রিপোর্টারের ডায়েরি- জেনেভার সফল মিশন

২ ডিসেম্বর, বুধবার। শেষ হয়ে যাচ্ছে তিন দিনের বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন। বিকাল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠান। সকালে জেনেভাস্থ জাতিসংঘ সদর দফতর ঘুরেছি। শেষ দিন সম্মেলন কেন্দ্রে ঢোকার পথে গেলাম বিশ্বায়নবিরোধীদের আসত্মানায়।
মাঠের মধ্যে বৃষ্টিতে কাদাকার অবস্থা। দুপুর হয়ে যাওয়ায় তারা এখন মধ্যাহ্নভোজে ব্যসত্ম। অনেকেই ঘুরে ঘুরে দেখছে তাদের প্রদর্শনীগুলো। আমরা একটু ঘুরেই রাসত্মা পার হয়ে চলে এলাম কনভেনশন সেন্টারে। জেনেভা আনত্মর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম নিরাপত্তা আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যারিকেড যাতে সমাপনী দিনে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। তাই বলে রাসত্মার উপরে বিশ্বায়নবিরোধীদের অবস্থান ঠিকই রয়েছে। রয়েছে তাদের তাঁবু। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর মতো 'মাথাব্যথা হয়েছে বলে মাথাই কেটে ফেলেনি।' ২০০৫ সালে ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় কারফিউ জারি করেছিল। ঢাকা শেরাটন হোটেলে ওই সম্মেলন অনুষ্ঠানের কারণে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যনত্ম ওই কারফিউ জারি করা হয়। এ ধরনের উদ্ভট নিরাপত্তা ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখা যায়নি।
আমাদেরও নিত্যদিনকার মতো লাইন ধরে ঢুকতে হলো। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে কোন বাড়াবাড়ি নেই। আমরা তিন জন একসঙ্গে ঢুকলাম। আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে দেখলাম তখনও আমাদের অপর সহকর্মীরা কেউ আসেনি। আমি দ্রম্নত ল্যাপটপ চালু করে আমার আগের দিনে লেখা রিপোর্টটা ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিলাম। কারণ সমাপনী অনুষ্ঠান ঢাকার কাগজে ধরানো যাবে না। তবে সমাপনী অনুষ্ঠানের রিপোর্ট লিখে রাতেই ঢাকায় মেইল করতে হবে। কাল সকালে আমরা জুরিখ চলে যাব। রাতে ইকোনমিক মিনিস্টারের বাসায় দাওয়াত আছে।
বিকালে সমাপনী অনুষ্ঠান। তাই সবাই একটু দেরি করেই কনভেনশন সেন্টারে ঢুকছে। এনটিভির মিরাজ আহমেদ চৌধুরী এসে জানাল তার অভিজ্ঞতার কথা। ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ঢোকার সময় এক সুইস পুলিশ জানতে চায় সে কোন্ দেশ থেকে এসেছে? বাংলাদেশ শুনে ওই পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি শেখ মুজিবের দেশ থেকে এসেছ? মিরাজ তাকে বলে, তুমি শেখ মুজিবকে চেন কিভাবে? বয়স্ক ওই পুলিশ বলে, 'শেখ মুজিব একজন মহান নেতা। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে তোমাদের দেশটা স্বাধীন করেছেন।' এক সুইস পুলিশের মুখে বাংলাদেশের জাতির জনকের কথা শুনে মিরাজ বেশ উৎফুলস্ন। তার ওই আনন্দের কথা জানাতে আমাদের সঙ্গে অংশীদার করার জন্য দৌড়ে এসেছে।
শেষ দিনে কাজের চাপ কম। সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘোরাঘুরি করছে। এক একজন এক এক উদ্দেশ্যে ঘুরলেও আমাদের ইনকিলাবের বাবলু সর্বদা ঘুরছে ডকুমেন্ট সংগ্রহের জন্য। আনত্মর্জাতিক বা বিশ্ব সম্মেলনগুলোর সুবিধা হচ্ছে, এ সকল সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রচুর কাগজপত্রের রিপোর্ট পাওয়া যায়। যে কারও দেখলে সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হয়। আমরাও অল্প বিসত্মর সংগ্রহ করি। ওজনের কারণে দেশে নিয়ে যাওয়ার একটা ঝামেলা আছে। কিন্তু বাবলু সেদিকে তাকায় না। প্রতিদিন সে বসত্মা বসত্মা কাগজ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় হোটেলে। এরই মাঝে আমার দেশ-এর দিলাল এসে বলল, কাওসার ভাই, খবর খারাপ। আমি জানতে চাই, কী খারাপ খবর? সে বলল, আমার এক পায়ের জুতার তলা সম্পূর্ণ খুলে গেছে। আমিও চিনত্মত্মায় পড়ে গেলাম। কী করা যায়? জুতা কেনা ছাড়া কোন উপায় নেই। আবার জেনেভার মতো জায়গায় জুতা কিনতে গেলে কত ফ্রাঁ যে গচ্চা যাবে সেটাও চিনত্মার মূল কারণ। এই সমস্যা ঘটতে পারে, সেটা আমি আগেই আশঙ্কা করেছিলাম। বাংলাদেশ থেকেই অভিজ্ঞরা বলেছিলেন, শীতের দেশগুলোতে আমাদের দেশের জুতার তলা খুলে যায়। শীতের আবহাওয়ার কারণে আঠা জমে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ কারণে আমি ঢাকা থেকে আসার আগে সোলের সঙ্গে উপরের অংশ সেলাই করা এমন জুতা পরে এসেছি। এ যাত্রায় অন্যরা রেহাই পেলেও শেষ দিনে এসে দিলাল বড় অঙ্কের টাকা গচ্চার মধ্যে পড়ে গেল।
জুতার তলা নিয়ে গবেষণার করার সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আসলেন। তাঁকে ঘটনাটা খুলে বলায় তিনি বললেন, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে পাশেই এক জায়গায় অল্প টাকায় জুতা পাওয়া যায়। ৩০-৪০ ফ্রাঁ হলে ভাল জুতা পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে দিলাল তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ছুটল জুতা কিনতে। তবে যাওয়ার সময় তার সোল নিয়ে যেতে পারেনি। সেটি আমাদের কাছেই পড়ে রইল।
বিকালে সমাপনী অনুষ্ঠান শুরম্ন হবে। তার আগেই উপর থেকে মিছিলের আওয়াজ আসছে। দ্রম্নত উপরে উঠে এলাম। সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা মূল হলে যাচ্ছেন। চারদিকে লোকে গিজগিজ করছে। এ সময় বিশ্বায়নবিরোধীরা সেস্নাগান দিচ্ছে_ 'ডবিস্নউটিও চেঞ্জ অর ভ্যানিশ। আওয়ার ওয়ার্ল্ড নট ফর সেল।' অর্ধ শতাধিক কর্মী গোল হয়ে গানের সুরে সুরে এ সেস্নাগানগুলো গেয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পুলিশ তাদের ঘিরে রেখেছে। ফটো সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা সেগুলো তাদের ক্যামেরায় ধারণ করছে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ঘিরে ধরে সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে যায়। প্রতিবাদকারীরাও শানত্মিপূর্ণভাবে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে যায়।
পাঁচটার সমাপনী অনুষ্ঠান শুরম্ন হলো ৫টা ২০ মিনিটে। সংপ্তি অনুষ্ঠান। মঞ্চে শুধু কনফারেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আন্দ্রেজ ভেলাসকো এবং মহাপরিচালক প্যাসকেল লামি। চেয়ারম্যান পুরো সম্মেলনের ওপর একটি সারসংপে তুলে ধরে বক্তৃতা করলেন। তাঁর বক্তৃতায় আমাদের কয়েকটি ইসু্যও ঠাঁই পেল। মহাপরিচালক পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণ দিলেন। সমাপনী অনুষ্ঠানের পর পরই তাঁরা প্রেস কনফারেন্সে হাজির হলেন। তাঁদের সঙ্গে আসলেন ডবিস্নউটিও'র মুখপাত্র কিথ রকওয়েল। তাঁরা দাবি করেন একটি ফলপসূ ও সফল সম্মেলন হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাংবাদিক সম্মেলনের পর পরই প্রেস ব্রিফিং করতে এলেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কিরক। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী দ্বিপাকিভাবে বাজার উন্মুক্ত করার সিদ্ধানত্ম নিয়েছে। ওবামা প্রশাসন গরিব দেশগুলোর জন্য কিছু করতে চায়। এ সময় আমাদের তানিম আহমেদ প্রশ্ন করলেন, যুক্তরাষ্ট্র গরিব দেশগুলোকে সাহায্য করতে চায়। অথচ বাংলাদেশকে মার্কিন বাজারে ঢুকতে বিপুল পরিমাণ শুল্ক দিতে হচ্ছে। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিরক জানালেন, বাংলাদেশ যে বিপুল পরিমাণ শুল্ক দিচ্ছে তা তাঁর জানা নেই। কৃষি ভর্তুকির ব্যাপারেও তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। তবে ওবামা চান দোহা রাউন্ডের সফল সমাপ্তি এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থবহ বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে।
দুই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে দ্রম্নত ছুটলাম নিচে। কারণ নিউজ লিখে ঢাকায় মেইল করে বের হতে হবে। এ কাজ করতে হবে রাত ১১টার মধ্যে। কারণ ১১টায় মিডিয়া সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। তার ওপর রাতে ইকোনমিক মিনিস্টারের বাসায় দাওয়াত আছে। নিচে নেমে দ্রম্নত নিউজ লিখতে বসলাম। চারদিকে ভাঙ্গা হাটের মতো অবস্থা। সবাই চলে যাচ্ছে। কিছুণ পর দিলাল আর বাংলাদেশ দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ফিরে এলেন। ৪০ ফ্রাঁতে জুতা পাওয়া যায়নি। ৮০ ফ্রাঁ দিয়ে জুতা কিনেছে। সঙ্গে একটি সিমসহ মোবাইল সেটও কিনে নিয়ে এসেছে। দিলালের পায়ের সমস্যার সমাধান হলো। কিন্তু ওই কর্মকর্তার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাদেরকে কাজ শেষ হলে ইকোনমিক মিনিস্টারের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা তাঁকে জানালাম, আজ দেরি হবে। কারণ সবাই নিউজ লিখে ঢাকায় মেইল করে তবে যাবে। কারণ কাল সকালে অনেকেই এই ব্যয়বহুল শহর ছেড়ে চলে যাবে। তিনি বসতে রাজি হলেন।
রাত ১০টার মধ্যে আমার লেখা শেষ হলো। আমি মেইল করে দিলাম। অনেকের তখনও বাকি। এদিকে দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা তাড়া দিচ্ছেন। বললাম, যাদের কাজ হয়েছে তাদের এক গ্রম্নপ নিয়ে চলে যান। সবাই একসঙ্গে যাবে। এ কারণে যাদের লেখা শেষ হয়েছে তারা অপো করতে লাগল। তিনিও অপো করলেন। এদিকে ১০টার পর থেকে মাইকে ঘোষণা আসতে লাগল, ১১টার মধ্যে মিডিয়া সেন্টার ছেড়ে দিতে হবে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সকলের কাজ শেষ হলো। একটি সফল মিশন শেষে সবাই আয়েশ করে বেরিয়ে আসলাম। বাইরে আগের চেয়ে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হলো। পুরো সম্মেলন কেন্দ্র ফাঁকা হয়ে গেছে। বাইরে এসে কেউ কেউ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সপ্তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের লোগোর সামনে ছবি তুলল। দল বেঁধে গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় সুইস পুলিশরা আমাদের বিদায় জানালেন। আমরাও হাসিমুখে তাদের বিদায় সম্ভাষণ গ্রহণ করলাম।
ইকোনমিক মিনিস্টারের বাসা লেকের ওপারে। রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকে আরও ভেতরে। তবে রাসত্মা ফাঁকা। বেশি সময় লাগল না। আমরা যখন তাঁর বাসায় গিয়ে পেঁৗছি তখন বাণিজ্যমন্ত্রী ও অন্য অতিথিদের খাওয়া শেষ। আমাদের জন্য তাঁরা অপো করছিলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী ও মেয়ে আমাদের যত্ন করে খাওয়ালেন। তাঁদের বদৌলতে দেশীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করলাম। বিদায় নিয়ে আমরা যখন বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম তখন মনে হলো শীতের তীব্রতা আরও বেড়েছে।
_কাওসার রহমান

ঘন কুয়াশায় যমুনাপারে
৯ জানুয়ারি, শনিবার। সকালে ঘন কুয়াশায় সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ এবং উত্তরের বাতাসে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে যমুনাপারের শহর সিরাজগঞ্জের মানুষ। তারপরও সকাল ১০টায় বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গোলাম যমুনাপারে পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিসে। গোটা শরীর শীতের কাপড়ে জড়িয়েও ঠা-া থেকে নিসত্মার পাওয়া যাচ্ছে না। অফিসে বসে আছেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম। আগের দিনই কথা হয়েছিল ক'জন সাংবাদিককে সাথে নিয়ে তিনি যমুনাপারের তীর সংরৰণ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সরেজমিন দেখতে যাবেন। এরই মধ্যে উপস্থিত হলেন আরও দু'জন সাংবাদিক। ১১টায় অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে রওনা হলাম যমুনাপারের তীর সংরৰণ প্রকল্পের কাজ দেখার উদ্দেশ্যে। সাড়ে ৮ কি.মি. দীর্ঘ এ প্রকল্পের ২ কি.মি. পথ পেরিয়ে মোটর কার ছেড়ে রওনা হলাম মোটরসাইকেলে। নদীর পার ঘেঁষে হাতের বামে গ্রাম-জনপদ আর ডানে যমুনা নদী। শুকনো মৌসুমে নদী যেন শুধুই বালুচর। নদীপারে যেখানে যেমন আছে সেখানে নদীর তলদেশের ৯০ ফুট এলাকা পর্যনত্ম সি.সি. বস্নক দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। উপরে ৬ ফুট পরিমাণ এলাকা সি.সি. বস্নক দিয়ে রাসত্মাও তৈরি করা হয়েছে। দেখতেও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পরিবেশও মনোরম। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখারও একটি নিরিবিলি স্থান। যতদূর দেখা যায় শুধুই বালিয়াড়ি। আবার কোথাও দিগনত্মজোড়া সবুজের সমারোহ। মাঝেমধ্যে এঁকেবেঁকে চলেছে নদী। প্রমত্তা যমুনা যেন মরে গেছে এই শুকনো মৌসুমে তীর সংরৰণ প্রকল্প এলাকায়। রাণীগ্রাম, গুনেরগাঁতি, খোকসাবাড়ি, পাচিল, দিয়ারপাচিল, ভাটপিয়ারি পর্যনত্ম প্রায় ৯ কি.মি. এলাকাজুড়ে সর্বত্রই একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুরো প্রকল্প ঘুরে দেখে মনে হয়েছে দেশের প্রকৌশলীরাও আনত্মরিকতার সাথে কাজ করলে তা ভাল কাজ হতে পারে এবং এরও সুফল পাওয়া যায়। এর পর একই পথে ফিরে এলাম সিরাজগঞ্জ শহরে। ততৰণে শীতের দাপটে জড়োসড়ো হয়ে উঠেছি। তারপরও কষ্ট করে দিনের রিপোর্টটি পাঠিয়ে দিলাম অফিসে। তখন সন্ধ্যা ৬টা।
_বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

ডিআরইউ পিকনিক
২২ জানুয়ারি, শুক্রবার। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) বার্ষিক পিকনিক। স্পট গাজীপুরের সাবাহ গার্ডেন। আগে কখনও এই পিকনিকে যাইনি আমি। প্রথমবারের মতো পিকনিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ আগের রাতে ১১টায় শুয়ে পড়লাম আমরা সকলেই। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে ডিআরইউ থেকে গাড়ি ছেড়ে যাবে। ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে রেডি হতে সোয়া ৭টা বেজে গেল। বেরিয়ে পড়লাম আর এক সমস্যায়। শুক্রবার সকালে কিছুই পেলাম না ডিআরইউতে পেঁৗছতে। রাসত্মায় দাঁড়িয়ে ফোন করলাম পিকনিক আয়োজক কমিটির সদস্য আমাদের সময়ের সচিব শফিকুল ইসলামকে। আমার অবস্থা জানতে তিনি বললেন ফার্মগেটে পুলিশ বক্সের সামনে এসে দাঁড়াতে। পেয়ে গেলাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের এক এ্যাম্বুলেন্স চালককে। অনুরোধে সে আমাদের নামিয়ে দিল ফার্মগেটের পুলিশ বক্সের সামনে। বাসের জন্য রাসত্মায় দাঁড়িয়ে অপেৰা করতে লাগলাম আমার স্ত্রী টুলু রানী, তার বোন বুলু রানী এবং আমাদের একমাত্র সনত্মান অয়ন বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আমি। রাসত্মায় দাঁড়াতেও কিছুটা বিপত্তিতে পড়লাম। টঙ্গীতে শুরম্ন হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। রাসত্মার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টঙ্গীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসগুলো আমাদের তুলতে একে একে ব্যসত্ম হয়ে পড়ছে। কিছুৰণ পর আমাদের কাঙ্ৰিত বাসটি এসে হাজির। হেলপারের ডাকে প্রথমে মনে হলো এটাও বোধ হয় ইজতেমার উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাস। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় শফিক ভাইয়ের কথায় বুঝলাম এটা আমাদেরই বাস। সকাল সোয়া ৮টায় উঠে জানলাম এটাই প্রথম বাস। বাস চলছে। চলছে গান। বাসে উঠে দেখি সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক যুগানত্মর পত্রিকার। কিছুৰণ পরে আমি প্রশ্ন করে বসলাম, এটা কি যুগানত্মরের জন্য স্পেশাল বাস? যুগানত্মরের হুসাইন জাকির প্রথমে মানতে নারাজ। পরে অবশ্য দেখে বলে বসল ঠিকই তো। এর পর শুরম্ন হলো হুসাইন জাকিরের চুটকি। যুগানত্মরের স্বপন দাসগুপ্তকে (স্বপনদা) নিয়ে হুসাইন কয়েকবার গান শুরম্ন করল। গানের শুরম্নতে 'ও স্বপন দা'... বলে গান ধরলে স্বপনদা বৌদির পাশে বসা সিট থেকে উঠে এসে হুসাইন জাকির ও আমার কাছে এসে বসল। হুসাইন আমার পাশে বসে যেভাবে পান খেতে লাগল দেখে আমি তাকে প্রশ্নই করে বসলাম, এত পান তুমি কোথা থেকে বের করছ? জবাব দিল, বাসে ওঠার আগে ২০টি খিলি পান নিয়ে উঠেছি। সঙ্গত কারণে আমি জানতে চাইলাম দিনে তার কয় খিলি পান লাগে। তৎৰণাৎ জানাল, তা প্রায় এক শ' খিলি পান লাগে।
খিলৰেতে এসে এক পেট্রোল পাম্প থেকে আমাদের বাসটি ডিজেল নিল। একটু সামনে এগিয়ে অপেৰা করতে লাগলাম আমাদের অপর এক সাংবাদিক বন্ধুর জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি তাঁর শিশু পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে এসে বাসে উঠলেন। নির্ধারিত সাংবাদিক বন্ধু বাসে ওঠার পরও বাস আর ছাড়ে না। তখন সবার সঙ্গে অমিও খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলাম। উঠে এসে শুনলাম ডিআরইউ-এর সাবেক জেনালের সেক্রেটারি ইলিয়াস খান ফোন করে বাসটিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তাঁর ছেলের জন্য নাসত্মার প্যাকেট নেয়ার লৰ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা বাসটিকে তিনি দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ২০/২৫ মিনিট অপেৰার পর একজন সাংবাদিক বলে বসলেন, কয়টা প্যাকেট লাগবে জেনে রাসত্মার পাশের এই বকুল গাছে নাসত্মার প্যাকেট ঝুলিয়ে রেখে গেলেই হয়। এ সুযোগে আরও কেউ কেউ ব্যঙ্গাত্মক কথা বলতে শুরম্ন করলেন। একটু পরেই নিজস্ব গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন সাবেক সেক্রেটারি ইলিয়াস খান। তাঁর গাড়িতে পাঁচটি প্যাকেটও তুলে দেয়া হলো। এবার চলার পালা। এদিকে বিশ্ব ইজতেমা শুরম্ন। বাসটি এগিয়ে চলেছে এয়ারপোর্ট পার হয়ে উত্তরা দিয়ে টঙ্গীর দিকে। টঙ্গী ব্রিজের কাছে গিয়ে শুরম্ন হলো জ্যাম। তবে এই জ্যাম ছিল সামান্য। সকালে তখনও ইজতেমার জ্যাম লাগেনি। টঙ্গী এলাকায় হাল্কা জ্যামের মধ্যে চোখে পড়ল পথিক ফিলিং স্টেশন। বাসে বসে আমি বলে উঠলাম_ আরে, আমাদের ডিআরইউ-এর সেক্রেটারির ফিলিং স্টেশন থাকতে আমরা কেন অন্য জায়গা থেকে ডিজেল নিলাম! সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কুদরত-ই-খুদা ভাই (আমাদের সময়) বলে উঠলেন, তাই নাকি! এটি কি আমাদের সেক্রেটারির পেট্্েরাল পাম্প? রসিকতাটা অন্যদিকে যাচ্ছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, তা ঠিক বলতে পারব না। তবে নাম দেখলাম পথিক ফিলিং স্টেশন। এভাবেই চলছি আমরা। রাসত্মায় কোথাও জ্যাম, আবার কোথাও ফাঁকা। গাজীপুর চৌরাসত্মা মোড় পার হয়ে একজন বলল, আর মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। এর পর আমরা চলছি শালবন চিরে। রাসত্মার দুই দিকে সারি সারি শালবন দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে, প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সাজিয়ে তুলেছে এই বৃৰরাজিকে। সারি সারি গাছগুলো দেখতেও খুব পরিপাটি লাগছে। নিচে দিয়ে পায়েচলা পথ বয়ে গেছে। এভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতে করতে চলেছি গনত্মব্যের উদ্দেশে। প্রায় ১৫ মিনিট চলার পর ওই সাংবাদিকই আবার জানালেন, আর মাত্র এক মিনিটের পথ বাকি আছে। এই বলার কিছুৰণের মধ্যে আমরা ডান দিকে ঢুকলাম শালবনের মধ্য দিয়ে। এবার আরও বনের মধ্যে ঢুকে চলেছি। তখন মনে হচ্ছে সুন্দরবনের কেওড়া বনের কথা। মনে হচ্ছে, আমরা বোধ হয় ঘন কেওড়া বনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীতে ট্রলারে করে চলেছি। গাছগাছালির সবুজের মাঝে যেন হারিয়ে যেতে বসেছি আমরা। একটু এগুতেই সামনে সাইনবোর্ড চোখে পড়ল 'সাবাহ গার্ডেন।' আমাদের টিম লিডার বললেন, গনত্ম্যব্যে পেঁৗছে গেছি আমরা। আপনারা নেমে দেখবেন ডাইনে-বামে বিভিন্ন কটেজ রয়েছে। যার প্রয়োজন হয় বিশ্রাম নিন। ফেরার সময় যে বাসে এসেছেন সেই বাসে উঠবেন। আমাদের বাস নম্বর হলো ১০। আমরা একে একে ঢুকলাম গাজীপুরের সাবাহ গার্ডেনে।
_তপন বিশ্বাস

No comments

Powered by Blogger.