নজিরবিহীন অর্থ কেলেঙ্কারি-মামলার প্রস্তুতিই নেই সোনালী ব্যাংকের by শেখ শাফায়াত হোসেন

হলমার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে যে সাড়ে তিন হাজার কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করেছে, তা উদ্ধারের জন্য আদালতে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিই নেই সোনালী ব্যাংকের। লোপাট হয়ে যাওয়া এ বিশাল অঙ্কের টাকা ঋণ হিসেবে দেখানোর মতো প্রামাণ্য দলিল নেই সোনালী ব্যাংকের হাতে।


টাকার বিপরীতে হলমার্ক জামানত হিসেবে যে জমি দেখিয়েছে, তা অতিমূল্যায়িত বলে প্রমাণ পেয়েছেন সোনালী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষকরা। সে জমির দলিলপত্রের যথার্থতা নিয়েও নিশ্চিত নয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঋণ-সংক্রান্ত নথি সংগ্রহ ও স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি ব্যাংকটি। এ অবস্থায় সোনালী ব্যাংক টাকা উদ্ধারের জন্য অর্থঋণ আদালতে গেলে মামলার ভিত শক্ত হবে না বলে মনে করেন ব্যাংকের একজন আইনজীবী। তা ছাড়া স্বীকৃত বিলের বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা দায় পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতাও রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ভাষ্য মতে, তাদের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হাতিয়ে নেওয়া তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকার মধ্যে এক হাজার ৬৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা নন-ফান্ডেড, যার মধ্যে ভুয়া ঋণপত্রের মাধ্যমে নেওয়া এক হাজার কোটি টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
হলমার্ক একাই হাতিয়ে নিয়েছে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নগদে তুলে নেওয়ার দায়ে হলমার্ক ও ব্যাংকের ২৭ জনকে অভিযুক্ত করে ১১টি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আরো প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা স্বীকৃত বিলের বিপরীতে অন্য ২৬টি ব্যাংক শাখা থেকে নেওয়া হয়েছে, যা সোনালী ব্যাংককেই শোধ করতে হবে। এসব নন-ফান্ডেড দায় এখনো সোনালী ব্যাংক শোধ করতে পারেনি। এই টাকা পরিশোধ করার পরই অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারবে ব্যাংকটি। বর্তমানে ঋণ-সংক্রান্ত নথি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়।
টাকা আদায়ের জন্য মামলা করতে গতকাল দুদকের দেওয়া হুঁশিয়ারির বিষয়ে সোনালী ব্যাংক বলেছে, এ ব্যাপারে দুদকের পক্ষ থেকে লিখিত কোনো চিঠি তারা পায়নি। গণমাধ্যমে জেনেছেন। তবে প্রথামিকভাবে ফান্ডেড দায়টুকু আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে যাওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তবে এই ফান্ডেড দায়েরও বেশির ভাগের নথিপত্র এখনো সমৃদ্ধ করা যায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এটাকে তো ঋণ বলা যাবে না; এটা প্রতারণা। এ বিষয়ে গত ২৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার বলেছিলেন, বিপুল পরিমাণ এই ঋণের কোনো কাগজপত্রই সংরক্ষণ করেননি ওই শাখার কর্মকর্তারা।
এদিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশ অনুযায়ী ঋণের ২৫ শতাংশ নগদ অর্থে আদায়ের বিষয়েও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৩১ কোটি ৫১ লাখ টাকা আদায়ে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকটি। হলমার্ক গ্রুপের ঘোষণা অনুযায়ী দুই হাজার ৩১১ কোটি ৫০ লাখ টাকার সম্পত্তি বন্ধক দেওয়া হয়েছে এবং আরো ৮৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এসব সম্পত্তি আদৌ আছে কি না তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সোনালী ব্যাংকের দুটি দল কাজ করছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকে দাবি করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ওই সম্পত্তি দেখতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেছেন, এসব জমির ১০ ভাগের ৯ ভাগ পানির নিচে রয়েছে। আর যে বিপুল পরিমাণ জমি জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র আড়াই বিঘা জমি পার্টির নামে রয়েছে। বাকি জমির বায়নানামা করা হয়েছে। তাঁর মতে, এসব জমির দামও হবে উল্লেখিত দামের অনেক কম।
টাকা উদ্ধারের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত লিখিত এক বক্তব্যে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা ঋণে পরিণত করে প্রয়োজনীয় নথি তৈরির কাজ চলছে। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার কাজও এখনো শেষ হয়নি। কাজগুলো শেষ হলে শিগগির অনাদায়ী টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হবে।'
লিখিতভাবে ঋণের দায় স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ১ অক্টোবর ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছয়টি ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্মকর্তাদের প্রধান কার্যালয়ে ডেকে পাঠায় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আইনি লড়াইয়ের জন্য এ ধরনের নথি অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে বক্তব্যও দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তবে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার আগে নন-ফান্ডেড দায় পরিশোধের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে যাওয়াটা এখনো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কেননা নন-ফান্ডেড দায় পরিশোধ না করা হলে ওই ঋণ সোনালী ব্যাংকের নামে দেখানোর বিষয়ে আইনে কিছু জটিলতা রয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে সোনালী ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপসহ ছয়টি ব্যবসায়ী গ্রুপ বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়ে দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসের এই বৃহত্তম জালিয়াতির ঘটনা। সোনালী ব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক এ ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করে গত ১৫ জুলাই। নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গত ৪ অক্টোবর এই ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের ২০ জন ও হলমার্কের সাতজন কর্মকর্তাকে আসামি করে রমনা থানায় ১১টি মামলা দায়ের করে দুদক। গতকাল দুদকের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, জালিয়াতি হওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য সোনালী ব্যাংককেই মামলা করতে হবে, নইলে দুদক ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেবে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

No comments

Powered by Blogger.