জালিয়াত চক্র- রেজিস্ট্রি অফিস ঘিরে সক্রিয় 0 নকল মালিক, নকল দাতা-গ্রহীতা ভুয়া দলিল! খাস জমি আর অর্পিত সম্পত্তির তিন- -চতুর্থাংশ ইতোমধ্যে বেদখল! by ফজলে নোমানী

প্রতিদিনের মতোই এজলাসে উঠেছেন উত্তরা জোনের সাব-রেজিস্ট্রার। এজলাসের চারপাশে শত শত লোকের ভিড়। একশ্রেণীর দালাল অপ্রয়োজনে সেখানে ভিড় করে রাখে। দলিল হসত্মানত্মর বা রেজিস্ট্রি করার সময় রেজিস্ট্রারের সামনেই স্বাৰর করার বিধান থাকায় তিনি এজলাসে বসে থকেন।


অনেক সময় দাতা এবং গ্রহীতা নকল কি না, তা বোঝার জন্য দু'একটি প্রশ্নও করেন রেজিস্ট্রার। এর মধ্যেই দলে দলে লোক ধাক্কাধাক্কি করে এজলাসে উঠে যাবার চেষ্টা করতে থাকায় এর বেশি 'ক্রস চেক' করা সম্ভব হয় না। তবে এর মধ্যেই তিনি কয়েকটি দলিল জালিয়াতির বিষয় ধরে ফেলায় বৃহস্পতিবার এজলাসে বসেই দাতা এবং গ্রহীতা নিয়ে তঁাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো।

ঘটনাস্থল, তেজগাঁও ভূমি রেজিস্ট্রি কমপেস্নঙ্
দলিলদাতা দু'জনের নাম জানলেন_ একজন শ্রীহরি সরকার এবং অপরজন তার ভাই জয়হরি সরকার। তিনি এজলাসের পাশে প্রথমে এক ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা ক'ভাই- বোন? শ্রীহরি সরকার জানাল, তাদের আর কোন ওয়ারিশ নেই। তারা দুই ভাই। আর জয়হরিকে পরে আলাদা করে একটু ধমকের সুরে সত্য বলার জন্য একই প্রশ্ন করলেন। জয়হরি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে ফেলল, তারা দুই ভাই, দুই বোন। পরে রেজিস্ট্রি অফিসের চৌহদ্দীতে খোঁজ করে দলিল গ্রহীতাকেও পাওয়া গেল। ইতোমধ্যে কর্মচারীরা কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়ায় কারোই পালানোর উপায় ছিল না। পরে জানা গেল, শ্রীহরির প্রকৃত নাম স্বপন কুমার এবং জয়হরির প্রকৃত নাম স্বপন মজুমদার; যারা ভাই তো ননই বরং জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ভুয়া দলিল করে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৫নং রোডের ৫২ নং বাড়িটি করায়ত্ত করার জন্যই ভুয়া মালিক এবং দাতা-গ্র্রহীতা সাজিয়ে এনেছেন। প্রায় ৩ কাঠার পস্নটটি আত্মসাত করার অভিযোগে স্বপন কুমার ও স্বপন মজুমদারসহ গ্রহীতা রতন কুমার এবং দলিল শনাক্তকারী গোপাল চন্দ্র সরকারকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। দলিল লেখক প্রদীপ সরকার ওরফে প্রদীপকে ( সনদ নং- ৬/২০০৪) এসআর অফিস তেজগাঁওতে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না। তাকেসহ এই দলিলের দুই সাৰী এবং জালিয়াত চক্রের সদস্য হিসেবে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সমীৰা অনুযায়ী, দেশের খাস জমি বা অর্পিত সম্পত্তির তিনচতুর্থাংশই বেদখল হয়ে গেছে। দেশের ২০ ভাগ লোক ভোগ করছে দেশের ৮০ শতাংশ ভূসম্পত্তি। যে কারণে ধনী-গরিবের বৈষম্য কেবল বেড়েই চলেছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, মিরপুর, মেরম্নল, বাড্ডা, পূর্বাঞ্চলের নিচু জমি এমনকি গুলশান এবং রামপুরার আশপাশের জলাধার বা খাস জমিসহ গরিবদের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি প্রতিদিনই এভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ৰেত্রেই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমিদসু্যরা এই সম্পত্তি গ্রাসের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে ভূমিদসু্যদের ভূমি দখলের মচ্ছব। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে রাজধানীজুড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক ভূমি জালিয়াত চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে মহানগর পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দৈনিক ভূমিসংক্রানত্ম ৩/৪টি জিডি এবং মামলা রম্নজুর ঘটনা ঘটে চলেছে। মূল মালিকের দলিল থাকার পরও জালিয়াত চক্র জাল দলিল করে প্রথমে বৈধ দখলদারদের ্পুলিশ প্রশাসন বা পেশীশক্তির বলে উচ্ছেদ করে। পরে সেখানেই পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নেয়। এ নিয়ে বছরের পর বছর আদালতে মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয় সাধারণ মানুষ। কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এ ধরনের ভূমি দখলের পর পুলিশের উপস্থিতিতে শালিস-মীমাংসা হবার ঘটনা অহরহই ঘটছে। নিঃস্ব প্রকৃত মালিকরা পরে কিছু টাকার বিনিময়ে সে জায়গার দাবিও এক সময় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সরাদেশেই ভূমি দখলের একই চিত্র বলে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন। অর্পিত সম্পত্তি, এর আগে যার নাম ছিল শত্রম্নসম্পত্তি; তার মালিক হিন্দু হওয়ায় অধিকাংশ ৰেত্রেই নকল হিন্দু মালিক সাজিয়ে তা আত্মসাত করা হচ্ছে। একবার রেজিস্ট্রারের এজলাস পার হয়ে জায়গা দখল করে ফেললে তা উদ্ধার করা যে কি কঠিন, তা স্বীকার করলেন ঢাকার রেজিস্ট্রার আব্দুস সামাদ। সম্প্রতি, এ ধরনের ৬ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ায় ১৯ জনকে তাঁরা পুলিশে সোপর্দ করেছেন । পাওয়ার অব এ্যাটর্নি বা চলতি ভাষায় পাওয়ার দলিল হসত্মানত্মরের সময় দাতা-গ্রহীতার ছবি থাকার বিধান না থাকায় এ ধরনের জালিয়াতি প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে বলে জানা গেল। পাওয়ার দলিলে দাতা এবং গ্রহীতার ছবি রাখার বিধান করার জন্য ইতোমধ্যে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বলে আব্দুস সামাদ জনকণ্ঠকে জানান।
কিছু জালিয়াতির নমুনা
এক/এগারো পরবতর্ী একজন ভুয়া লে. কর্নেল সেজে গুলশান থানাধীন ১১৬ নং রোডের ২৩ নং হোল্ডিংয়ের সম্পত্তি হসত্মানত্মর করার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। সে সময় লে. কর্নেল সাহেব নিজেই নাকি এজলাসের পাশে উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে সংশিস্নষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার সূত্র মতে, লে. কর্নেল জাহিদ নামের লোকটি এজলাসের পাশে উপস্থিত থাকলেও একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাধারণত এই ধরনের র্যাংকধারী কর্মকর্তারা এলে নিজেই এজলাসের পাশে এসে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এই লোকটিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে অতিশয় ভদ্র না হয় ফ্রড বলেই কর্তব্যরত সাব-রেজিস্ট্রারের সন্দেহ হলো। তাকে বিনয়ের সঙ্গে কিছু প্রশ্ন করার জন্য এজলাসের পাশে ডেকে নেয়া হলো। এগুলো ফর্মালিটি বিধায় তাকে যথাযথ উত্তর দেয়ার অনুরোধও করা হলো। পরিচয়পত্রও একটি যোগাড় করেছিলেন ওই ভুয়া কর্নেল। কর্নেল (?) সাহেব নিজের পরিচয়, বাবার নাম, মায়ের নাম, জমির অবস্থান অনর্গল বলে গেলেন। তার পরও উত্তর দেয়ার সময় তার কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সন্দেহ থেকেই গেল। তার জন্ম তারিখ জিজ্ঞেস করাতে এবার কর্নেল সাহেব বলতে পারলেন না। রেজিস্ট্রি দলিলে তার জন্ম তারিখ ২৫ নবেম্বর ১৯৫৫ সাল উলেস্নখ ছিল। জন্ম তারিখ বলতে না পারায় এবার তার বয়স জিজ্ঞাসা করা হলো। উত্তর এলো ৪৫ বছর। কিন্তু, হিসেবে তার বয়স ৫০-এর উর্ধে হওয়ায় তাকে পাশে দাঁড়াতে বলে পুলিশে খবর দেয়ায় তিনি ভুয়া বলে পুলিশ বের করে ফেলতে সমর্থ হলো। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার হলো, তিনি ভুয়া পরিচয়ে জাল দলিল তৈরি করে আসল লে. কর্নেল জাহিদের জায়গা অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সে সময় আসল কর্নেল জাহিদের নম্বর সংগ্রহ করে টেলিফোন করায় তিনি ঘটনা শুনে হতবাক। জালিয়াতির জন্য ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে এই জাল দলিল লেখানো হয়েছিল। ওই ব্যক্তির নাম জানা গেল শফিকুল ইসলাম। দলিলটির লেখক ছিলেন এমদাদ হোসেন (সনদ নং-১০৩) সূত্রাপূর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।
গেল মাসেই মোঃ জসিম এবং শরিফুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তিকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। জসিম নামের ব্যক্তিটি রণজিৎ ঘোষ সেজে তুরাগ থানাধীন হরিরামপুর ইউনিয়নের সিএস ২৬৭ নং মৌজার প্রায় ৫০ শতাংশ জমি হসত্মানত্মর করার পূর্বে ধরা পড়ে যান। দলিল লেখক নাসির হোসেনকে এ সময় ধরা সম্ভব হলে তিনি স্বীকার করেন, দলিলদাতা এবং গ্রহীতা কাউকেই তিনি চেনেন না । টাকার বিনিময়ে তিনি দলিলটি লিখে দিয়েছেন।
এর আগে একটি বড় ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে বলধা ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের মতো একটি রিয়াল এস্টেট কোম্পানির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। বাদশা মিয়া এবং ওসমান মিয়া নামের সহোদরকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে একজনের নাম ইউনুস মিয়া এবং অপরজনের নাম সুলতান দেওয়ান বলে জানা গেলে তাদেরও পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আর ঐ কোম্পানির ম্যানেজারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কতর্ৃপৰের বক্তব্য
উত্তরা জোনের সাব-রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারই এ পর্যনত্ম ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ধরা পড়া প্রায় সকল জালিয়াতির ঘটনা এজলাসে বসেই জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ধরে ফেলতে সৰম হন। তিনি বলেন, দেশকে দুনর্ীতিমুক্ত করার জন্য যার যার সেক্টরে সঠিক কর্তব্য পালন করলে অনেক জালিয়াতই আর এসব করতে সাহস পাবে না। তিনি অবিলম্বে ভূমি জালিয়াত চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে পাওয়ার দলিলের ৰেত্রে ছবিসহ দাতা এবং দলিল গ্রহীতার সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন বলেও মনত্মব্য করেন। এ পর্যনত্ম তাঁর নিজের কাছে ধরা পড়া ৬টি জালয়াতির ঘটনায় তিনি নিজেই বাদী হয়ে কোর্টে মামলা করেছেন বলেও জানালেন।

1 comment:

Powered by Blogger.