শপথ ও বিদায়- * 'বিচারপতিদের সম্পদের হিসেব দেয়া উচিত'- * 'স্বপ্ন দেখি ডিজিটাল বিচার বিভাগের' by বিকাশ দত্ত

বেলা গেল কোন ৰণে, বাজিল ছুটির ঘণ্টা ওপারে সুদূর প্রাঙ্গণে" কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতায় লাইনটি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আইনজীবী ও বিচারপতিদের।
রবিবার সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে যেমন আনন্দখন পরিবেশ বিরাজ করে তেমনি নেমে আসে বেদনাবিধুর পরিবেশ। প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামকে দেয়া হয় বিদায় সংবর্ধনা। আজ নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেবেন মোহাম্মদ ফজলুল করিম। একদিকে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামকে বিদায় অন্যদিকে নতুন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে অভিনন্দন জানাতে আইনজীবী সুপ্রীমকোর্টের কর্মকর্তা ছিল সারাদিন ব্যসত্ম। এরই মধ্যে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ও নতুন প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। এর আগে নতুন কোন প্রধান বিচারপতি এভাবে মিডিয়ার সামনে আসেননি।
বর্তমান মহাজোট সরকার প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কোন অনিয়ম করেনি। আপীল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। যদিও তার আগে চারবার মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপতি করা হয়। যাদেরকে প্রধান বিচারপতি করা হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি কে এম হাসান, বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির, বিচারপতি এম এম রম্নহুল আমীন ও বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম। সে কারণেই এবার বিচারপতি, আইনজীবী থেকে শুরম্ন করে সবার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল, এবার কি হবে?
সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকেই দেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। এই নিয়োগের ফলে খোদ বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদেরকেও চমক দেখিয়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি। এমন ঘটনা ঘটবে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, নিয়ম মেনেই সরকার এ ধরনের সিদ্ধানত্ম নিয়েছে। সরকার কোন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায়নি। এতে কাজের গতি বাড়বে।
নতুন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম
নতুন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম রবিবার তার চেম্বারে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, বিচার পেতে এসে কেউ যাতে অবিচারের শিকার না হয় সেটা দেখব। ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে আদালতে এসে যদি কেউ হতাশা নিযে ত্যাগ করে তা হলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর চেষ্টা চালিয়ে যাবো, স্বল্প সময় ও স্বল্প টাকায় যাতে জনগণ বিচার পায়। বিচারপতিদের সম্পদের হিসাব দেয়া উচিত কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে নতুন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, স্বচ্ছতার জন্য বিচারপতিদের সম্পদের হিসেব দেয়া উচিত। ভারতসহ অনেক দেশেই এ নিয়ম রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের যে ১৯জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়, সে প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসএম রম্নহুল আমীন নোয়াখালী বারে বলেছিলেন, মহা প্রলয় হয়ে গেছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন দিন দেখিনি, এখন খতিয়ে দেখব।
দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম কাজ কি হবে? এর উত্তরে নতুন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, এখানে কিছু অনিয়ম রয়েছে। সে সমস্যাগুলো সমাধান করা। আমি ম্যাজিক দেখাতে পারব না। তবে যাতে সুবিচার হয় সে ব্যবস্থা করব। বিচারপতিদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে বলেন, বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি আগেই তুলে ধরা হয়েছে। কর্তৃপৰ অচিরেই বিষয়টি দেখবেন। এতদিন দায়িত্ব ছিল না। দায়িত্ব নেবার পর সব বিষয়ে চিনত্মা করব। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ নেব। সব শেষে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মামলা চলাকালীন সময়ে নিউজ করা থেকে বিরত থাকাই ভাল। যাতে ন্যায় বিচার পেতে কোন সমস্যা না হয়। যাতে আমরাও বিব্রত বোধ না করি।

বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মামলা দ্রম্নত এবং দৰতার সঙ্গে নিষ্পত্তি করতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হয়, আমিও স্বপ্ন দেখি। নবীন আইনজীবীরা ল্যাপটপ নিয়ে মামলা প্রসেস করবে। বিচারপতিরাও এক সময় ল্যাপটপ নিয়ে বিচার কাজ সম্পন্ন করবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বিচার বিভাগকে আধুনিকতার আওতায় আনতে হবে।
বিচারপতিগণ জনগণের হয়ে কাজ করে। তাদের নিজস্ব ৰমতা নেই। জনগণের ৰমতাই ৰমতাবান। জনগণ চায় দ্রম্নততার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তি হোক। দেশকে এগিয়ে নিতে বিচারপতি, আইনজীবীর পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিশাল ভূমিকাও রয়েছে। বিশ্বয়ায়নের যুগে সব কাজকর্ম এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের গ্রামের মহিলারা এক সময় বোতাম টিপে দেখতে পারবে তার মামলা কি পর্যায়ে আছে।
অবসরে তিনি কি করবেন? এর উত্তরে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম বলেন, আমার জীবনটা কাটবে পড়াশুনা করে। আমার কিছু হবি আছে। তার পাশাপাশি বই লিখব, পড়ব।

বিদায়ী সংবর্ধনা
রবিবার বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামকে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির পৰ থেকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়। ১ নম্বর বিচার কৰে এই সংবর্ধনা দেয়া হয়। সকাল ১১টায় বিদায় সংবর্ধনা শুরম্ন হয়। আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সকল আইনজীবী, সিনিয়র আইনজীবীগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এবারই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। বিচারপতি থেকে শুরম্ন করে আইনজীবীদের অনেকেরই চোখ অশ্রম্ন সিক্ত হয়ে উঠে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিন বক্তব্য রাখেন। এরপর বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম বক্তব্য দেন। বিদায় সংবর্ধনা শেষে মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির দু'টি হল রম্নমে গিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পাশাপাশি সিনিয়র আইনজীবীদের চেম্বারে গিয়েও কুশল বিনিময় করেন।

এ্যাটর্নি জেনারেল
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিদায় সংবর্ধনায় বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে মোঃ তাফাজ্জাল হোসেন স্বল্প সময় ছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর শপথ নেয়ার পর মাত্র ২৬ কার্যদিবস পেয়েছিলেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিচার বিভাগের ইতিহাসের দু'টি গুরম্নত্বপূর্ণ মামলার পৌরহিত্য করেন। একটি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রিভিউ পিটিশনের শুনানি অপরটি সংবিধানের ৫ম সংশোধনী মামলার দু'টি লীভ পিটিশনের শুনানি। দু'টি মামলাই আইনের ইতিহাসে মাইলফলক মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। সামছুন্নাহার হলের ছাত্রী নিপীড়ণের ঘটনার তদনত্ম কমিশনের প্রধান হিসেবে বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেৰ, স্বচ্ছ ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির সাৰাত
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে দেশের বিচার ব্যবস্থা ডিজিটাল করণের ওপর গুরম্নত্ব আরোপ করেছেন। রবিবার বঙ্গভবনে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম তাঁর শেষ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদায়ী সাৰাত করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠককালে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন যে, তিনি বিচার ব্যবস্থা ডিজিটাল করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তনের পর আইনজীবীরা তাদের নিজস্ব কম্পিউটার থেকে তাদের মামলার কার্যতালিকা জানতে পারবেন বলে তিনি উলেস্নখ করেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আশা পোষণ করেন যে, বিচার ব্যবস্থায় ই-গবর্নেন্স চালু হলে ঝুলে থাকা মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস পাবে। রাষ্ট্রপতি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্টায় বিদায়ী প্রধান বিচারপতির ভূমিকার প্রশংসা করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমের সংশিস্নষ্ট সচিবগণ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান বিচারপতির শপথ
আজ সোমবার সকাল ১১টায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে মোহাম্মদ ফজলুল করিম শপথ গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান বঙ্গভবনে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে শপথ বাক্য পাঠ করবেন। উলেস্নখ্য রাষ্ট্রপতি (সংবিধানের ৯৫ ৯১) ধারা অনুযায়ী আপীল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

No comments

Powered by Blogger.