকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সচেতনতা ও প্রাজ্ঞতার অভাবের কারণে এভাবে পশ্চিমা দেশসমূহ 'সুশীল সমাজ' ও এনজিওদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নাক গলাতে সাহসী হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উচিত সমগ্র দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া। রংপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ঢাকা, সিলেট যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; তেমনই পার্বত্য চট্টগ্রামও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে। এরা বৃহত্তর বাঙালী জাতিসত্তার অন্যতম বর্ণাঢ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই, খেয়াং, বমসহ নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। এরা বাঙালীর অতি আপন ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের বাদ দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের কথা ভাবাই যায় না। সাম্রাজ্যবাদী কয়েকটি দেশ ও তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু এনজিও সর্বদা '১৫ কোটি বাঙালীর' মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে তৎপর। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই'। এরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধ ও বিভাজন সৃষ্টিতে তৎপর।
ভাষাগত জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৫ কোটি বাঙালী ও অখ- বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এৰেত্রে আমাদের সত্তার অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজাতিকে আপন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা 'আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী' বইটি আমাদের এক সময় বাঙ্গালীত্বের সাধনায় ব্যাপকভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' বিষয়ক তত্ত্ব আমাকে খুবই উদ্বিগ্ন করেছিল। বাঙালীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী গবেষকদের এ ছিল এক অতিশয় সুপরিকল্পিত কৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় গ্রুপগুলোকে তবে কী নামে ডাকা যায়?
এক সময় গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হলো। ১৯৯৫ সালে পাক্ষিক 'শৈলীর' পৰে তাঁকে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলাম উত্তরায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। কথা প্রসঙ্গে 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বলেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়তাদের কী নামে ডাকা যায়?' আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তখনই জবাব দিয়েছিলেন, 'আদি বাঙালী।' 'ওরাই হলো আদি বাঙালী। এ ধরনের বহু উপজাতীয় গ্রুপের সংমিশ্রণে আজকের বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে।'
আগামীতে সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির বিজয় অবশ্যম্ভাবী। রূপময় পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের গৌরব। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক ও অভিন্ন। বিদেশীদের পরামর্শে যে কোন বিভাজনমূলক নীতি হবে আমাদের জন্যে আত্মঘাতী। সেখানে জমি ক্রয় ও আবাসনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় মানুষ সেখানে অবাধে বসবাসের সুযোগ পাবে। তেমনই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশের যে কোন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবে। নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণের পর একজন বাঙালী পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের চেয়েও সৌন্দর্যময় ও আকর্ষণীয়।' কেবলমাত্র পর্যটনের বিকাশের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে বাংদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ। এছাড়া এখানকার আনারস ও পেঁপে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজতকরণের মধ্য দিয়ে বিদেশে রফতানি করা যায়। আনারস থেকে জ্যাম ও জেলি তৈরির জন্য বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠতে পারে। বান্দরবান কিংবা রাঙ্গামাটিতে গড়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মানের একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জামায়াতে ইসলামী, শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে হবে। এ ব্যাপারে এতটুকু দেরি করলে চলবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এদেশের আদি বাঙালী ও বাঙালী সবারই গৌরবের ধন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর যেন পাহাড়ী-বাঙালী সংঘাতে এই এলাকার পবিত্র ভূমি কলঙ্কিত না হয়। আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি। মারমা কবি ক্যা শৈ প্রশ্ন রচিত একটি কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করি : 'জনসাধারণ, সকল শ্রমজীবী সুখী হোক/ সকল হৃদয় অপার আনন্দে উন্মোচিত হোক।'
No comments