স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাজানো নাটক by লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)
মহাজোট সরকার তাদের শাসনামলে হতাশা ছাড়া জনগণকে আর কিছুই উপহার দিতে পারেনি। মঙ্গলবার নতুন করে হতাশ হতে হলো দেশের মানুষকে। দেশের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন একটি নাটকের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন।
তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে স্ববিরোধিতা। তাঁকে যা বলতে বলা হয়েছে, যে কাগজ তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তিনি তোতাপাখির মতো তা-ই আওড়ে গেছেন- এমন ধারণা এখন করাই যেতে পারে। তাঁর বক্তব্যের পক্ষে তিনি কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি। দিতে পারেননি কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা। ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেওয়ার দক্ষতা যে তাঁর আছে, সেটা তিনি বেশ দেখিয়ে দিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২৫ সেপ্টেম্বর মহীউদ্দীন খান আলমগীর আশা প্রকাশ করেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। এক দিন আগেই তিনি সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেন। তাতে রহস্য উদ্ঘাটিত হলো নাকি আরো ঘনীভূত হলো- সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যেতে পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে গত ১১ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তাঁর স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি'র কথা বলেন। কিন্তু এর পরও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ আদালতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নেয়। এরপর উচ্চ আদালত র্যাবকে মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তারপর কী ঘটেছে সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন, দেশের মানুষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশের ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একটি সময় বেঁধে দিয়েছিলেন, তখন সবাই এটাকে নিছকই কথার কথা হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু তিনি যখন এক দিন আগেই এ বিষয়ে ব্রিফিং করতে ডাকলেন, তখন সবারই একটু নড়েচড়ে বসার কথা। শুরুতে যখন তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন মনে হয়েছে কাজটা অত্যন্ত সহজ। এই সহজ কাজটি করতে কেন এত দিন সময় লাগল এটা মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য স্ববিরোধী তো বটেই, একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অন্য কারো অপরাধ ঢাকতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন, এমন ধারণা হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন সাতজনকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার সাতজনের একজন সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর। আরেকজন তাঁদের বাড়ির এক পাহারাদার। বাকি পাঁচজন হলেন ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই হত্যামামলার আসামি। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে সাগর-রুনির বাড়ির আরেক পাহারাদার হুমায়ুন কবিরকেও শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। কবিরকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন তিনি। অথচ এই পাহারাদারকে আগে একবার ধরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন দক্ষ আমলা, যোগ্য প্রশাসক। তিনি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেপ্তারের খবর জানাতে পারলেও খুনের কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে পারলেন না কেন? আসামি যদি শনাক্ত করা যায়, তারা যদি আইনের আওতায় থাকে, তাহলে খুনের মোটিভ জানা কি খুবই কষ্টের কাজ? না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলন। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনিও। তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। মনে হয়েছে তিনি কারো স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই সংবাদ সম্মেলনের পর বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, সেটাও প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, 'এত দিনে একজন খুনিরও নাম প্রকাশ হয়নি। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাতজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের কথা বলেছেন। মন্ত্রী বলেছেন, সাতজনের মধ্যে পাঁচজন পেশাদার খুনি। এর মাধ্যমে এ মামলার অগ্রগতি শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা জানতে চাই গ্রেপ্তারকৃতদের কারা হত্যাকাণ্ডে উৎসাহ দিয়েছিল।' কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছেন না বিএফইউজের সভাপতি। তিনি বলেছেন, 'আমরা তখনই সন্তুষ্ট হব যখন হত্যাকাণ্ডের মোটিভ জানা যাবে এবং অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার হবে।' ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেছেন, 'সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। তাঁর উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়ে একটি খণ্ডচিত্র মাত্র।' তবে আশাবাদী রিপোর্টার্স ইউনিটি সভাপতি এভাবে আশান্বিত হতে চান যে 'এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে, সে বিষয়ে দীর্ঘদিন আমরা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বিষয়টি আংশিক পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু যাদের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থাপন করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের কী স্বার্থ ছিল- তা তিনি পরিষ্কার করেননি। আমরা কোনো জজমিয়া নাটক মেনে নেব না। পুরো রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।'
মন্ত্রীর বক্তব্যের পর রুনির ভাই রোমান বলেছেন, 'সাগর ভাই ও রুনি আপার কাছে এ নাম কখনো শুনিনি এবং তাকে আমরা চিনিও না।'
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, 'সাংবাদিকদের ডেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন চারজনকে খুঁজে পেয়েছেন। এত দিন পর সরকার সাংবাদিক দম্পতি হত্যার ঘটনাকে এভাবে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই সাধারণ চোরদের গ্রেপ্তারের কথা বলছে।'
সংবাদ সম্মেলনের কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মতো একজন ডাকসাইটে আমলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কোনো কোনো সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাবও তিনি দিতে পারেননি। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পেশাদার খুনিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পেশাদার খুনিদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে কিংবা এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ কী- এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি। আবার সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন, খুনিরা ভাড়াটে ছিল কি না তখনো তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেননি। সাংবাদিকদের কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে আবার কোনো কোনো প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করেন সংবাদ সম্মেলন।
কিন্তু তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে একটা অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও সেই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সাধারণ মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি। বরং এর পেছনে নতুন রহস্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ঘটনার নেপথ্যে অনেক বড় কোনো শক্তি কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। সরকার এখন সেই শক্তিকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নতুন নাটক একেবারেই জমল না। ওপরমহলের কুর্কীতি ঢাকতে গিয়ে তিনি নিজেই জজমিয়া প্রসঙ্গ টেনে এসে যেন 'ঠাকুর ঘরে কে রে...'- প্রচলিত এই কথাটি আবার মনে করিয়ে দিলেন।
লেখক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান
একটু পেছনে ফিরে দেখা যেতে পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে গত ১১ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তাঁর স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি'র কথা বলেন। কিন্তু এর পরও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ আদালতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নেয়। এরপর উচ্চ আদালত র্যাবকে মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তারপর কী ঘটেছে সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন, দেশের মানুষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশের ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একটি সময় বেঁধে দিয়েছিলেন, তখন সবাই এটাকে নিছকই কথার কথা হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু তিনি যখন এক দিন আগেই এ বিষয়ে ব্রিফিং করতে ডাকলেন, তখন সবারই একটু নড়েচড়ে বসার কথা। শুরুতে যখন তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন মনে হয়েছে কাজটা অত্যন্ত সহজ। এই সহজ কাজটি করতে কেন এত দিন সময় লাগল এটা মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য স্ববিরোধী তো বটেই, একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অন্য কারো অপরাধ ঢাকতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন, এমন ধারণা হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন সাতজনকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার সাতজনের একজন সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর। আরেকজন তাঁদের বাড়ির এক পাহারাদার। বাকি পাঁচজন হলেন ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই হত্যামামলার আসামি। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে সাগর-রুনির বাড়ির আরেক পাহারাদার হুমায়ুন কবিরকেও শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। কবিরকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন তিনি। অথচ এই পাহারাদারকে আগে একবার ধরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন দক্ষ আমলা, যোগ্য প্রশাসক। তিনি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেপ্তারের খবর জানাতে পারলেও খুনের কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে পারলেন না কেন? আসামি যদি শনাক্ত করা যায়, তারা যদি আইনের আওতায় থাকে, তাহলে খুনের মোটিভ জানা কি খুবই কষ্টের কাজ? না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলন। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনিও। তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। মনে হয়েছে তিনি কারো স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই সংবাদ সম্মেলনের পর বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, সেটাও প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, 'এত দিনে একজন খুনিরও নাম প্রকাশ হয়নি। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাতজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের কথা বলেছেন। মন্ত্রী বলেছেন, সাতজনের মধ্যে পাঁচজন পেশাদার খুনি। এর মাধ্যমে এ মামলার অগ্রগতি শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা জানতে চাই গ্রেপ্তারকৃতদের কারা হত্যাকাণ্ডে উৎসাহ দিয়েছিল।' কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছেন না বিএফইউজের সভাপতি। তিনি বলেছেন, 'আমরা তখনই সন্তুষ্ট হব যখন হত্যাকাণ্ডের মোটিভ জানা যাবে এবং অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার হবে।' ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেছেন, 'সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। তাঁর উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়ে একটি খণ্ডচিত্র মাত্র।' তবে আশাবাদী রিপোর্টার্স ইউনিটি সভাপতি এভাবে আশান্বিত হতে চান যে 'এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে, সে বিষয়ে দীর্ঘদিন আমরা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বিষয়টি আংশিক পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু যাদের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থাপন করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের কী স্বার্থ ছিল- তা তিনি পরিষ্কার করেননি। আমরা কোনো জজমিয়া নাটক মেনে নেব না। পুরো রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।'
মন্ত্রীর বক্তব্যের পর রুনির ভাই রোমান বলেছেন, 'সাগর ভাই ও রুনি আপার কাছে এ নাম কখনো শুনিনি এবং তাকে আমরা চিনিও না।'
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, 'সাংবাদিকদের ডেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন চারজনকে খুঁজে পেয়েছেন। এত দিন পর সরকার সাংবাদিক দম্পতি হত্যার ঘটনাকে এভাবে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই সাধারণ চোরদের গ্রেপ্তারের কথা বলছে।'
সংবাদ সম্মেলনের কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মতো একজন ডাকসাইটে আমলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কোনো কোনো সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাবও তিনি দিতে পারেননি। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পেশাদার খুনিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পেশাদার খুনিদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে কিংবা এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ কী- এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি। আবার সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন, খুনিরা ভাড়াটে ছিল কি না তখনো তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেননি। সাংবাদিকদের কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে আবার কোনো কোনো প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করেন সংবাদ সম্মেলন।
কিন্তু তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে একটা অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও সেই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সাধারণ মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি। বরং এর পেছনে নতুন রহস্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ঘটনার নেপথ্যে অনেক বড় কোনো শক্তি কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। সরকার এখন সেই শক্তিকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নতুন নাটক একেবারেই জমল না। ওপরমহলের কুর্কীতি ঢাকতে গিয়ে তিনি নিজেই জজমিয়া প্রসঙ্গ টেনে এসে যেন 'ঠাকুর ঘরে কে রে...'- প্রচলিত এই কথাটি আবার মনে করিয়ে দিলেন।
লেখক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান
No comments