‘কন্যাশিশুর বিয়ে রোধ করুন’- আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০১২

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও দ্য ডেইলি স্টার -এর আয়োজনে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘টু ইয়াং টু ওয়েড: এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ/ দ্য ফার্স্ট এভার ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্য গার্ল চাইল্ড’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
মাহ্ফুজ আনাম
সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার

মাইকেল ম্যাক গ্রেথ
কান্ট্রি ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন

এ কে এম নূর-উন-নবী
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. আশরাফ হোসেন
মহাপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর

রোকেয়া কবির
নির্বাহী পরিচালক, নারী প্রগতি সংঘ

মো. হেলাল উদ্দিন
যুগ্ম সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়

জ্যোতি দ্রিনগ্রা
জয়েন্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম

জুলিয়া আহমেদ
ফ্রিল্যান্স কনসালট্যান্ট

রওশন আরা
সদস্য, নারীপক্ষ ও ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

তৌহিদা খন্দকার
পরিচালক, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওমেন লইয়ার অ্যাসোসিয়েশন (বিএনডব্লিউএলএ)

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান
সম্পাদক, অপ-এড অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ইস্যুজ,
দ্য ডেইলি স্টার

মামুনুর রশীদ
কো-অর্ডিনেটর, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন সেন্টার, স্টেপ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট

মাহফুজা রহমান
প্রজেস্ট অফিসার-এডুকেশন, ইউনেসকো

আমিনুল ইসলাম
চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট, ইউনিসেফ

তানভীর ওয়াহিদ
সদস্য, ইউএনএফপিএ
ইয়ুথ ফোরাম অন আরএইচ

সনি সহেলি
সদস্য, ইউএনএফপিএ
ইয়ুথ ফোরাম অন আরএইচ

সঞ্চালক
আর্থার এরকেন
কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল

আলোচনা
আর্থার এরকেন
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। কিন্তু এ দেশে এখনো বাল্যবিবাহ নামের সামাজিক ব্যাধি রয়েই গেছে। আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশের আইন—সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। গত কয়েক দশকে বাল্যবিবাহ নিয়ে নানা নীতিমালাও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। এর ফলে কন্যাশিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আবার এই বাল্যবিবাহের কারণে কন্যাশিশুর শারীরিক, মানসিক নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, মেয়েটির চেয়ে ছেলেটির বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি। দেখা গেছে, দুজনের বয়সের পার্থক্য গড়ে প্রায় নয় বছর। সুতরাং, দেখা যায়, কন্যাশিশুটির বিয়েতে রাজি না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না।
তাই আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের আজকের এই আয়োজনে আমরা বাল্যবিবাহের ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। শুরুতে আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি মাহ্ফুজ আনামকে।

মাহ্ফুজ আনাম
আমরা ইউএনএফপিএর সঙ্গে সহ-আয়োজক হিসেবে থাকতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশ ও তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাল্যবিবাহ রোধ জাতীয় প্রতিশ্রুতি, নৈতিকতা ও মানবাধিকারের একটি অন্যতম বিষয়। একই সঙ্গে এটি দেশের ভবিষ্যৎ ও রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। এ কারণেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সবাইকে কাজ করতে হবে। বাল্যবিবাহ এমন একটি বিষয়, যার মধ্যে ছদ্মবেশে অনেক সমস্যা লুকিয়ে রয়েছে।
বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের একটা মাত্রা রয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা জানি না। ১৫-১৬ বছরে বা তারও আগে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এতে মেয়েদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনও হচ্ছে। ফলে মেয়েটির সারা জীবনে এর প্রভাব থেকে যাচ্ছে।
বাল্যবিবাহ রোধে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংবাদপত্র অবশ্যই ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার সহায়তা দরকার। কারণ, টেলিভিশনের মাধ্যমে আবেগ, প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিকভাবে দেখানো যায়। দর্শকদের মাঝে সেটা নাড়াও দেয় বেশি মাত্রায়। এর প্রভাবও অনেক বেশি। সেখানে বাল্যবিবাহের ইস্যু নিয়ে নাটক, সিরিয়াল তৈরি করা যেতে পারে, যা এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়াকে এ ব্যাপারে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে অনেক কমিউনিটি রেডিও স্টেশন আছে। সেগুলোকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে ব্যবহার করতে পারি। সেখানে আমরা অর্থনৈতিক ক্ষতির ব্যাপারটিও জানাতে পারি।

মাইকেল ম্যাক গ্রেথ
বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়, পরিবার এবং পরিবারের শিশুদের বিপর্যস্ত করে।
প্রথমত বাল্যবিবাহ মেয়েদের শিক্ষাজীবনকে সংকুচিত করে ফেলে। বিয়ের পর কিশোরী মেয়েটির সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারা চায় না মেয়েটি পড়ালেখা বা অন্য কোনো কাজে বাইরে যাক। ফলে মেয়েটির যতটুকু ইচ্ছাশক্তি থাকে, তা-ও মিলিয়ে যায়। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয় হলো স্বাস্থ্যগত সমস্যা। বাল্যবিবাহের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যায়। কিশোরী মায়েদের মৃত্যুর হার অন্য যেকোনো বয়সের মাতৃমৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক নারীর তুলনায় ১৪ বা ১৫ বছরের কিশোরীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। কন্যাশিশুরা সন্তান ধারণে উপযুক্ত নয়। এত অল্প বয়সে মা হওয়ার ফলে তাদের শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটে। দাম্পত্য জীবনেও তারা সুখী হয় না। কন্যাশিশুদের সন্তান ধারণে ও প্রসবের সময় বিভিন্ন সমস্যা হয়। দীর্ঘ প্রসবব্যথার কারণে জরায়ু, মূত্রনালি ও মলনালি ছিঁড়ে যায়। এর ফলে ফিস্টুলা নামের রোগ হয়। এসব কারণে তাদের স্বামীরা তাদের পরিত্যাগ করতে পারে। আর এটা হতে পারে বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও অন্যান্য জটিলতার অন্যতম ভয়াবহ একটি দিক।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সন্তান প্রসবকালীন সময়ে যেসব শিশু মারা যায়, তাদের ৫০ শতাংশের মায়েরা কিশোরী। আমরা শিশুমৃত্যু রোধ করতে পারছি না, যার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ।
সুতরাং, শিশুমৃত্যুর হার কমাতে হলেও বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে।
সিলেটে সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি কর্মসূচি রয়েছে। সেখানকার ২০০৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েদের বিয়ের বয়স গড়ে ১৪ দশমিক ৭ বছর, যেখানে পুরো বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৬ দশমিক ৫ বছর। সে সময় থেকেই আমরা দুটি গবেষণা চালিয়ে আসছি। সেগুলো প্রথম গবেষণার মতো নয়। এগুলো তথ্য-উপাত্তের চেয়ে জনগণকে তুলনামূলকভাবে সরাসরি প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। আমরা আশাবাদী ছিলাম পরিস্থিতির উন্নতি হবে। একটি গবেষণায় দেখা গেল, বিয়ের গড় বয়স ১৪ দশমিক ৪ বছর। অন্যটিতে ১৪ দশমিক ২ বছর। সংকটটা কত গভীর বোঝা যায়। মোকাবিলাও অনেক কঠিন। তাই বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
বাল্যবিবাহের বাস্তব কিছু কারণ রয়েছে। আমি দুটি কারণ উল্লেখ করতে চাই।
একটি হলো, মেয়েরা কৈশোরে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। ফলে সমাজে তার সম্মানহানি ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথেই তারা নির্যাতনের শিকার হয়। ফলে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন মেয়েটির পরিবার মেয়েটির সুরক্ষার জন্য তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। পরিবার ভাবে, এ নিয়ে পরবর্তীকালে জটিলতা বাড়তে পারে, তখন হয়তো বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই কিশোরী অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দেয়।
অন্য কারণটি হলো যৌতুক। গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরলরৈখিকভাবে যৌতুকের হারও বাড়ে। এ কারণেই দরিদ্র বাবা মেয়েকে কিশোরী অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেন। এই হলো বাল্যবিবাহের কিছু কারণ। এগুলোকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে এগুলো নিয়ে আরও বেশি আলোচনা করতে হবে।
এই ইস্যুর একটি স্পর্শকাতর দিক হচ্ছে, সমাজে বেশির ভাগ বিয়েই হচ্ছে ১৫ বছরের নিচে। আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশি আইন—সব জায়গায় ১৮ বছরকে মেয়েদের বিয়ের জন্য আদর্শ সময় ধরা হয়েছে। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, একেবারেই শিশু যারা, তাদের বিয়ে না দেওয়ার ব্যাপারে জোর দেওয়া উচিত। তার মানে এই নয়, ১৬ বা ১৭-তে বিয়েটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমাদের ১২ থেকে ১৫ বছরের মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করাটা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে এগোলেই গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন আনাটা সহজ হবে।
একই সঙ্গে আমাদের আরেকটি অংশ জনগণ, স্থানীয় নীতিনির্ধারক ও সরকারের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। ইউএনএফপিএ সারা বিশ্ব থেকে বাল্যবিবাহ দূর করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেভ দ্য চিলড্রেন সর্বদা তাতে সহযোগিতা করবে।
যদি সামগ্রিকভাবে মানুষ সজাগ হয়, তবে পরিবর্তন আসতে বেশি সময় লাগে না।

মো. আশরাফ হোসেন
আমরা নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রদূত। বাল্যবিবাহ বন্ধ করাটা নারী-পুরুষের সমতা বিধানের আরেকটি দিক। এখনো আমাদের কন্যাশিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে, যা নারী-পুরুষের সমতার মূল চেতনার বিপক্ষে যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ সময়ে এই উদ্যোগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
বাল্যবিবাহ নামের অভিশাপের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। এটা কন্যাশিশুর মধ্যে সুপ্ত সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। বাল্যবিবাহ যেন অনেকটাই সামাজিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতির পর্যায়ে চলে এসেছে। আমাদের সেসব মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক বা আর্থসামাজিক কারণ চিহ্নিত করতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে, বিশেষ করে কিশোরদের বোঝাতে হবে। তাদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করতে হবে, যেন তারা কন্যাশিশুদের তাদের সমকক্ষ ভাবে, প্রতিযোগী না ভাবে। কারণ, এই সমাজটা পিতৃতান্ত্রিক।
আমরা পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, প্রতিকূল অনেক আচরণ এখনো আমাদের সমাজে অনুশীলন করা হয়। আমাদের ওই সব আচরণ চিহ্নিত করতে হবে। সুসংবেদনশীল আচরণ বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে ছেলেমেয়ে উভয়কেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমরা ইতিমধ্যে একটি কাজ হাতে নিয়েছি। ছেলেমেয়েদের সমন্বয়ে একটি ক্লাব করেছি, যেখানে নারীর প্রতি সুসংবেদনশীল আচরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ কে এম নূর-উন-নবী
বাল্যবিবাহ কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। এটি বেশ উদ্বেগজনক ব্যাপার। নিশ্চয়ই কেউ এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, যে মেয়েদের বাল্য অবস্থায় বিয়ে হয়, তাদের মাতৃমৃত্যুর হার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। এই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমরা শিশুমৃত্যু হ্রাসে পদক পেয়েছি, সাফল্য অর্জন করেছি। মাতৃমৃত্যুও আমরা বিভিন্নভাবে কমিয়ে এনেছি। কিন্তু বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে আরও কাজ করা দরকার।
সামাজিক দিক বিবেচনা করলে বিডিএইচএসের (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে) সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, এক বছরে মেয়েদের বিয়ের বয়স বেড়েছে। এটা কি কেবল সমাজের জন্য, নাকি আইনের শাসনের প্রভাব?
আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। কাবিননামা ও বিয়ের নিবন্ধনে মেয়ের বয়স ১৮-ই দেখানো হয়। কিন্তু মূলত তাদের বয়স ১৪ বা ১৫ বছর বা তারও কম। তা হলে বিয়েতে মেয়েদের বয়সের ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে—এটা কীভাবে নিশ্চিত করব?
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি এর একটা ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। আরেকটি ব্যাপার, কিশোরী মায়ের বয়স কম হলেও এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ, এ সম্পর্কিত কোনো কাগজপত্র থাকে না। ১৯৭২ সাল থেকে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হলেও এ ব্যাপারে আইনের যথার্থ প্রয়োগ হয়নি। তাই এটি অনেকেই মেনে চলেনি।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের কথা বলতে পারি। যখন নতুন শিক্ষার্থীরা আসে, আমি তাদের বলি, দুই বছরের মধ্যে বিয়ে করা ও সন্তানধারণ চলবে না। যদি এই কথা মেনে না চলো, তবে তুমি তোমার ডিগ্রি হারাবে। বৈবাহিক জীবনের জটিলতার কারণে শিক্ষাজীবন নিয়ম অনুযায়ী চালিয়ে নিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে হয়তো শতভাগ সফলতা আসে না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাবিত করা যায়।
আমরা নারীস্বাস্থ্য ও অন্যান্য ব্যাপারে তখনই সফল হব, যখন আমরা জনগণের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারব বিষয়টি নিয়ে। গতানুগতিক যে কাগজগুলো রয়েছে, যেখানে লেখা থাকে, ‘বাল্যবিবাহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’। এর বদলে এখন সফলতার গল্পগুলো অনেক বেশি বলতে হবে। সেই গল্পগুলো গৎবাঁধা কাগজের চেয়ে অনেক বেশি কাজে দেবে।
বাল্যবিবাহ রোধে আমাদের একটা অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সেখানে জনসাধারণের জন্য যোগাযোগের ফোরাম তৈরি হতে পারে। যেখানে বাল্যবিবাহের কুফলের ওপর বিভিন্ন আলোচনায় জনগণ অংশ নিতে পারে। তাতে কিশোরী মেয়েরা বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের একটি নীতিমালা রয়েছে যে, বাল্যবিবাহ হলে সেই কন্যাশিশুর বাবাকে শাস্তি দেওয়া হবে। আমার প্রশ্ন, সেই কন্যাশিশুর বিয়ে হয়ে গেলে এই শাস্তি দিয়ে কী লাভ। এই আইনের সংশোধন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক এমন কোনো উপায় বের করতে হবে, যাতে সত্যিকার অর্থেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

মো. হেলাল উদ্দিন
বাল্যবিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ এবং বাল্যবিবাহকে ইসলাম গ্রহণযোগ্যতা দেয় না। দেশের আইনে রয়েছে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ আর ছেলেদের ২১। বিয়ে নিবন্ধনেও তার কম হয় না। কিন্তু ব্যাপারটা তো সত্যি নয়। এই ফাঁকি বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এসএসসি বা জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখে বিয়ের নিবন্ধন করাতে হবে। যারা দেখাতে পারবে না, তারা দোষী সাব্যস্ত হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। ফলে অনেক ইমাম প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। বাল্যবিবাহের বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা ইমামদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করব, সেখানে আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

রোকেয়া কবির
২০০৯ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৩০ শতাংশ মেয়ে ১৬ বছরে মা হয়। ৬০ শতাংশের বেশি মেয়ে ১৭ বছরে মা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আইনে বয়সসীমা নির্ধারিত থাকলেও এর কোনো প্রয়োগ নেই। বাল্যবিবাহ একটা ক্ষতিকর প্রথা। কিন্তু এর মূল কারণগুলো বিবেচনা করা দরকার। বাল্যবিবাহের ফলে পুরুষেরা একধরনের সুবিধা পায়। আমাদের সংগঠন ১৯৯২-৯৩ সাল থেকে শিক্ষাকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল করার চেষ্টা করছে। নারীদের সংগঠিত করছে। তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসছে। নারীরাও কর্মশক্তির অংশ। এটা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি আমরা।
অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কতটুকু, এর ওপর আমরা গবেষণা, সেমিনার, কর্মশালা করছি। একজন যখন বালিকা বয়সে পাঁচ-ছয়টি সন্তান জন্ম দেয়, তখন সেই পরিবারের অর্থনীতিতে, জাতীয় রাজস্ব খাতে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা আমরা দেখানোর চেষ্টা করি। আমরা অনেক কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছি। যেমন যৌন ও প্রজননসংক্রান্ত অধিকার, স্বাস্থ্যশিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয় জাতীয় পাঠক্রমে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছি; যাতে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সঙ্গেও নানা কাজ করছি। চেষ্টা করছি, এই বিষয়গুলো সমন্বিত হয়ে যেন বাস্তব রূপ পায়।

জ্যোতি দ্রিনগ্রা
শিশু ও নারীদের অপুষ্টির দিক থেকে বাংলাদেশ ওপরের দিকে অবস্থান করছে। অপুষ্টির সঙ্গে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে। কম বয়সী মা কোনো শিশুর জন্ম দিলে সেই শিশু কম যত্ন পাবে। এতে শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে। বাল্যবিবাহের দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, এতে করে নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাহত হয়। কন্যাশিশু বিয়ের পর পারিবারিক ক্ষমতা কাঠামোর একেবারে তলানিতে অবস্থান করে। কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার থাকে না। ক্ষমতায়ন সরাসরি বাল্যবিবাহের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় যদি নারী-পুরুষের মর্যাদা সমান হতো, তবে অপুষ্টির হার ১৩ শতাংশে কমিয়ে আনা যেত।

জুলিয়া আহমেদ
বাল্যবিবাহ মূল উন্নয়ন নির্দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার এই নির্দেশকগুলো হলো মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, শিশুশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।
‘কস্ট অব ভায়োলেন্স ইন্সট্রুমেন্ট’ নামের একটি কেয়ার প্রকল্পে আমরা বিশদভাবে দুটো বিষয় তুলে ধরেছিলাম। একটি ছিল দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ। অন্যটি ছিল অধিকারভিত্তিক প্রস্তাবনা। প্রথম বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাল্যবিবাহ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা দুটিই বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানে আমরা দেখেছি, অবস্থা খুবই নাজুক।
তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ বাল্যবিবাহ বা নারী নির্যাতনের মধ্যে কোনো পারিবারিক সহিংসতা দেখতে পায় না। এ ক্ষেত্রে তাদের আচরণ পরিবর্তন করানো অনেক কঠিন। সে ক্ষেত্রে কেয়ার প্রকল্পে আমরা পরীক্ষা করেছি, মূল্যায়ন করেছি। কিছু উপকরণ প্রয়োগ করেছি। একটি উপকরণ হচ্ছে, ব্যবহার পরিবর্তনকারী যোগাযোগ (বিহেভিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশন টুলস বা সংক্ষেপে বিসিসি টুলস) ব্যবস্থা। এটা ব্যবহার করেছি সহিংসতার অন্তর্নিহিত কারণগুলো বোঝার জন্য। আমরা নারী ও পুরুষ উভয়কে পর্যবেক্ষণ করতাম। কিছু বিষয় তাদের অনুশীলন করাতাম। নারী-পুরুষ কীভাবে দিনের ২৪ ঘণ্টা কাটায়, তা দেখার জন্য এই অনুশীলনগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই অনুশীলন থেকে দেখা গেল, পুরুষদের মধ্যে একটা চিন্তার প্রবণতা লক্ষ করা যায় যে তারা মনে করে, নারীরা দায়িত্ব পালনে বাধ্য। নারীরা তাদের উৎপাদনমূলক, প্রজননমূলক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য। বিসিসি উপকরণের ক্ষেত্রে আরেকটি দিক হলো, আমরা নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে পুরুষের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নারীকে দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলি না। এটি খুব শক্তিশালী উপকরণ। এতে নারীরা পুরো ব্যাপারটিতে উৎসাহিত হয়। আমরা বলছি, আমাদের এই উপকরণ রয়েছে। আপনারা যখন কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য কাজ করবেন, তখন উপকরণটি ব্যবহার করতে পারেন।
আমি অধিকারভিত্তিক প্রস্তাবনা নিয়েও কথা বলেছিলাম। অধিকারভিত্তিক প্রস্তাবনাকেও একটি উপকরণে উন্নীত করেছি। একটা সাধারণ সমালোচনা আছে—আমাদের আইন আছে, নীতিমালা আছে, কিন্তু সেটা কাজ করছে না। সেই জায়গা থেকে আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমাদের আইনের ১৬ নম্বর ধারায় ক্ষতিপূরণ প্রদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, আমরা মূল্য বিশ্লেষণ উপকরণ (কস্ট অ্যানালাইসিস টুল কিট) তৈরি করেছি। এই উপকরণগুলোর মাধ্যমে আমরা ক্ষতিপূরণের মান মোটামুটি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পারি।

রওশন আরা
আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী উপাদান নামের একটি কর্মসূচি রয়েছে, যেটি বাল্যবিবাহ নিয়েও কাজ করে। আমরা দেখি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বাল্যবিবাহ বন্ধের উদ্যোগ নিলেও এলাকার স্থানীয় লোকজন বাল্যবিবাহের তথ্য লুকিয়ে রাখে। তাই তথ্য না পেলে আইন সংস্থা কিছুই করতে পারে না। আরেকটি ব্যাপার—জনগণের জন্ম নিবন্ধন সম্পর্কে অসচেতনতা।
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমাদের আইন রয়েছে, সরকার তা প্রয়োগ করতে চায়। কিন্তু এর জন্য আরও উদ্যোগী হতে হবে। ইউনিসেফ এবং সরকার মেয়েদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। এর ফলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। আমাদের এই রকম উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে, যাতে মেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায়, বাবা-মা যাতে মেয়েদের শিক্ষাজীবন শেষ করার পর বিয়ের আয়োজন করেন।

তৌহিদা খন্দকার
বাল্যবিবাহ আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। আমি আইনগত দিক থেকে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই। দেশে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইন আছে। এটি ১৯২৯ সালে প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এর কোনো প্রয়োগ নেই। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি এই আইনের আওতায় একটিও মামলা হতে দেখিনি। কারণ, আইনটিতে অনেক ফাঁকফোকর আছে।
আরেকটি আইন আছে, মুসলিম বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪। এটিরও সঠিক প্রয়োগ নেই।
আমাদের সংগঠন মহিলা আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশন নারী ও শিশুদের অধিকার উন্নত করতে ভূমিকা রাখছে। আমরা লৈঙ্গিক সমতা বিধানের জন্যও কাজ করছি। আমরা স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, যাতে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১২-তে বিএডব্লিউএল হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছে বাল্যবিবাহ বন্ধে নির্দেশনা পাওয়ার জন্য। আরেকটি আবেদন ছিল, বর ও কনেকে বয়স প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
আরেকটি হলো, সরকারি কার্যালয়ে বাল্যবিবাহের একটি সাংখ্যিক হিসাব রাখা। সেই সঙ্গে স্ত্রীকে মোহরানার অর্থ পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করা। মোহরানা একজন নারীর অধিকার। আরেকটি আবেদন ছিল, বিদ্যমান আইনের সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। নতুন আইন প্রণয়নের আগে আমরা উচ্চ আদালতের কাছে একটি দিকনির্দেশনার আবেদন করেছিলাম। বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত কোনো নতুন আইন প্রণীত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই দিকনির্দেশনাগুলোই আইন হিসেবে পরিগণিত হবে।
আমাদের বর্তমান যে আইনটি রয়েছে, সেখানে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ একটি অপরাধ। কিন্তু বাল্যবিবাহ বাতিলযোগ্য নয়। এটা আইনে একটা স্ববিরোধী বিষয় বলে আমি মনে করি।
আরেকটি ব্যাপার হলো, কাজিদের বিয়ে নিবন্ধনের অনুমোদন আছে। কিন্তু বিবাহ আইন সম্পর্কে তাঁদের সঠিক ধারণা নেই। বিএনডব্লিউএলএ তৃণমূল পর্যায়ে সচেতন করতে অনেক কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে ভালো অভিভাবকত্ব, অভিভাবকদের ইতিবাচক নিয়ম, যাতে তারা শিশুদের সম্পর্কে সচেতন হয়, তৃণমূল পর্যায়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের সংগঠন কর্মসূচি চালায়।
সবশেষে বলব, বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

আর্থার এরকেন
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ক্ষতিটা সব সময়ই জনগণের দিকে যায়। আমি নেদারল্যান্ডের অধিবাসী। সেখানে আইন প্রচলিত রীতিনীতিকে অনুসরণ করে। জনসাধারণ যা চায়, সংসদ বা আইনসভা সব সময় তার পেছনে থাকে। অর্থাৎ, জনগণের চাওয়াকেই তারা প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে আইন গণমানুষের চাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, কিন্তু আইন পাস হয়ে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে বাল্যবিবাহ গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কারণ, দরিদ্র ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে এটি সংগত মনে করা হয়।
সুতরাং, আপনাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে একজন বাবা তাঁর মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এর জন্য আমাদের ধর্মীয় সম্প্রদায় ও শিক্ষকদের এ ব্যাপারে বোঝাতে হবে। তাঁরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। আপনি যদি সত্তরের দশকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের উপাত্তগুলো তুলনা করেন, দেখবেন ১৬ বছরের মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে কম যৌতুক দিতে হচ্ছে বা একেবারেই দিতে হচ্ছে না। তাই বলে যৌতুকপ্রথা বন্ধ হয়নি। বরং আরও বেড়েছে।

শাহেদুল আনাম খান
মেয়েরা ঘরে কাজ করে। কিন্তু তাদের কাজগুলোকে অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে মনে করা হয় না। মনে করা হয় নারীর কাজের কোনো অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই। এ কারণে নারীকে পুরুষের বোঝা মনে করা হয়।

মামুনুর রশীদ
আমি বিবাহ নিবন্ধন আইনের ভেতরের একটি অসামঞ্জস্য নিয়ে কথা বলতে চাই। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, সরকার সব বিবাহ নিবন্ধকের কাছে একটি পরিপত্র পাঠিয়েছিল এই মর্মে যে, বিয়ের সময় জন্ম নিবন্ধন সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করতে হবে। কিন্তু দেখা গেল, নিবন্ধন ফরমে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বর লেখার কোনো ঘর নেই। এর ফলে প্রকৃতভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। শেষ পর্যন্ত ওই পরিপত্রের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, বিষয়টি যেন ফরমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, যেহেতু আইনটি যথেষ্ট নয় এবং বিভিন্ন মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা কি অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারি? যেমন আমরা কি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যেসব মেয়ের বিয়ে হবে না, তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতে পারি? ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে অনেক টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এতে জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতেও সাহায্য করবে, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বোঝাও কমাবে।

তানভীর ওয়াহিদ
বাল্যবিবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করতে চাই, যেটা আমাদের দেশের জন্য আশঙ্কাজনক। প্রথমটি হচ্ছে, সম্প্রতি বিবিসি একটি সংবাদ প্রচার করেছে, বাংলাদেশের বাল্যবিবাহের হার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয়টি হলো, বাংলাদেশি মেয়েদের ৬৬ শতাংশেরই বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগে। শেষটি হলো, ২০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছর হওয়ার আগেই। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই ইস্যুতে আমাদের চারটি জানার বিষয় রয়েছে।
এই সমস্যা দূর করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচিগুলোর ওপর জোর দেওয়া উচিত। শহর ও গ্রামের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। আর সচেতন করতে আমাদের পুরোনো আর নতুন কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। তরুণ প্রতিনিধি হিসেবে আমি তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি।
আমরা প্রতিটি জেলা-উপজেলায় নিবেদিতপ্রাণ তরুণদল গঠন করতে পারি। তারা তরুণদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাল্যবিবাহের কারণ, প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে বিষয়টিকে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারি। যেমন কুইজ, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন নির্মাণ প্রভৃতি। আমরা সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে এই বিষয়গুলো ব্যবহার করতে পারি।
এভাবেই আমরা সমস্যাটাকে কমাতে পারি।

আমিনুল ইসলাম
আমি দুটি পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে বাল্যবিবাহকে দেখতে চাই। এটি একটি সামাজিক প্রথা। আমরা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি। কমিউনিটি ক্লাব গঠনের মাধ্যমে যেখানে জনগণ এই ইস্যু নিয়ে কথা বলবে। এবং কীভাবে বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করতে হয়, এই কার্যক্রমের ফলে অপ্রাপ্তবয়স্করা এটা শিখবে।
আরেকটি দৃষ্টিকোণ হলো আইনের প্রয়োগ। আইনি প্রেক্ষাপটে বয়স নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। জন্ম নিবন্ধনপ্রক্রিয়া উন্নয়ন করার জন্য ইউনিসেফ সরকারকে সহযোগিতা করছে। একে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এ কারণে নকল সনদ খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। এবং খুব তাড়াতাড়ি একটি ঘোষণা আসবে যে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইলেকট্রনিকভাবে দেওয়া হবে।
আরেকটি দিক হলো, কাজিদের দিয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদের ব্যবহার, ডিজিটালাইজেশনের কারণে কাজিরা বুঝতে পারবে, সনদ আসল না নকল।

মাহফুজা রহমান
আপনারা শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির কথা বললেন। আমাদের ভাবতে হবে, কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করতে পারি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বিষয়ে শিক্ষকদের আলোচনা করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। তারা শ্রেণীকক্ষ, সমাবেশ, মা-বাবা ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। তাই শিক্ষকদের সচেতনতা, প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সনি সহেলি
আমরা আশপাশের মানুষকে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতন করতে পারি। বন্ধুদের এই বিষয়ে জানাতে পারি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। তা হলে আশা করি, বাল্যবিবাহের মতো ভয়াবহ একটি বিষয় অচিরেই বন্ধ হবে।

আর্থার এরকেন
গার্মেন্টশিল্পের বিকাশের কারণে নারীর কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এর ফলে নারী পরিবারে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্যকরতে পারছে। এতে নারীর কম বয়সে বিয়ের হার কমে যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে নারী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছে।
কী কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা নিয়ে কোনো মতৈক্য নেই। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ বাল্যবিবাহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন এ ক্ষেত্রে আইনের হস্তক্ষেপ দরকার। ইলেকট্রনিক জন্ম নিবন্ধন বাল্যবিবাহ রোধে অনেক সাহায্য করবে।
সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে, এই ইস্যুতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ রোধে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাল্যবিবাহ সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এ বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
যেসব মেয়ে স্কুলে যায়, তারা অনেক ক্ষেত্রে বান্ধবীদের বিয়ে বন্ধ করেছে। এটা তারুণ্যের ক্ষমতায়নের ফল। আমরা বলতে চাই, তরুণেরাই বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারবে। সবাইকে এ আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.