পুরোনো জাহাজ আমদানি বেড়েছে বাড়ছে দুর্ঘটনা by প্রণব বল

পুরোনো জাহাজ আমদানিতে দেশে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৬ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে আমদানি হয়েছে ১৪০টি পুরোনো জাহাজ। ২০১১ সালে আমদানি হয় ১২২টি জাহাজ।


পুরোনো জাহাজ আমদানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ বছর নতুন করে ২৫টি জাহাজভাঙা ইয়ার্ড গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে। এ নিয়ে সেখানে ইয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়াল ১০০।
জাহাজ ভাঙার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনাও। গত তিন মাসে অন্তত ১০টি দুর্ঘটনায় ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের পরিবেশ রক্ষায় প্রণীত বিধিমালা ও আদালতের নির্দেশ যথাযথভাবে না মানার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সম্প্রতি বেশ কটি ইয়ার্ডে সরেজমিনে গিয়ে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত পূরণে সেই পুরোনো অবহেলাই চোখে পড়েছে। শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি ইয়ার্ডের জাহাজভাঙা শ্রমিকদের বিশেষ পোশাক ও মাথায় হেলমেট পরার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ১০টির মতো ইয়ার্ডে গিয়ে কোনোটিতেই শ্রমিকদের বিশেষ পোশাক ও হেলমেট পরে কাজ করতে দেখা যায়নি। পুরোনো জাহাজের বর্জ্য তেল সমুদ্রে না ফেলার কথাও বলা আছে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্তে। কিন্তু সীতাকুণ্ড উপকূলের ইয়ার্ডসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে বিষাক্ত বর্জ্য তেল ভাসতে দেখা যায় প্রায় সব সময়ই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় বেশি মনোযোগী। শ্রমিক স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগ কম, যে কারণে দুর্ঘটনা ও দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না। পুরোনো জাহাজ আমদানিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হওয়া প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশ যাতে শিল্পোন্নত দেশের বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত না হয়।
জাহাজভাঙা শিল্পকে পরিবেশসম্মতভাবে পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিধিমালা আগে থেকেই ছিল। শিল্প মন্ত্রণালয় গত বছর আরেকটি বিধিমালা তৈরি করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ইয়ার্ড তা অমান্য করেই চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আগে জাহাজভাঙা শিল্পগুলোকে শর্ত লঙ্ঘনের অপরাধে জরিমানা করা হতো। শিল্প মন্ত্রণালয় এই শিল্পের তদারকির দায়িত্ব নেওয়ার পর তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে।
দূষণ, ঝুঁকি: পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ১ সেপ্টেম্বর ম্যাকস স্টিল করপোরেশন নামের একটি ইয়ার্ড জাহাজের পোড়া তেল ও বর্জ্য সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। এতে ওই এলাকায় মাছও মরে ভেসে ওঠে। নিয়মানুযায়ী, ইয়ার্ডের মধ্যে জাহাজে পাওয়া এই তেল স্টোরেজ ট্যাংকে রাখার কথা। পরে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটিকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রাইম স্টিল, ইউনাইটেড স্টিল নামের ইয়ার্ডগুলোতে সুরক্ষার জন্য থাকা ইউনিফর্ম ছাড়াই শ্রমিকেরা কাজ করছেন। শ্রমিকেরা খালি হাতে জাহাজের কাটা লোহার প্লেট ও মোটা মোটা শিকল আনা-নেওয়া করছেন। তাঁদের মাথায় হেলমেটও ছিল না।
সাংসদপুত্রের ইয়ার্ডে শর্ত লঙ্ঘন: পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৫৬টি শর্ত পূরণ করে সীতাকুণ্ডের এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়পত্র পায়। কিন্তু পদে পদে তারা শর্ত লঙ্ঘন করে। খোদ সীতাকুণ্ড আসনের সাংসদ এ বি এম আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে এস এম আল মামুনের ইয়ার্ড এস আর এস শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৭ জুলাই সীতাকুণ্ডের কুমিরা জোড়াআমতল এলাকার দুর্ঘটনায় খোরশেদ আলম (২০) নামের এক শ্রমিক নিহত হন। সাংসদপুত্রের মালিকানাধীন ওই ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা ঘটে ওই দিন ভোররাত চারটার দিকে। বিধিমালা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের শর্ত অনুযায়ী রাতে ইয়ার্ডে কাজ করা নিষিদ্ধ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জাফর আলম বলেন, ‘আমাদের শর্তের মধ্যে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, রাতে কাজ করা যাবে না। তার পরও যদি রাতে কাজ চলাকালীন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তা হলে শ্রম দপ্তর বিষয়টা দেখবে।’
একই ইয়ার্ডে বারবার দুর্ঘটনা: সীমা স্টিল নামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে গত ২ মে দুর্ঘটনায় মারা যান এক শ্রমিক। এর দুই মাস আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি সেখানে আরও এক শ্রমিক নিহত হন। ২০১০ সালের ৯ অক্টোবর সীমা স্টিলে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত ও অপর দুই শ্রমিক আহত হন।
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে: প্রতিমাসে গড়ে দু-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটছে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে। গত ৮ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় দুই শ্রমিক নিহত হন। সাঈদ স্টিল ও কেএসবি শিপইয়ার্ডে ওই দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে ১ আগস্ট ইউনাইটেড ও ৫ আগস্ট মিসম্যাক শিপইয়ার্ডে দুটি দুর্ঘটনায় দুই শ্রমিক মারা যান। ২৯ জুলাই একজন এবং জুন মাসে মৃত্যু হয় দুই শ্রমিকের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁদের কারও পরনে সুরক্ষা পোশাক ছিল না।
গত বছরের ১৬ অক্টোবর জিরি সুবেদার স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিল বিস্ফোরক ছাড়পত্র না নিয়ে জাহাজের গ্যাস অবমুক্ত করতে গিয়েছিল। এতে চার শ্রমিক নিহত হন। একই বছরের ১২ অক্টোবর কে আর স্টিল মিলে দুর্ঘটনার সময়ও শ্রমিকদের গায়ে কোনো সুরক্ষা পোশাক ছিল না। এতে একজনের মৃত্যু হয়।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর, গ্রিনপিস ও বেলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে ১২ জন, ২০০৯ সালে ২৩ জন, ২০০৮ সালে ১৫ জন, ২০০৭ সালে আটজন, ২০০৬ সালে ১০ জন, ২০০৫ সালে ৭ জন, ২০০৪ সালে তিনজন শ্রমিক জাহাজভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এর আগে ২০০০ সালে ২০ শ্রমিক মারা যান শিপইয়ার্ডে।
দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি হেফাজেতুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। আমাদের শ্রমিক সুরক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা আছে। তবে শ্রমিকেরা অনেক সময় এগুলো ব্যবহার করতে চান না। সে কারণে কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। আর দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে কার্যালয় স্থাপন করে তদারক করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যেখানে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানে গিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

No comments

Powered by Blogger.