রাসায়নিক সারের অপপ্রয়োগ by একেএম সালাহউদ্দিন

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং উর্বর মাটি সবকিছু মিলিয়ে এখানে ফসল উৎপাদনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান। বর্তমানে দেশে তিন শতাধিক ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে। প্রায় ১২০০ রকমের রোগ, ১০০০ রকমের পোকামাকড় এবং কয়েকশ' প্রকার আগাছা এসব ফসলের নানা ক্ষতিসাধন করে।


প্রতি বছর এসব রোগবালাইয়ের জন্য ফসলের শতকরা ২৫-৩০ ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ১০০০-১২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফসলের এই ক্ষতি রোধ করতে ও অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষকরা জমিতে নানা প্রকার সার ব্যবহার করে। এসব সারের মধ্যে জৈব সারের তুলনায় রাসায়নিক সার দ্রুত কার্যকরী, তুলনামূলক দামে সাশ্রয়ী ও বাজারে সহজে পাওয়া যায় বলে কৃষকরা জমিতে রাসায়নিক সারই বেশি ব্যবহার করে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে এ দেশে প্রায় ৩৯ ধরনের কীটনাশক, ২১ ধরনের ছত্রাকনাশক ও ১০ ধরনের আগাছানাশক রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হতো। দিন দিন এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে প্রায় ২ মিলিয়ন একর জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হলেও ১৯৮৮ সালে ব্যবহার করা হয় দ্বিগুণ পরিমাণ জমিতে। বর্তমানে প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে মূলত সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবে ১৯৫১ সালে তৎকালীন সরকার বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানির অনুমতি দেয়। বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় তা পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
ফসলের রোগ দমনে এসব রাসায়নিক সার যথেষ্ট কার্যকরী হলেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এগুলোর নানা ক্ষতিকর দিক লক্ষণীয়। রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত অর্থাৎ অপপ্রয়োগের ফলে গুণাগুণ নষ্টের পাশাপাশি মাটির উর্বরতাশক্তি দ্রুত হ্রাস পায়; এ ছাড়া মাছ, প্রাণিকুল, মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের ১৪০টি দেশের গবেষকরা পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ রকম ১২টি রাসায়নিক পদার্থকে 'ডার্টি ডজন' নামে চিহ্নিত করে এগুলো ব্যবহারের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এগুলোর মধ্যে আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে ডিডিটি, এলড্রিন, বিএইচসি, ডাইএলড্রিন, হেপ্টাক্লোর। এসব নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থযুক্ত সার ভিন্ন নামে ভিন্ন প্যাকেটে বাজারে যত্রতত্র পাওয়া যায় এবং আমাদের দেশের কৃষকরা অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে নির্বিঘ্নে এগুলো ব্যবহার করছে। দীর্ঘদিন জমিতে রাসায়নিক সারের অপপ্রয়োগের ফলে এসব সারের কিছু ক্ষতিকর উপাদান উদ্ভিদ দেহে অদ্রবীভূত অবস্থায় বিরাজ করে, যা খাদ্য শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে শাকসবজি, ফলমূল প্রভৃতি ভক্ষণের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশের পর মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। জমিতে যে নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ সার প্রয়োগ করা হয়, তার শতকরা ৫০ ভাগ উদ্ভিদ শোষণ করে, বাকি ২-২০ ভাগ বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায়, ১৫-২০ ভাগ কাদামাটির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ২-১০ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যায়। তাই অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।

একেএম সালাহউদ্দিন
শিক্ষার্থী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
jojsau@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.