ঈশ্বরদীর বৃষ্টি ও ফাহিমা এবং কালীগঞ্জের ঘটনা by নিয়ামত হোসেন

আমরা কোন্ সমাজে বাস করছি, বাস করছি কোন্ যুগে, দেশের সব তরম্নণ কি ঠিকভাবে মানুষ হচ্ছে? খবরের কাগজে কিছু কিছু বেদনাদায়ক, লজ্জাকর ঘটনার খবর জানতে পারলে এই ধরনের প্রশ্নগুলো সামনে আসে।
খবরগুলো শুধু লজ্জাকর এবং বেদনদায়কই নয়, চরম অপরাধমূলক। দেশের নানা স্থানের কিছু তরম্নণ, স্বাভাবিক তরম্নণ না বলে যাদের বিকৃত রম্নচির তরম্নণ বলতে হয়, তারাই এসব ঘটনা সৃষ্টি করে। সেসব ঘটনার পরিণতি অত্যনত্ম মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছায়। সেসব খবর সাধারণ মানুষের নজরে পড়লে সকলেরই মনে প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া হয় সেটা একটি মাত্র শব্দে প্রকাশ করা যায়। শব্দটি হচ্ছে_ ছিঃ! এর সঙ্গে সঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাতে মনে একটা দাবি ওঠে, সেটা হচ্ছে বিকৃত রম্নচির এই তরম্নণদের কঠোর এবং দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দেয়া হোক। যেহেতু ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে, আজ এখানে, কাল ওখানে, তাই ঐসব ঘটনার জন্য দায়ী তরম্নণদের এমন শাসত্মি প্রকাশ্য দেয়ার ব্যবস্থা হোক, যাতে এই ধরনের অপরাধ যারা করবে তাদের পিলে যেন চমকে যায় ভাল করে, যার ফলে সে ঠিক হয়ে যাবে। ঐ ধরনের ঘটনা ঘটানো দূরের কথা ঘটানোর পরিকল্পনা করার সময়ই দশ বার ভেবে নেবে।
বখাটেরা এখন তাদের অপরাধের কথা, এর পরিণতির কথা একদমই ভাবছে না। তারা মনে করে, যা তারা করছে তাতে কোন অপরাধ নেই, বরং আছে বীরত্ব। আছে বাহাদুরি! তাদের এসব অপরাধের জন্য একেকটা জীবন, একেকটা সম্ভাবনা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেটা তারা বুঝছে না। বোঝার মতো মগজও তাদের আছে কি-না সন্দেহ।
ঢাকার পিংকি নিজের জীবন শেষ করে দিল বাধ্য হয়ে। এছাড়া তার উপায় ছিল না। কেন তাকে মরতে হলো? তার মতো মেয়ের সামনে কত সম্ভাবনা। সে কেন মরতে যাবে? মরতে সে চায়নি। বাঁচার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তার বাঁচার আগ্রহ, ইচ্ছা কেউ ব্যর্থ করে দিয়েছে বলেই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায় তার। তাই তাকে বেছে নিতে হয় চিরবিদায়ের পথ। তার মৃতু্যর কথা যিনিই শুনেছেন, তিনি ব্যথিত না হয়ে পারেননি। এ ধরনের মৃতু্যর খবর যখনই কাগজে বের হয় তখন তা সমাজের অগণিত বিবেকবান মানুষের মনে আলোড়ন তোলে, সবাইকে ব্যথিত করে। এমন ঘটনা একটা ঘটার পর মানুষ প্রত্যাশা করে_ এটাই শেষ হোক। এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পিংকির ঘটনার খবর শোনার পর মানুষ এই প্রত্যাশাই করেছে। কিন্তু দেখা গেল, সে প্রত্যাশা সফল হয়নি। দেখা গেল আবার ঘটেছে ঐ ধরনেরই ঘটনা।
আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে আরও দুই কিশোরী। একজন বৃষ্টি, অন্যজন ফাহিমা। বৃষ্টির বয়স বারো। ফাহিমার পনেরো। বৃষ্টি পড়ত কাস সেভেনে। ফাহিমা কাস টেনে। ফাহিমা তৈরি হচ্ছে সামনের পরীৰার জন্য। জনকণ্ঠসহ অপরাপর দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এই দুই কিশোরীর মৃতু্য হয়েছে বখাটেদের উৎপাতে। মেধাবী ছাত্রী ওরা। পড়াশোনা করছিল। কোন অঘটন ঘটানোর মতো কোন বিপদও তাদের সামনে ছিল না। একই বয়সী অন্য ছাত্রছাত্রীদের মতোই তারা লেখাপড়ার মধ্যে ডুবে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এলো যেন বাজপাখির ছোবল। ছিনিয়ে নিয়ে গেল দুই নিষ্পাপ কিশোরীর জীবন।
জানা গেছে, এক বখাটে বৃষ্টিকে তাদের স্কুলের মাঠে বহু জনের সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। ঐ বখাটে অনেকদিন ধরে তার পিছনে লেগে ছিল। প্রায়ই তাকে বিরক্ত করত। সেদিন ঐ লাঞ্ছনার গস্নানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বৃষ্টি। ঠিক একেবারে কাছাকাছি সময়ে ঐ ঈশ্বরদীরই কাছাকাছি আরেক এলাকার আরেকটি ঘটনা। সে ঘটনায় জীবন দিতে হয় ফাহিমাকে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বখাটে এক তরম্নণ তাকে প্রায়ই বিরক্ত করত। একদিন সুযোগ পেয়ে ঐ তরম্নণ ও তার অন্য সহযোগীরা চরমভাবে শারীরিক লাঞ্ছনা করে। সে অপমান সহ্য করতে পারে না ফাহিমা। ৰোভ, দুঃখ এবং চরমতম অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সে বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে জীবনের প্রতি। তারপর শেষ করে দেয় নিজের জীবন।
প্রতিটি মানুষ জীবনকে ভালবাসে, মৃতু্যকে নয়। কিন্তু মানুষ যখন নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেয় তখন তার মনের অবস্থা কী রকম দাঁড়ায় সেটা সংশিস্নষ্ট ঐ মানুষটি ছাড়া আর কারও পৰে বোঝা সম্ভব নয়। তবে একটা বিষয় বোঝা যায়, ঐ সময় জীবনের ওপর প্রচ- অভিমান হয়। প্রচ- আবেগ কাজ করে মনে। সুন্দরভাবেই তো জীবনটা চলছিল। কিন্তু কেন এমন হলো? এই ভাবনাতেই অভিমান হয় জীবনের ওপর। জীবনের প্রতি ঘৃণাও আসে। নানা প্রতিক্রিয়া হয় মনে। কিন্তু কেন এমন হয়? কে এর জন্য দায়ী? ফাহিমা তার শেষ কথাগুলো লিখে গেছে তার ডায়েরিতে। সবাই জেনে গেছে তার বাঁচার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছিল কে বা কারা! বৃষ্টির ব্যাপারটাও সবাই জেনে গেছে। প্রতিবাদ উঠেছে তার মৃতু্যতে। তার স্কুলের সহপাঠী মেয়েরা বিচার দাবি করেছে। স্কুলের সবাই চাচ্ছে বখাটেদের বিচার। বৃষ্টির পরিবারের সবাই চাচ্ছে, এলাকার লোকজনও চাচ্ছে। ফাহিমার ব্যাপারেও তাই। ফাহিমার সহপাঠীরা, তার পরিবারের সবাই, তাকে যারা চিনত সবাই চাচ্ছে অপরাধী বখাটেদের বিচার হোক। সে বিচার কি হবে? বিচার হলে ফাহিমা ফিরে আসবে না, বৃষ্টিও ফিরে আসবে না। তারপরও বিচার হওয়া জরম্নরী। দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি হওয়া জরম্নরী। বৃষ্টি, ফাহিমা ফিরে আসবে না ঠিকই, কিন্তু ওদের মতো ভাগ্য আর কাউকে বরণ করতে না হয় যাতে, সেজন্য বখাটেদের কঠিন শাসত্মি হওয়া দরকার। ওদের পরিবারের সবার, ছাত্র-শিৰক, স্কুলের কর্মচারী এবং এলাকাবাসী সবারই দাবি অনুযায়ী বখাটেদের শাসত্মি হওয়া দরকার। দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ওদের শাসত্মি দরকার। অন্যের অধিকারের প্রতি যে সম্মান জানাতে হয় সেটা কিছু ব্যক্তিকে শেখানোর জন্যও বখাটেদের কঠোর শাসত্মি হওয়া দরকার।
মেয়েরা সমাজে ছেলেদের পাশাপাশি বড় হয়ে লেখাপড়া শিখবে। বখাটেরা সে পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কেউ মেয়েদের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে টিটকারী দিচ্ছে। কেউ শিস দিচ্ছে, কেউ কেউ অশস্নীল মনত্মব্য বা অঙ্গভঙ্গি করছে। আবার কেউ কেউ উঠছে আরও উপরে। প্রেম নিবেদন করে চিরকুট ছুড়ে মারছে। প্রেম করতে হবে বা বিয়ে করতে হবে_ এমন আবদার জানাচ্ছে স্কুলপড়ুয়া ঐসব শিশু কিশোরীর কাছে। তাদের আবদার না মানলে হুমকি দেয়া হচ্ছে_ তুলে নিয়ে যাওয়া হবে বা এ্যাসিড মারা হবে বা চরম গস্নানিকর কিছু করা হবে। মেয়েরা এসব দেখে ভয়ে তটস্থ থাকে। তাদের অভিভাবকদের কানে এসব গেলে তাঁরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন।
মেয়েদের বাবা-মায়েরা চান তাঁদের সনত্মান লেখাপড়া শিখুক, স্কুল-কলেজে যাক। কিন্তু তাদের সনত্মান অপহৃত হোক, এ্যাসিডে দগ্ধ হোক_ এটা কি কোন বাবা-মা চাইবেন? চাইবেন না। অতএব ভয়ে ওদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তারপরও ওঁৎ পেতে থাকে বখাটেরা। কেউ কেউ বাড়িতে এসে পর্যনত্ম চড়াও হয়। নানাভাবে হুমকি পাঠায়। ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে যেন এটা মগের মুলস্নুক। বখাটেরা যা খুশি তাই করতে পারবে! দেখার কেউ নেই, বলার কেউ নেই! অভিভাবকরা ভয় পান। তাঁদের মান-ইজ্জতের ভয় আছে। তাঁদের পাশে সবাই থাকলেও তাঁরা সংঘবদ্ধ নন। ওদিকে বখাটেপনা বা সন্ত্রাস দেশের আনাচে কানাচে যে পর্যনত্ম পেঁৗছে গেছে পুলিশের নেটওয়ার্ক অত দূরে পেঁৗছেছে তা বলা যাবে না। মাঝে শোনা গেছে, পুলিশ বিভিন্ন স্থানে এ্যাকশন নিয়েছে। মেয়েদের কোন স্কুলের সামনে বখাটে ছেলেদের ভিড় দেখলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সে ভিড় ভেঙ্গে দিয়েছে। আরও কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেসবে যে পুরোপুরি কাজ হয়েছে বলা যাবে না। আবার এও সত্য, পুলিশের তৎপরতা দেশের সব জায়গায় পেঁৗছেনি বলেই অনেক জায়গায় বখাটেদের দাপট চরমে উঠেছে। ঠিক এমনই একটা খবর বেরিয়েছে জনকণ্ঠে। সাতৰীরার কালীগঞ্জ উপজেলার এক স্কুলের মেয়েদের কাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে বখাটেদের জ্বালায়। বখাটেরা শুধু টিটকারিই মারছে না, কেউ কেউ হুমকিও দিচ্ছে। অভিভাবকরাও ভয়ে মুখ খুলছেন না তাদের বিরম্নদ্ধে। এই অবস্থায় ঐ স্কুলের কয়েক ছাত্রী সাতৰীরা প্রেসকাবে এসে সেখানে এবং সেখানকার স্থানীয় এক দৈনিকের সম্পাদকের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছে। তারা তাদের জীবন ও ইজ্জত ভিৰা করেছে। তারা জানিয়েছে, তারা যদি সুন্দরভাবে লেখাপড়া করার সুযোগ না পায় তাহলে বখাটেদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লিখে রেখে যাবে এবং ওরা একই সঙ্গে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে।
স্কুলের মেয়েরা কতখানি অসহায় হলে, কতখানি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়লে এভাবে বলতে পারে তা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। এখন ওরা কী করবে? নীরবে মুখ বন্ধ করে বখাটেদের দ্বারা অপমানিত হতে থাকবে, নাকি লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে? বৃষ্টি জীবন দিয়ে গেল, জীবন দিয়ে গেল ফাহিমা। এর আগে জীবন দিয়ে গেছে তৃষ্ণা, রম্নমি, সিমি, ইন্দ্রানী এবং আরও অনেক বালিকা, কিশোরী। কালীগঞ্জ উপজেলার ঐ মেয়েদের কি বাঁচার অধিকার নেই, লেখাপড়ার অধিকার নেই; সমাজে নিরাপদে চলার অধিকার নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এ অধিকার কে নিশ্চিত করবে? বখাটে, অপরাধী, সন্ত্রাসীদের বিরম্নদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধেরও দরকার রয়েছে খুব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী কর্তৃপৰের দায়িত্ব তো এখানে কম নয়। কালীগঞ্জের ঐ ঐলাকায় যা ঘটছে বলে জানা গেল সেটা তো অরাজকতারই নামানত্মর। সেই অবস্থায় সংশিস্নষ্ট কর্তৃপৰেরই হাত পেঁৗছানো যে জরম্নরী তাতে কি সন্দেহ আছে?

No comments

Powered by Blogger.