শাভেজের বিজয়-লাতিন আমেরিকার রূপান্তর by সুভাষ সাহা

হুগো শাভেজ ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা থেকে কীভাবে তিনবার ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গোটা দক্ষিণ আমেরিকার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক রূপান্তরের পুরোধা হলেন, সে এক বিরাট বিস্ময়। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন করপোরেট দুনিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট হেনরিক কাপ্রিলেসকে হারিয়ে পুনরায় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।


এতে ভেনিজুয়েলাসহ গোটা দক্ষিণ আমেরিকায় সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজের খুঁটি আরও মজবুত হবে। এই অঞ্চলে এক দশক ধরে প্রবহমান সামাজিক রূপান্তর এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সারা দুনিয়ায় নয়া উদারতাবাদকে (নিউ লিবারেলিজম) বিকল্পহীন মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লাগামহীন হাইপের মধ্যে লাতিন আমেরিকার 'বলিভারিয়ান বিপ্লব' বিকল্প উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজের নতুন দিশা দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে নিউ লিবারেলিজমের নামে স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার কৌশলের বিপরীতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিকল্প ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে এনে কীভাবে দারিদ্র্য হ্রাস ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানো যায় সে পথও তৈরি করে দিয়েছে এই লাতিন আমেরিকাই। গণতন্ত্র মানে যে শুধু ব্যক্তি বা করপোরেট পুঁজির পূজা করা নয়, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বেকারত্ব হ্রাস ও জীবনমানের উন্নয়ন, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা_ এই সত্যটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে লাতিন আমেরিকার বাম গণতান্ত্রিক সরকারগুলো। ভেনিজুয়েলা বিশ্বের স্বীকৃত জ্বালানি তেলের মজুদের অধিকারী হওয়ার কারণে এই বিপ্লবের নেতৃত্ব সারিতে চলে এসেছে। শাভেজ তার বিপ্লবকে একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অভিধায় অভিহিত করেছেন।
আমরাসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দক্ষিণ আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে নিজস্ব স্টাইলে সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং বিগ ব্রাদারদের ডিকটেশনমুক্তভাবে কী করে স্বাধীন জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব, তার পথনির্দেশ পেতে পারি। জনগণের জন্য কাজ করলে জনগণই যে সব চক্রান্তের জটাজাল ছিন্ন করতে সহায়তা করে_ তার প্রমাণ তো হুগো শাভেজ। নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার পরও বারবার সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেও তার বিরোধীরা সফল হতে পারেনি তার প্রতি জনগণের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কারণেই। অতএব, আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের শক্তি, বুদ্ধি ও জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে তাদের সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেলে সাফল্য পেতে পারে। জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে, কৃচ্ছতা কর্মসূচির নামে অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা ও ভাগ্যের বিনিময়ে ওপরতলার মানুষদের সুবিধা দান আর যা-ই হোক; দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজে আসে না। এতে আয় বৈষম্য বাড়ে, ধনীরা আরও ধনী হয়, গরিবের থালা-বাটি-কম্বল পর্যন্ত খোয়া যায়।
নয়া উদারতাবাদের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্র এবং শাভেজের নেতৃত্বাধীন ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি ও সামাজিক পরিস্থিতির একই সময়কার তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা লাতিন আমেরিকার এই বিকাশমান গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বা ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য রেখা টানতে পারি। অনেকেই জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে এখন উচ্চমাত্রার বেকারত্ব বিরাজমান। সাধারণ মানুষের বেতন কমছে নাটকীয়ভাবে। স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ে মারাত্মক হ্রাস ঘটছে। ওয়ালস্ট্রিট, ব্যাংক, করপোরেশন ও সম্পদশালীরা আরও বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষ অনেককেই এখন সহায়-সম্পদ, এমনকি ঋণ শোধ করার সাধ্য নেই বলে ঘর ছেড়ে খোলা আকাশকেই ছাদ করে নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান উদৃব্দত করলেই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা কতটা শোচনীয়, তা টের পাওয়া যাবে। সর্বশেষ সরকারের রিলিজ করা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে জাতীয় প্রবৃদ্ধির ৯৩ শতাংশ মাত্র এক শতাংশ লোকের পকেটে গেছে। আর আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে এই সম্পদশালীদেরই যত মাথাব্যথা। গরিবদের এবারকার নির্বাচন নিয়ে তেমন মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে ভেনিজুয়েলার নির্বাচনে এবার ৮০ শতাংশের বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কারণ ভেনিজুয়েলার সাধারণ মানুষ জানে_ ভোট দিয়ে হুগো শাভেজকে নির্বাচিত করতে না পারলে তারা যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ভেনিজুয়েলায় এক সময়ের চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে যাদের বসবাস ছিল, তারা এখন অধিকাংশই নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্তরে পেঁৗছেছে। ১৩ বছর আগে শাভেজ প্রথমবার যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন ভেনিজুয়েলায় বেকারত্বের হার ছিল ১৬ দশমিক ১ শতাংশ। এখন সেটা সাড়ে ছয় শতাংশে নেমে গেছে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এখন ভেনিজুয়েলার বেতনের হার সবচেয়ে বেশি। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের হার তার ক্ষমতায় প্রথমবার আসার সময় যেখানে ২১ শতাংশ ছিল; সেটা এখন ৬ দশমিক ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী চার কোটি ৬২ লাখ লোকের সঙ্গে এখন আরও ২৬ লাখ যোগ হয়েছে। বড় কথা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণের দাওয়াই হিসেবে যেখানে পশ্চিমা দুনিয়া কৃচ্ছ্রের নামে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে কাটছাঁট করতে ব্যস্ত; তখন ভেনিজুয়েলা এর পরিধি বৃদ্ধি করে চলেছে। দেশটির জাতীয় বাজেটের ৪৩ শতাংশ এখন সামাজিক কর্মসূচিতে ব্যয় হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে_ যুক্তরাষ্ট্র কেন পারেনি আর ভেনিজুয়েলা কেন পেরেছে? যুক্তরাষ্ট্র নয়া উদারতাবাদী নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ফিন্যান্স পুঁজির তল্পিবাহক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে সমাজের ধনবান এক শতাংশ মানুষই সবকিছু নির্ধারণ করে। পক্ষান্তরে ভেনিজুয়েলায় জাতীয় সম্পদের একটা অংশ রাষ্ট্রের হাতে। এ থেকে লব্ধ আয়ের বিরাট অংশ ব্যয় হয় সামাজিক কর্মসূচিতে। জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থান কর্মসূচিতে রাষ্ট্রীয় অবদান বেশি থাকায় সেখানে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি দ্রুত গড়ে উঠেছে। ফলে উৎপাদিকাশক্তির বিকাশও ঘটছে দ্রুত। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের আয়, জাতীয় আয় বাড়ছে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও।
প্রশ্নম্ন আসতে পারে_ ভেনিজুয়েলা এমন অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে কি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে? দক্ষিণ আমেরিকার গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নামে পরিচিত পরিবর্তনটা আসলে পুঁজিবাদী কাঠামোর আওতায়ই হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সেখানে উৎপাদন সম্পর্কের এখনও কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। তবে নিচুতলার মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার অধিকার সম্প্রসারিত হয়েছে। তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বেড়েছে। এক ধরনের মিশ্র অর্থনীতি সেখানে চালু হয়েছে। তবে সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় অনেক বেশি। ফলে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রূপান্তর ঘটছে। এই ব্যবস্থা না চৈনিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, না মার্কিন নিউ লিবারেলিজম অথবা স্ক্যান্ডিনেভীয় পুুঁজিবাদী কল্যাণ রাষ্ট্রের অনুরূপ। এটাকে আমরা লাতিন আমেরিকা ধাঁচের মানবিক চেহারার পুঁজিবাদ বলতে পারি বা সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক লাতিন সমাজও বলতে পারি। কেউ আবার হুগো শাভেজের লেবেল দেওয়া নাম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রও বলতে পারেন। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, হুগো শাভেজরা এই একক সাম্র্রাজ্যবাদের যুগেও কী করে স্বাধীনভাবে জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে এগিয়ে যেতে হয় এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন_ এটা স্বীকার করতেই হবে। এ জন্যই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর মানুষের কাছে হুগো শাভেজ অনেক বেশি বরণীয়।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.