ফের উত্তপ্ত হতে পারে রাজনীতি- বিএনপি সংসদমুখী হলেও আন্দোলনে নামতে জামায়াতের চাপ বাড়ছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ তৃণমূলমুখী

 সরগরম হয়ে উঠছে রাজনীতি। বিভিন্ন ইসু্যতে প্রধান দুই দলের চলছে উত্তপ্ত বাকযুদ্ধ। যুদ্ধাপরাধী ইসু্যসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘেরাটোপে অসত্মিত্ব রৰায় মরণ কামড় দেয়ার গোপন মিশনে ব্যসত্ম জামায়াত।
আন্দোলনের মাঠে নামতে বিএনপির ওপর নানাভাবেই চাপ বাড়াচ্ছে জামায়াতসহ উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। বসে নেই বিএনপি। ১০ দফা দাবি থেকে হঠাৎ করেই রণেভঙ্গ দিয়ে সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধানত্ম নিয়েছে তারা। টার্গেট সংসদের ভেতর ও বাইরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ৰেত্র প্রস্তুত করা। বিরোধী দলের সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় আওয়ামী লীগও এখন তৃণমূলমুখী। ত্রিমুখী এমন তৎপরতায় দেশের রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
নির্বাচনে ভরাডুবি আর গৃহবিবাদের ধকল সামলিয়ে রাজপথে নামার চেষ্টা করছে বিএনপি। সংসদের ভেতর ও বাইরে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশলে এগুচ্ছে তারা। ভিন্ন কৌশলে সংঘটিত হচ্ছে জামায়াত। নিজেদের রাজনৈতিক অসত্মিত্ব রৰা এবং যুদ্ধাপরাধ ইসু্যতে নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের বাঁচাতে বিপুল অর্থ ও সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে জামায়াতে ইসলামী গোপনে ধর্মভিত্তিক উগ্রগোষ্ঠীকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য সংঘটিত করছে। লৰ্য রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে নিজেদের রৰা। বসে নেই আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলের কার্যক্রমের ওপর তীৰ্ন নজর রাখছে তারা। একইসঙ্গে বিরোধী দলের সবরকম আন্দোলন-সংগ্রাম রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলারও প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার শনিবার জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপিসহ বিরোধী দল। কারণ গত ১৪ মাসে নির্বাচনী ইশতেহারের একটিও সরকার বাসত্মবায়ন করতে পারেনি। বিশেষ করে দেশের যেভাবে চাঁদাবাজি, মসত্মানি, টেন্ডারবাজি হচ্ছে, শিৰাঙ্গনে মেধাবী ছাত্র হত্যা, দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ এবং প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে যে অসম চুক্তি করেছে- সে সম্পর্কে কথা বলতে সংসদে যেতে হবে। সংসদের পাশাপাশি দেশের স্বার্থে রাজপথে আন্দোলনও করতে হবে। সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে তাতে দেশের মানুষও আন্দোলনমুখী। দেশকে বাঁচাতে জনগণের পাশে আমাদের থাকতে হবে। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে।
তবে বিরোধী দলের এমন হুমকি-ধুমকিতে মোটেই বিচলিত নয় ৰমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, নন ইসু্যকে ইসু্য বানিয়ে বিএনপি আন্দোলনের চেষ্টা করলে জনগণ থেকে তারা আরও বিচ্ছিন্ন ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়বে। কেননা ধর্মের নামে ব্যবসা আর ভারত জুজুর নামে জনগণকে বিভ্রানত্ম করার অস্ত্র ভোঁতা, অকেজো ও মরচে পড়ে গেছে। পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। তথ্য-প্রযুক্তির সমৃদ্ধির শিখড়ে বিশ্ব। এমন যুগে শুধুমাত্র ভারত জুজুর ভোঁতা অস্ত্র আর ধমর্ীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে গণতন্ত্র ধ্বংসের কোন অপচেষ্টা জনগণ মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তিই হচ্ছে জনগণ। তাই জনগণই সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে।
প্রধান দু'দলের এমন অবস্থান প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশেস্নষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনত্মর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ শনিবার জনকণ্ঠকে বলেন, বিরোধী দলের এখনও রাজপথে নামার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সংসদে গিয়ে সদস্যপদ রৰার পর হয়ত আবারও বর্জনের দিকে যাবে তারা। অতীতে এমনি হয়েছে। তারপরও যদি বিরোধী দলগুলো রাসত্মায় নামে, তখন সরকারের ভুল করা উচিত হবে না। বরং সরকারের উচিত হবে সংসদে বিরোধী দলকে ধরে রাখতে আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ দেয়া। না হলে তারা রাসত্মায় নামার সুযোগ পাবে। আগের সরকারের মতো বর্তমান সরকার একই আচরণ বা নীতি অনুসরণ যদি করে- তাহলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন হবে না। আর অতীত রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের পাশাপাশি সুশীল সমাজের ভূমিকাও গুরম্নত্বপূর্ণ। এ ৰেত্রে কোন পৰের না হলে নিরপেৰ হয়ে সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে দু'নেত্রীর মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত মনত্মব্য করে তিনি বলেন, দু'নেত্রী আলোচনায় বসেন না, শুধু সশস্ত্র বাহিনী দিবসে একসঙ্গে বসতে দেখা যায়। বছরে অনত্মত একটি বিশেষ দিনে দুই নেত্রীকে সারাদিন একসঙ্গে থাকা উচিত। এটা যদি হয় গণতন্ত্র তবে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। নইলে সুশীল সমাজসহ সবাই ৰতিগ্রসত্ম হবে। দেশের মানুষ আর অতীতের মতো সংঘাত, সাংঘর্ষিক রাজনীতি দেখতে চায় না।
সরকারের ১৪ মাসে পরস্পরের বিরম্নদ্ধে বাকযুদ্ধ চললেও রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল মোটামুটি শানত্ম। সরকারী দল ৰমতার মধুচন্দ্রিমা কাটাতে আর বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে শোচনীয় ভরাডুবির পর জ্বলে ওঠা অভ্যনত্মরীণ ৰোভ-দ্বন্দ্বের দাবানল সামাল দিতেই ছিল ব্যসত্ম। এতদিনে দেশের মানুষ ভুলতেই বসেছে সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি, হরতাল-ঘেরাও-অবরোধের মতো জনদুর্ভোগের কর্মসূচি। তবে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে নতুন বছরে আদালতের কিছু ঐতিহাসিক রায় ঘোষণায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের পর চরম বেকায়দায় পড়তে হয় খুনীদের দোসর ও বেনিফিশিয়ারীদের। সোচ্চার হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি। সর্বশেষ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের পর নিষিদ্ধের ঘেরাটোপে পড়েছে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষিদ্ধের খড়গের নীচে পড়া জামায়াতে ইসলামী এখন কৌশলে তাদের মিত্রশক্তি বিএনপিকে দিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করতে চাইছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ইসু্য নিয়ে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলনের পথ খুঁজছে তারা। নানাভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ইসলামী দলগুলোর এ আন্দোলনের ইন্ধনের পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রত্যৰ সমর্থন থাকলেও আপাতত কৌশলগত কারণে তারা সামনে আসতে চাইছে না। এ ইসু্যতে আন্দোলন একটি পর্যায়ে নিতে পারলে বিএনপি-জামায়াত সরাসরি তাদের সমর্থন দেওয়ার নীতি নিয়ে এগুচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর সরকার '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধানত্ম নিয়েছে। আর এটি সম্ভব হলে এমনিতেই জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার কোন সুযোগ সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরম্নর উদ্যোগ, অন্যদিকে রাজনীতি নিষিদ্ধের আশঙ্কা থেকেই স্বাধীনতা বিরোধী এই দলটি গোপণে বিপুল অর্থ ও সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার তৎপরতা চালাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমান সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আন্দোলন সফল হবে না। এটি বুঝতে পেরেই ৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। সামনের আসন সমস্যাসহ ১০ দফা দাবিতে এতদিন সংসদ বর্জন করে আসছিল বিএনপি। আর মাত্র ২৩টি কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলেই বিএনপির সবাই সংসদ সদস্য পদ হারাবে। এদিক লৰ্য রেখে ১০ দফা দাবি বাদ রেখেই সদস্যপদ রৰা আর সংসদের ভেতর-বাইরে সরকারকে চাপে ফেলতে সংসদে যোগদানের সিদ্ধানত্ম নিয়েছে বিএনপি। একই সিদ্ধানত্ম জামায়াতেরও।
জানা গেছে, সরকারের বিরম্নদ্ধে জনমত গড়তে দলের সাংগঠনিক শক্তি নিরূপণ ও সমমনাদের চিহ্নিত করতে এখন তৃণমূলমুখী দলটি। সারাদেশে কমিটি পুনর্গঠন ও কোন্দল নিরসন, কেন্দ্র থেকে উপজেলাপর্যায় পর্যনত্ম বিভিন্ন ইসু্যতে সভা-সমাবেশ ও মিছিল, সংসদে গিয়ে সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী বক্তব্য দেয়া, দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফর, ভারত বিরোধী ধর্মভিত্তিক ও সমমনা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভার মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করতে মাঠে নেমেছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে অবস্থান করলেও তারেক জিয়ার নির্দেশেই চলছে বিএনপি। সংসদ ও আন্দোলনের ব্যাপারে তারেক জিয়ার মতামত নিতে লন্ডনে গেছেন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর। তিনি লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পাশাপাশি তারেক জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন। এই বৈঠকের দিক-নির্দেশনা নিয়ে দেশে ফেরার পর বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে বলে জানা গেছে।
এদিকে বিরোধী দলের ওপর তীৰ্ন নজর রাখছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী পৰের আন্দোলনের প্রস্তুতির প্রেৰাপটে তা মোকাবেলায় এক বছর পর দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন তৃণমূলমুখী। ইতোমধ্যে বর্ধিত সভার মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সারাদেশে বর্ধিত সভার মাধ্যমে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সদস্য সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। ঝটিকা সফরে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। টার্গেট বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার উপযোগী করে সংগঠনকে শক্তিশালী এবং জনগণকে সচেতন করা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম শনিবার বলেন, দলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঢেলে সাজানো হবে। আগামী ৮ ফেব্রম্নয়ারি বরিশালে বিভাগীয় বর্ধিত সভা হবে। এ সভাতে সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধানত্ম হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কারণ ষড়যন্ত্র-চক্রানত্ম নয়, জনগণের শক্তিতে বলীয়ান আওয়ামী লীগ। তাই গণতন্ত্র ধ্বংসের সঙ্গে লিপ্ত ষড়যন্ত্র-চক্রানত্মকারীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে আওয়ামী লীগসহ দেশের জনগণও প্রস্তুত।

No comments

Powered by Blogger.