করুণা নয় সহযোগিতার হাত বাড়ান by খন্দকার মাহবুব হোসেন
বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সঠিক সংখ্যা কত- এমন কোনো পরিসংখ্যান নেই। মানবজীবনের চরম অভিশাপ অন্ধত্বকে সঙ্গী করে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পরিবার ও সমাজের বোঝা হিসেবে দিনাতিপাত করছে। সুষ্ঠু পর্যবেক্ষণ ও নজর না দেওয়ার কারণে এই অন্ধত্ব থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারেনি।
অথচ আমাদের এখানে যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে আছে, তাদের মেধা অনেক। তাদের বুদ্ধিমত্তা দেখে অনেক সময় অবাক হতে হয়। এমন বুদ্ধিমান মানুষগুলোকে যদি সঠিকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে কাজে লাগানো যায়, তাহলে তারা সমাজের বোঝা হওয়ার পরিবর্তে সম্পদ হিসেবে গণ্য হতে পারে। একটা মানুষ অন্ধত্ব ঘুচিয়ে যখন পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পায়, তখন তার মধ্যে যে স্পৃহার জন্ম হয়, তাকে ঈর্ষণীয় বলা যায়। আর এটা সম্ভব যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে। এমনটা সম্ভব হলে তাদের হাত ভিক্ষার জন্য প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে দেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারে।
তাদের মেধা এবং অনুভূতির একটি উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। একবার একজন অন্ধকে বই বিক্রি করতে দেখলাম রাস্তায়। খুব ভালো লাগল আমার কাছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কোনটা কী বই সে কিভাবে বুঝতে পারে। সে মাথা নেড়ে জবাব দিল, কোনো অসুবিধা হয় না তার। আমি কিছু বই হাতে নিয়ে তার হাতে একটি দিয়ে বললাম, বলুন তো এই বইটির নাম কী। সে অকপটে বইটির নাম বলে দিল। তার আগে বইয়ের গায়ে শুধু হাত বুলিয়ে নিয়েছিল সে। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি পরিচালিত ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরতদের মেধা দেখে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না। আমি সেখানে দেখেছি একজন যুবক কিভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোমবাতি তৈরি করে চলেছে। সেগুলো ফিনিশিং দেওয়ার কাজটিও সে করছে অত্যন্ত নিপুণ শিল্পীর মতো। অথচ ওই যুবককে নেওয়া হয়েছিল রাস্তা থেকে। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার চকপেনসিলের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেকেই জানে না একসময় এই চকপেনসিলের অর্ধেকই তৈরি হতো অন্ধদের হাত দিয়ে। আজ অবশ্য সেই অবস্থা আর নেই।
তবে কিছু রোগী আছে, যাদের চিকিৎসার মাধ্যমেও আরোগ্য করে তোলা যায় না। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক হ্রাস পাবে। সে ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোকে কাজে লাগানোও অসম্ভব হবে না। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী হিসেবে তৈরি করা অসম্ভব নয়। মিরপুরে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সরকার পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এই লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকার যদি সমন্বিতভাবে দেশে এমন আরো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করে, তাহলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, কাজ যা করা প্রয়োজন তার অংশবিশেষও হচ্ছে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত। ব্রেইল পদ্ধতিতে তারা লেখাপড়া শিখে সমাজে তাদের ভূমিকা রাখছে। আমাদের এখানেও এই পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে কিছু মানুষ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক অন্ধদের শিক্ষাব্যয় বহন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু সেই সুযোগও প্রয়োজনের তুলনায় কম। কারিগরি প্রশিক্ষণের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে আমাদের এখানেও এর সুফল প্রত্যক্ষ করা যাবে। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বেশ কিছু ব্যক্তি টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এখন তো তাদের জন্য আরো উন্নত প্রযুক্তিসুবিধা বিস্তৃত হয়েছে। তাদের জন্য কম্পিউটার হয়েছে, যা স্পর্শ ও শব্দের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। কিবোর্ডগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক কারণে অন্ধত্ব বরণ করার পাশাপাশি দারিদ্র্যের কারণেও অনেককে অন্ধত্ব বরণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে পুষ্টিহীনতা একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের প্রয়োজনীয় ভিটামিন 'এ' গ্রহণের অভাবের কারণে শত শত শিশু দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রটিকে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে তাই অন্ধত্বও দূর করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট।
সরকার কাগজে-কলমে দৃষ্টিহীনদের জন্য অনেক কিছু করছে। তা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলেও অনেক উপকার হতো। সরকারের কাজের সমন্বয়হীনতা এবং আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। তারা কাজের চেয়ে প্রচারকে প্রাধান্য দেয়। তারা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা বাড়িয়ে আমাদের সমাজকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। কিছু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আছে, যারা ভিক্ষাবৃত্তিকে অধিক লাভজনক মনে করে। তাদের আয়ের পরিমাণও কম নয়। যে কারণে চেষ্টা করেও কিছু মানুষ আছে, যাদের সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় না। তবে সরকার যদি আন্তরিক হয় তাহলে এটাও বড় কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অনায়াসে মানবসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কাজটি কে করবে। সেই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আমাদের দেশে কিছু সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি অন্যতম।
দেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওই সংগঠন পরিচালনা শুরু করি। তবে স্বাধীনতা লাভের আগে এম আর খান সাহেব একটি সংগঠন পরিচালনা করলেও এর বিস্তৃতি ঘটেনি তখন।
বাংলাদেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। সমস্যার অন্ত নেই। তার পরও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি সরকার ও কিছু সচেতন মানুষের চিন্তায় আসে। সেই সময় বাংলাদেশে আসেন রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ড নামে একটি সংগঠনের কর্ণধার উইলসন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাংলাদেশের দৃষ্টিহীনদের জন্য কিছু করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়। উইলসন বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ অনুযায়ী বাংলাদেশে দৃষ্টিহীনদের সহযোগিতার হাত বাড়ান। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে তাঁরা কাজ শুরু করেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ভ্রাম্যমাণ চক্ষুশিবির চালু হয়। শত শত মানুষ ছানিরোগে আক্রান্ত হয়ে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে ছিল তখন। দেশে উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি উইলসনের সংগঠনের সহযোগিতায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছানিরোগীদের অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রোটারি ক্লাব ও লায়ন্স ক্লাবও এ ধরনের চক্ষুশিবির করে সারা দেশে দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। আজকে সেই অবস্থা থেকেও চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন তো উন্নত ল্যান্স সংযোগের সুবিধা বাংলাদেশে সহজলভ্য। কিন্তু জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির পক্ষে আগের মতো ভ্রাম্যমাণ চক্ষুশিবির পরিচালনা করে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উন্নত প্রযুক্তি সুবিধার অভাবই এই কাজকে ধীরগতিসম্পন্ন করে দিয়েছে। ল্যান্স সংযোজনের কাজটি যে পরিমাণে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি এখনো। যে কারণে গরিব ও অসেচতন মানুষ এখনো অনেকেই অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
তবে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির নামে বাংলাদেশের কিছু জেলায় চক্ষু হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। প্রথমদিকে ঢাকা থেকে এসব হাসপাতাল পরিচালনাকাজে সহযোগিতা করা হতো। পরবর্তীকালে হাসপাতালগুলো নিজ উদ্যোগে পরিচালিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে তারা সরাসরি অনুদান গ্রহণেরও সুযোগ পায়।
অন্ধদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে অনেক কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাদের যদি ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা প্রদান করা যায়, তাহলে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও কাজে লাগানো সম্ভব। বাজারের ব্যাগ, মোমবাতি, বাঁশ-বেতের কাজ- এমন অনেক আছে, যা তাদের দ্বারা করা সম্ভব। এই যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করার পরিবর্তে লোকটি লটারির টিকিট বিক্রি করছে, বই বিক্রি করছে, অথচ সে চোখে কিছুই দেখতে পারছে না- তা থেকেই প্রমাণ হয় তারা আমাদের সমাজের বোঝা নয়। আসলে আমাদের অবহেলাই তাদের বোঝা বানিয়ে রেখেছে। ভিক্ষা দেওয়ার হাতটি যদি সহযোগিতার হাত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে ভিক্ষুকের দুর্নামটি ঘুচে যাবে। দেশ গড়ার হাতিয়ারও হবে আরো মজবুত।
লেখক : বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির সভাপতি
তাদের মেধা এবং অনুভূতির একটি উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। একবার একজন অন্ধকে বই বিক্রি করতে দেখলাম রাস্তায়। খুব ভালো লাগল আমার কাছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কোনটা কী বই সে কিভাবে বুঝতে পারে। সে মাথা নেড়ে জবাব দিল, কোনো অসুবিধা হয় না তার। আমি কিছু বই হাতে নিয়ে তার হাতে একটি দিয়ে বললাম, বলুন তো এই বইটির নাম কী। সে অকপটে বইটির নাম বলে দিল। তার আগে বইয়ের গায়ে শুধু হাত বুলিয়ে নিয়েছিল সে। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি পরিচালিত ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরতদের মেধা দেখে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না। আমি সেখানে দেখেছি একজন যুবক কিভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোমবাতি তৈরি করে চলেছে। সেগুলো ফিনিশিং দেওয়ার কাজটিও সে করছে অত্যন্ত নিপুণ শিল্পীর মতো। অথচ ওই যুবককে নেওয়া হয়েছিল রাস্তা থেকে। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার চকপেনসিলের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেকেই জানে না একসময় এই চকপেনসিলের অর্ধেকই তৈরি হতো অন্ধদের হাত দিয়ে। আজ অবশ্য সেই অবস্থা আর নেই।
তবে কিছু রোগী আছে, যাদের চিকিৎসার মাধ্যমেও আরোগ্য করে তোলা যায় না। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক হ্রাস পাবে। সে ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোকে কাজে লাগানোও অসম্ভব হবে না। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী হিসেবে তৈরি করা অসম্ভব নয়। মিরপুরে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সরকার পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এই লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকার যদি সমন্বিতভাবে দেশে এমন আরো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করে, তাহলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, কাজ যা করা প্রয়োজন তার অংশবিশেষও হচ্ছে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত। ব্রেইল পদ্ধতিতে তারা লেখাপড়া শিখে সমাজে তাদের ভূমিকা রাখছে। আমাদের এখানেও এই পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে কিছু মানুষ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক অন্ধদের শিক্ষাব্যয় বহন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু সেই সুযোগও প্রয়োজনের তুলনায় কম। কারিগরি প্রশিক্ষণের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে আমাদের এখানেও এর সুফল প্রত্যক্ষ করা যাবে। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বেশ কিছু ব্যক্তি টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এখন তো তাদের জন্য আরো উন্নত প্রযুক্তিসুবিধা বিস্তৃত হয়েছে। তাদের জন্য কম্পিউটার হয়েছে, যা স্পর্শ ও শব্দের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। কিবোর্ডগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক কারণে অন্ধত্ব বরণ করার পাশাপাশি দারিদ্র্যের কারণেও অনেককে অন্ধত্ব বরণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে পুষ্টিহীনতা একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের প্রয়োজনীয় ভিটামিন 'এ' গ্রহণের অভাবের কারণে শত শত শিশু দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রটিকে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে তাই অন্ধত্বও দূর করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট।
সরকার কাগজে-কলমে দৃষ্টিহীনদের জন্য অনেক কিছু করছে। তা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলেও অনেক উপকার হতো। সরকারের কাজের সমন্বয়হীনতা এবং আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। তারা কাজের চেয়ে প্রচারকে প্রাধান্য দেয়। তারা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা বাড়িয়ে আমাদের সমাজকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। কিছু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আছে, যারা ভিক্ষাবৃত্তিকে অধিক লাভজনক মনে করে। তাদের আয়ের পরিমাণও কম নয়। যে কারণে চেষ্টা করেও কিছু মানুষ আছে, যাদের সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় না। তবে সরকার যদি আন্তরিক হয় তাহলে এটাও বড় কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অনায়াসে মানবসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কাজটি কে করবে। সেই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আমাদের দেশে কিছু সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি অন্যতম।
দেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওই সংগঠন পরিচালনা শুরু করি। তবে স্বাধীনতা লাভের আগে এম আর খান সাহেব একটি সংগঠন পরিচালনা করলেও এর বিস্তৃতি ঘটেনি তখন।
বাংলাদেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। সমস্যার অন্ত নেই। তার পরও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি সরকার ও কিছু সচেতন মানুষের চিন্তায় আসে। সেই সময় বাংলাদেশে আসেন রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ড নামে একটি সংগঠনের কর্ণধার উইলসন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাংলাদেশের দৃষ্টিহীনদের জন্য কিছু করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়। উইলসন বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ অনুযায়ী বাংলাদেশে দৃষ্টিহীনদের সহযোগিতার হাত বাড়ান। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে তাঁরা কাজ শুরু করেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ভ্রাম্যমাণ চক্ষুশিবির চালু হয়। শত শত মানুষ ছানিরোগে আক্রান্ত হয়ে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে ছিল তখন। দেশে উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি উইলসনের সংগঠনের সহযোগিতায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছানিরোগীদের অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রোটারি ক্লাব ও লায়ন্স ক্লাবও এ ধরনের চক্ষুশিবির করে সারা দেশে দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। আজকে সেই অবস্থা থেকেও চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন তো উন্নত ল্যান্স সংযোগের সুবিধা বাংলাদেশে সহজলভ্য। কিন্তু জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির পক্ষে আগের মতো ভ্রাম্যমাণ চক্ষুশিবির পরিচালনা করে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উন্নত প্রযুক্তি সুবিধার অভাবই এই কাজকে ধীরগতিসম্পন্ন করে দিয়েছে। ল্যান্স সংযোজনের কাজটি যে পরিমাণে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি এখনো। যে কারণে গরিব ও অসেচতন মানুষ এখনো অনেকেই অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
তবে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির নামে বাংলাদেশের কিছু জেলায় চক্ষু হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। প্রথমদিকে ঢাকা থেকে এসব হাসপাতাল পরিচালনাকাজে সহযোগিতা করা হতো। পরবর্তীকালে হাসপাতালগুলো নিজ উদ্যোগে পরিচালিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে তারা সরাসরি অনুদান গ্রহণেরও সুযোগ পায়।
অন্ধদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে অনেক কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাদের যদি ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা প্রদান করা যায়, তাহলে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও কাজে লাগানো সম্ভব। বাজারের ব্যাগ, মোমবাতি, বাঁশ-বেতের কাজ- এমন অনেক আছে, যা তাদের দ্বারা করা সম্ভব। এই যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করার পরিবর্তে লোকটি লটারির টিকিট বিক্রি করছে, বই বিক্রি করছে, অথচ সে চোখে কিছুই দেখতে পারছে না- তা থেকেই প্রমাণ হয় তারা আমাদের সমাজের বোঝা নয়। আসলে আমাদের অবহেলাই তাদের বোঝা বানিয়ে রেখেছে। ভিক্ষা দেওয়ার হাতটি যদি সহযোগিতার হাত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে ভিক্ষুকের দুর্নামটি ঘুচে যাবে। দেশ গড়ার হাতিয়ারও হবে আরো মজবুত।
লেখক : বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির সভাপতি
No comments