হামিম-সুমীর মৃতু্যর জন্য দায়ী বেপরোয়া ড্রাইভিং- ট্রাফিক আইন মানার বালাই নেই,- শুধু একে অন্যের ঘাড়ে- দোষ চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা by গাফফার খান চৌধুরী
অদৰ চালকদের বেপরোয়া গতির যানবাহন নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
অকার্যকর হয়ে পড়েছে ট্রাফিক আইন। বিশেষ করে রাজধানীর পাবলিক পরিবহনের
চালকরা বেপরোয়া।
এসব চালক ট্রাফিক আইন থোরাই কেয়ার করছে। ট্রাফিক আইন
অমান্য করা এদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ভুয়া চালকরা গতিসীমা নামের
সাইনবোর্ডকে আমলেই নিচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রয়োজনের তুলনায়
রাসত্মা কম থাকায় রাজধানীর পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। সংশিস্নষ্ট
প্রতিষ্ঠানগুলো একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।প্রসঙ্গত, গত বুধবার কাকরাইল মোড়ে উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুলের ৰুদে শিৰার্থী হামীম শেখ বাসের চাপায় নির্মম মৃতু্যর রেশ কাটতে না কাটতেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে আরেক শিশু সুমীর প্রাণ কেড়ে নেয় ঘাতক বাস। সুমীকে হত্যার পর বাসটি পালিয়ে যায়।
বিআরটিএর হিসেব মতে, প্রতিদিন গড়ে ঢাকার রাসত্মায় প্রায় দেড় শতাধিক প্রাইভেটকার নামছে। সে তুলনায় পাবলিক পরিবহন নামছে না। মাঝে মাঝে নামকাওয়াসত্মে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন জব্দ করতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। জব্দ করা বাস রাজনৈতিক তদ্বিরের কারণে সহজেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে গায়ে রং মেখে দিব্যি চলছে ঢাকার রাসত্মায়।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিরসনে ঢাকা মহানগর পুলিশ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করে। চালু হওয়া প্রোগ্রামে যানবাহনকে ট্রাফিক আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করতে চালু করা হয় নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বিআরটিএ, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড, পরিবহন মালিক ও পরিবহন শ্রমিক সমিতির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ঘন ঘন বৈঠক হতে থাকে। গঠন করা হয় উচ্চ ৰমতাসম্পন্ন কমিটি। এ সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর ৭০ পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় বাতি মেরামত ও রাসত্মার লেন মার্কিং করে দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল। এমনকি পর্যায়ক্রমে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ অটো-সিগন্যালিংয়ের চাবি ঢাকা মহানগর পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার বিষয়ে যুগানত্মকারী পদৰেপ নেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে বিআরটিএ ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের পাকড়াও করে তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল ও কোন কোন ৰেত্রে বিনা পরোয়ানায় পুলিশকে চালক গ্রেফতারের ৰমতা দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, লেন অমান্যকারীদের কমপৰে হাজার টাকা জরিমানা, ভুয়া চালকের লাইসেন্স বাতিল, ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ৩ মাসের জন্য বাতিল করা হবে। ঢাকার রাসত্মা থেকে ২০ বছরের অধিক পুরনো পাবলিক যানবাহন তুলে দেয়া হবে। এসব কাজ তদারকের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের ১২ ডিসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের ১২টি চেকপোস্ট বসিয়ে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী যানবাহন পাকড়াওয়ের নির্দেশ দেয়া হয়। বলা হয়েছিল শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর ছাড়া আর সব গাড়ির ৰেত্রে ট্রাফিক আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এমনকি কোন মন্ত্রীর গাড়িও না। এর আগে পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি রোধে গঠন করা হয়েছিল ১২ সদস্যের ধারালো কমিটি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যনত্ম এসব আইন যথেষ্ট কার্যকর ছিল। এর পর আসত্মে আসত্মে পুরো কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন হালনাগাদ রাজধানীর ৫০ পয়েন্টের বাতিও মেরামত করতে পারেনি। নিম্নমানের রং দিয়ে লেন মার্কিং করায় তা অনেক আগেই উঠে গেছে। বিআরটিএর ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের পাকড়াও অভিযান থেমে গেছে। সেই সঙ্গে থেমে গেছে ২০ বছরের অধিক পুরনো পাবলিক যানবাহন জব্দ অভিযান। ইতোপূর্বে বিগত বছরের ৯ আগস্ট থেকে ২৫ নবেম্বর পর্যনত্ম ২০ বছরের অধিক ৯ হাজার ৪শ' ৭টি মোটরযান ও ৫ হাজার ৩শ' ৪০ অবৈধ রিক্সা জব্দ করেছিল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। জব্দ মোটরযানের মধ্যে "আর কোন দিন এসব গাড়ি ঢাকায় চালাব না" মর্মে মুচলেকা দিয়ে ৪শ' ৪৫ গাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। বাকি ৭শ' ৩০টি মোটরযান পরবর্তীতে মোটা টাকা জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। পরে ছাড়া পাওয়া যানবাহনই আবার নতুন রঙে ঢাকার রাসত্মায় নামানো হয়। এরমধ্যে বহু বিতর্কর্িত পরিবহন নেতাদের যানবাহনও রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের হিসেব মতে, ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যনত্ম রাজধানীতেই ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫শ' ৭ মোটরযানের লাইসেন্স দেয়া হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬শ' ২৯টিই প্রাইভেটকার। প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু কোন সুরাহা আসেনি মন্ত্রণালয় থেকে।
উপরন্তু সেসব যানবাহন জব্দ করা হয়েছিল তদ্বিরের কারণে সেসব যানবাহন আবার ছাড়া পেয়ে গেছে। ছাড়া পাওয়া যানবাহন গায়ে রং মেখে নতুন পোশাক পরে দিব্যি রাসত্মায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজার হালে। আর স্বমূর্তিতে আবিভর্ূত হয়েছে ভুয়া চালকরা। পুরনো গাড়িতে রাজধানীর রাসত্মা আবার সয়লাব হয়ে গেছে। লেন মেনে গাড়ি চালানোর কোন বালাই নেই। আগের নিয়ম অনুযায়ী দ্রম্নত গতির যানবাহন যেমন প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও জীপ ডানপাশের লেনে, দ্বিতীয় লেনে বাস ট্রাক, তৃতীয় লেনে অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল, সিএনজির মতো যানবাহন চলাচল করবে। এজন্য লেনভিত্তিক গাড়ির ছবি অাঁকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে লেন অমান্যকারী যানবাহন শনাক্তকরণ শুরম্ন হয়। টানা ৪দিনে শতাধিক গাড়িকে ভিডিও চিত্রে মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জ্ঞান দিতে পুলিশ চালকদের জন্য প্রশিৰণ কার্যক্রম চালু করে। এছাড়া জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় হালনাগাদ অনত্মত অর্ধলাখ মামলা হয়েছে। কয়েক শ' চালক গ্রেফতার হয়েছে। ওই সময় রাজধানী থেকে মিনিবাস তুলে দেয়ার সিদ্ধানত্ম নেয় পুলিশ। এমনকি ভুয়া চালকদের পাকড়াও অভিযান শুরম্ন ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পুলিশের এমন ঘোষণায় কয়েক হাজার ভুয়া চালক ঢাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী জেলায় চলে যায়। সম্প্রতি ট্রাফিক আইন মেনে চলা বাধ্যবাধকতার ৰেত্রে শৈথিল্য এসেছে। সেই সুযোগে পাশর্্ববর্তী জেলা থেকে ফিরে এসেছে ভুয়া-অদৰ চালকরা। গতিসীমার ব্যারোমিটার না দেখেই গাড়ির গতির ব্যারোমিটার বাড়িয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আর মাঝে মাঝেই কেড়ে নিচ্ছে হামীম বা সুমীর মতো কচি তাজা প্রাণ।
No comments