রাকিবের দ্বিতীয় জীবন
মো. রাকিব হোসেন। বয়স ৮। দ্বিতীয় শ্রেণী। রোল নম্বর ৬৯।রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।উদাম গায়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল ছেলেটা। আমরা তার খোঁজ করছি দেখেই ছুটে ঘরের ভেতর চলে গেল। একটু বাদেই ফিরল শার্ট গায়ে। ‘তা বলুন, কী জানতে চান’ ভঙ্গিতে মুখোমুখি বসল বটে, কিন্তু কথা বলার সময় গলার স্বর খুবই নিচু।
মুখ তুলে তাকায়ই না। স্বভাবসুলভ উচ্ছলতার মধ্যেও একটুখানি ভয়ার্ত চাহনি।
‘রাকিব, তুমি কখনো রূপকথার গল্প শুনেছ?’ জানতে চাই। রাকিব বিড়বিড় করে কী যেন বলে। হ্যাঁ বা না বোঝা যায় না। ‘এমন গল্প শুনেছ, এক দেশে ছিল রাজা-রানি। আর ছিল এক রাজকুমার। রাজকুমারের ভীষণ বুদ্ধি, আর অনেক সাহস। একদিন দুষ্ট লোকেরা রাজকুমারকে নদীতে ফেলে দিল। রাজকুমার কিন্তু তলিয়ে গেল না, ভাসতে ভাসতে চলে গেল এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। সেখানে এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে রাজকুমারকে পেল। জেলেদের সেবা-শুশ্রূষায় সে সুস্থ হয়ে উঠল। ফিরল নিজের রাজ্যে। শুনেছ এমন গল্প?’
রাকিব দুদিকে মাথা নাড়ে। আমরা বলি, ‘তুমি কিন্তু সেই রাজকুমারের মতো! তোমারও অনেক বুদ্ধি আর সাহস! আজকে তোমার গল্পটাই আমরা শুনব।’
রূপকথা, রাজকুমার—এসব শুনেই হয়তো রাকিব একটু সহজ হয়। আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে। মাঝে মাঝে কথা জুড়ে দেয় ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-চাচা আর গ্রামবাসী।
ভয়াল সন্ধ্যা
সেদিন সন্ধ্যায় রাকিব গিয়েছিল নেছার কাকার বাড়ি। একা একা। একটুখানি টিভি দেখে তারপর বাড়ি যাবে। কিন্তু কপাল মন্দ। গিয়ে দেখে লোডশেডিং। কী আর করা! হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরল রাকিব।
এমন সময় পথ আগলে দাঁড়াল দূরসম্পর্কের চাচা—জাফর।
জাফর চাচার সঙ্গে রাকিবের আগে থেকেই ভালো খাতির, মাঝেমধ্যেই চকলেট-চিপস কিনে দেন। জাফর চাচা বললেন তিনি ঢাকা যাবেন। ভুলিয়েভালিয়ে একপ্রকার জোর করেই রাকিবকে ঢাকা যেতে রাজি করিয়ে ফেললেন। খালের পাড় দিয়ে, খেতের মাঝ দিয়ে ঘুরেফিরে জাফর চাচা রাকিবকে নিয়ে যান। একসময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন চাঁদপুর শহর, লঞ্চঘাটে। উঠে পড়েন ঢাকাগামী লঞ্চ মিতালীতে। রাকিবকে শান্ত রাখতে জাফর তাকে একটা আরসি কোলা কিনে দেন। তবে রাকিবের ভাষ্যমতে, ‘আরসি কোলাটা পকেটে রাখছিলাম, পইড়া গেছে। খাইতে পারি নাই।’
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। লঞ্চ ছাড়তেই রাকিব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙে, লঞ্চ তখন মোহনপুর ঘাট পেরিয়ে এসেছে। রাকিব বুঝতে পারে, তার চিরচেনা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ঘোড়াশালা গ্রাম অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। সেখানে হয়তো মা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। রাত গভীর হচ্ছে। তা ছাড়া জাফর চাচার হাবভাব আর মোটেই ভালো ঠেকছে না। রাকিব বাড়ি যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। জাফর প্রথমে ধমক-ধামক দিয়ে রাকিবকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। শেষে বলেন, ‘আচ্ছা যা, তুই আগে লঞ্চের পেছনে গিয়া হাতমুখ ধুইয়া আয়।’
৩১ আগস্ট। রাত তখন একটা কি দেড়টা। আকাশে চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলো খেলা করছিল মেঘনার বুকে। রাকিব লঞ্চের পেছনে হাতমুখ ধুচ্ছিল। এমন সময় চাচা জাফর আট বছরের এই শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেন!
দিনের আলোয় নদী যতই চোখ জুড়াক, রাতের আঁধারে সেই নদীই দেখায় অতল গহ্বরের মতো! রাকিব বলছিল, ‘দুই দিক দিয়া লঞ্চ যায়, ট্রলার যায়। স্রোতের ধাক্কায় আমি দূরে চইলা যাই। মুখ খুইলা চিৎকার করতে গেলেই মুখে পানি ঢুইকা যায়। তারপর কী হইছে, আর মনে নাই।’
রাকিব যখন মাঝ মেঘনায় ভাসছে, পুরো ঘোড়াশালা গ্রাম তখন জেগে আছে।
রাকিবের সন্ধানে
সন্ধ্যা থেকেই রাকিবের মা রীনা বেগমের অস্থির অস্থির লাগছিল। ছোট ছেলে রাকিব বাড়ি ফেরেনি। চারদিকে খোঁজখবর করছেন, কেউই খুব একটা আমলে নিচ্ছে না। স্বামী আবুল হাসেম পাটোয়ারী থাকেন বাহরাইনে। একলা ঘরে ছেলেমেয়েগুলোই রীনা বেগমের সব। একটু পরপর জানালা দিয়ে মাথা বের করে ডাকছিলেন, ‘রাকিব, ও রাকিব! কই গেলি?’ রাকিবের সাড়া নেই। ঘরে এক মাস বয়সী বাচ্চা মেয়েটাকে ফেলে বেরও হতে পারছিলেন না রীনা। শরীরটাও খুব একটা ভালো না তাঁর। রীনা বলছিলেন, ‘প্রথম প্রথম ভাবছিলাম, হয়তো মাইরের ডরে কোনোহানে লুকায় আছে। পাশের বাড়িতে নতুন জামাই আসছে, হয়তো সেইখানে গেছে। রাত নয়টা বাইজা গেল, তখনো যহন আইলো না, তখন সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করল।’
ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেনের নির্দেশে রাত ১২টার দিকে এলাকায় মাইকিং শুরু হয়। চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। এর মধ্যে কীভাবে যেন রটে যায় রাকিবের ওপর জিন-ভূতের আসর হয়েছে। দুষ্ট অশরীরী হয়তো তাকে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে! দলে দলে লোক বেরিয়ে আসে টর্চ হাতে। প্রতিটা গাছ, আশপাশের সব বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। স্কুলঘর, মসজিদ...। এমনকি গ্রামের পুকুরগুলোতেও লোক নামানো হয়। গভীর রাত পর্যন্ত পুকুরগুলোতে খোঁজাখুঁজি চলে, ফলাফল শূন্য। কোথাও নেই রাকিব!
ঘরের ছেলে ঘরে
পরের ঘটনা গল্প-সিনেমার শুভ পরিণতির মতো। জাহাঙ্গীর রাকিবের খবর জানালেন সেখানকার মাছের আড়তে। বশিরউল্লাহ নামের একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যানের কাছে।
সকাল ১০টা নাগাদ রাকিবের চাচা আলী হোসেন খবর পান, বোরোচর গ্রামে রাকিব নামের একটা বাচ্চা ছেলে পাওয়া গেছে। রাকিবের মা রীনা বলছিলেন, ‘খবর পাইয়াই আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেছিলাম, আল্লাহ, এইডা জানি আমার রাকিবই হয়!’
গ্রামের মেম্বর, রাকিবের চাচা আলী হোসেনসহ আটজন গেলেন এখলাছপুর। আলী হোসেন বলছিলেন, ‘ট্রলার কাছাকাছি যাইতেই দেখি নদীর তীরে ওই গ্রামের শয়ে শয়ে মানুষ আমাগো লেইগা দাঁড়ায় আছে। এত মানুষের মইধ্যে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কোলে রাকিবরে দেইখাই আমার কলিজাটা জুড়ায় গেছে!’ বলতে বলতে চোখের পানি মোছেন চাচা আলী হোসেন।
রাকিবের মা, ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যান সবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে জাহাঙ্গীর রাকিবকে আলী হোসেনদের হাতে তুলে দেন। ১ সেপ্টেম্বর রাত নয়টা নাগাদ রাকিব মায়ের কাছে ফিরে আসে।
এদিকে সকালেই বাড়ি ফিরে চুপচাপ বসেছিলেন রাকিবের কথিত চাচা জাফর হোসেন। চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন ভুঁইয়া জানালেন, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সকালেই গ্রাম পুলিশ পাঠিয়ে জাফরকে নিয়ে আসি। কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সব ঘটনা জানার পর তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিই।’ বিল্লাল হোসেন আরও জানান, ধরা পড়ার পর জাফর তাঁকে বলছিল, ‘রাকিবরে যেইখানে ফালাইছি, ওইখানে আপনারে ফালাইলেও বাঁচতেন না। এই পোলা বাঁচল ক্যামনে?’
অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে জাফরের বিরুদ্ধে।
ঘোড়াশালা আর বোরোচর—দুই গ্রামের মধ্যে এখন দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জেলে পরিবারকে দাওয়াত করা হয়েছিল ঘোড়াশালা গ্রামে। রাকিবকে ফিরে পেয়ে একসঙ্গে আনন্দ করেছে সবাই। সবাই খুশি, শুধু খুশি হতে পারেনি একজন। জেলে জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে ইয়ামিন! চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়ে সে বলেছে, ‘রাকিব আমার ভাই! ওরে আমি যাইতে দিমু না!’
বোরোচরের জেলে
মতলবের উত্তরে দক্ষিণ বোরোচর গ্রামের জেলে জাহাঙ্গীর বেপারি। নদীতে চাঁই পেতে মাছ ধরেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে চারটা। জাহাঙ্গীর চাঁই পেতেছিলেন এখলাছপুরের কাছে, নদীর পশ্চিম পাড়ে।
জাহাঙ্গীর মাছ তুলছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটু দূরে একটা ছোট বাচ্চার অবয়ব ভাসছে। গ্রামের অনেক ছেলেপুলেই গভীর রাত পর্যন্ত ডুবোডুবি করে মাছ ধরে, জাহাঙ্গীর প্রথমে ভেবেছিলেন সে রকমই কেউ। কেমন যেন একটু খটকা লাগল, জাহাঙ্গীর কাছে এগিয়ে গেলেন। কাছ থেকে দেখেই আঁতকে উঠলেন, একটা বাচ্চা ছেলের লাশ!
জাহাঙ্গীর বলছিলেন—‘এত দিন ধইরা মাছ ধরি, এমন ঘটনা আমার জীবনেও হয় নাই। ভাবছিলাম মইরা গেছে। পরে আমি ওর নাড়ি টের পাইছিলাম। দেইখা মনে হইল আগে ওপরে নিয়া যাই। বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়া বাড়ির দিক যাইতেছিলাম। ছেলেটার নাকমুখ দিয়া তখন পানি বাইর হইতাছিল। এর মধ্যে দেখি ছেলেটা আমার গায়ে প্রস্রাব কইরা দিছে। বুঝলাম ছেলেটা মরে নায়!’
এরপর স্বাভাবিকভাবেই জাহাঙ্গীরের পায়ের গতি বেড়ে যায়। গা মুছিয়ে গায়ে লেপ টেনে দিলেন, সারা শরীর সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করলেন ছেলেটার। ততক্ষণে আশপাশের বাড়ির লোকজনও খবর পেয়ে গেছে। সবাই মিলে অচেনা ছেলেটার সেবা-শুশ্রূষা শুরু করলেন।
একসময় ছেলেটার জ্ঞান ফিরল। জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, তোমার নাম কী? বাড়ি কই?’ ছেলেটা তখনো বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোনোমতে জানাল, তার নাম রাকিব। বাড়ি ফরিদগঞ্জ। বাবার নাম, মায়ের নাম সবই বলল ঠিকঠাক। জাহাঙ্গীর জানতে চাইলেন, ‘তুমি এইখানে আসলা কীভাবে?’ রাকিব প্রশ্নটা শুনে আবার জ্ঞান হারায়।
মোবাইল ফোনে সেদিন রাতের পুরো বর্ণনা শোনাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর। ফোন রাখার আগে যোগ করলেন, ‘সেই রাতের ভয় আমার এখনো কাটে নাই।’
‘রাকিব, তুমি কখনো রূপকথার গল্প শুনেছ?’ জানতে চাই। রাকিব বিড়বিড় করে কী যেন বলে। হ্যাঁ বা না বোঝা যায় না। ‘এমন গল্প শুনেছ, এক দেশে ছিল রাজা-রানি। আর ছিল এক রাজকুমার। রাজকুমারের ভীষণ বুদ্ধি, আর অনেক সাহস। একদিন দুষ্ট লোকেরা রাজকুমারকে নদীতে ফেলে দিল। রাজকুমার কিন্তু তলিয়ে গেল না, ভাসতে ভাসতে চলে গেল এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। সেখানে এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে রাজকুমারকে পেল। জেলেদের সেবা-শুশ্রূষায় সে সুস্থ হয়ে উঠল। ফিরল নিজের রাজ্যে। শুনেছ এমন গল্প?’
রাকিব দুদিকে মাথা নাড়ে। আমরা বলি, ‘তুমি কিন্তু সেই রাজকুমারের মতো! তোমারও অনেক বুদ্ধি আর সাহস! আজকে তোমার গল্পটাই আমরা শুনব।’
রূপকথা, রাজকুমার—এসব শুনেই হয়তো রাকিব একটু সহজ হয়। আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে। মাঝে মাঝে কথা জুড়ে দেয় ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-চাচা আর গ্রামবাসী।
ভয়াল সন্ধ্যা
সেদিন সন্ধ্যায় রাকিব গিয়েছিল নেছার কাকার বাড়ি। একা একা। একটুখানি টিভি দেখে তারপর বাড়ি যাবে। কিন্তু কপাল মন্দ। গিয়ে দেখে লোডশেডিং। কী আর করা! হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরল রাকিব।
এমন সময় পথ আগলে দাঁড়াল দূরসম্পর্কের চাচা—জাফর।
জাফর চাচার সঙ্গে রাকিবের আগে থেকেই ভালো খাতির, মাঝেমধ্যেই চকলেট-চিপস কিনে দেন। জাফর চাচা বললেন তিনি ঢাকা যাবেন। ভুলিয়েভালিয়ে একপ্রকার জোর করেই রাকিবকে ঢাকা যেতে রাজি করিয়ে ফেললেন। খালের পাড় দিয়ে, খেতের মাঝ দিয়ে ঘুরেফিরে জাফর চাচা রাকিবকে নিয়ে যান। একসময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন চাঁদপুর শহর, লঞ্চঘাটে। উঠে পড়েন ঢাকাগামী লঞ্চ মিতালীতে। রাকিবকে শান্ত রাখতে জাফর তাকে একটা আরসি কোলা কিনে দেন। তবে রাকিবের ভাষ্যমতে, ‘আরসি কোলাটা পকেটে রাখছিলাম, পইড়া গেছে। খাইতে পারি নাই।’
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। লঞ্চ ছাড়তেই রাকিব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙে, লঞ্চ তখন মোহনপুর ঘাট পেরিয়ে এসেছে। রাকিব বুঝতে পারে, তার চিরচেনা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ঘোড়াশালা গ্রাম অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। সেখানে হয়তো মা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। রাত গভীর হচ্ছে। তা ছাড়া জাফর চাচার হাবভাব আর মোটেই ভালো ঠেকছে না। রাকিব বাড়ি যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। জাফর প্রথমে ধমক-ধামক দিয়ে রাকিবকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। শেষে বলেন, ‘আচ্ছা যা, তুই আগে লঞ্চের পেছনে গিয়া হাতমুখ ধুইয়া আয়।’
৩১ আগস্ট। রাত তখন একটা কি দেড়টা। আকাশে চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলো খেলা করছিল মেঘনার বুকে। রাকিব লঞ্চের পেছনে হাতমুখ ধুচ্ছিল। এমন সময় চাচা জাফর আট বছরের এই শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেন!
দিনের আলোয় নদী যতই চোখ জুড়াক, রাতের আঁধারে সেই নদীই দেখায় অতল গহ্বরের মতো! রাকিব বলছিল, ‘দুই দিক দিয়া লঞ্চ যায়, ট্রলার যায়। স্রোতের ধাক্কায় আমি দূরে চইলা যাই। মুখ খুইলা চিৎকার করতে গেলেই মুখে পানি ঢুইকা যায়। তারপর কী হইছে, আর মনে নাই।’
রাকিব যখন মাঝ মেঘনায় ভাসছে, পুরো ঘোড়াশালা গ্রাম তখন জেগে আছে।
রাকিবের সন্ধানে
সন্ধ্যা থেকেই রাকিবের মা রীনা বেগমের অস্থির অস্থির লাগছিল। ছোট ছেলে রাকিব বাড়ি ফেরেনি। চারদিকে খোঁজখবর করছেন, কেউই খুব একটা আমলে নিচ্ছে না। স্বামী আবুল হাসেম পাটোয়ারী থাকেন বাহরাইনে। একলা ঘরে ছেলেমেয়েগুলোই রীনা বেগমের সব। একটু পরপর জানালা দিয়ে মাথা বের করে ডাকছিলেন, ‘রাকিব, ও রাকিব! কই গেলি?’ রাকিবের সাড়া নেই। ঘরে এক মাস বয়সী বাচ্চা মেয়েটাকে ফেলে বেরও হতে পারছিলেন না রীনা। শরীরটাও খুব একটা ভালো না তাঁর। রীনা বলছিলেন, ‘প্রথম প্রথম ভাবছিলাম, হয়তো মাইরের ডরে কোনোহানে লুকায় আছে। পাশের বাড়িতে নতুন জামাই আসছে, হয়তো সেইখানে গেছে। রাত নয়টা বাইজা গেল, তখনো যহন আইলো না, তখন সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করল।’
ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেনের নির্দেশে রাত ১২টার দিকে এলাকায় মাইকিং শুরু হয়। চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। এর মধ্যে কীভাবে যেন রটে যায় রাকিবের ওপর জিন-ভূতের আসর হয়েছে। দুষ্ট অশরীরী হয়তো তাকে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে! দলে দলে লোক বেরিয়ে আসে টর্চ হাতে। প্রতিটা গাছ, আশপাশের সব বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। স্কুলঘর, মসজিদ...। এমনকি গ্রামের পুকুরগুলোতেও লোক নামানো হয়। গভীর রাত পর্যন্ত পুকুরগুলোতে খোঁজাখুঁজি চলে, ফলাফল শূন্য। কোথাও নেই রাকিব!
ঘরের ছেলে ঘরে
পরের ঘটনা গল্প-সিনেমার শুভ পরিণতির মতো। জাহাঙ্গীর রাকিবের খবর জানালেন সেখানকার মাছের আড়তে। বশিরউল্লাহ নামের একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যানের কাছে।
সকাল ১০টা নাগাদ রাকিবের চাচা আলী হোসেন খবর পান, বোরোচর গ্রামে রাকিব নামের একটা বাচ্চা ছেলে পাওয়া গেছে। রাকিবের মা রীনা বলছিলেন, ‘খবর পাইয়াই আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেছিলাম, আল্লাহ, এইডা জানি আমার রাকিবই হয়!’
গ্রামের মেম্বর, রাকিবের চাচা আলী হোসেনসহ আটজন গেলেন এখলাছপুর। আলী হোসেন বলছিলেন, ‘ট্রলার কাছাকাছি যাইতেই দেখি নদীর তীরে ওই গ্রামের শয়ে শয়ে মানুষ আমাগো লেইগা দাঁড়ায় আছে। এত মানুষের মইধ্যে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কোলে রাকিবরে দেইখাই আমার কলিজাটা জুড়ায় গেছে!’ বলতে বলতে চোখের পানি মোছেন চাচা আলী হোসেন।
রাকিবের মা, ফরিদগঞ্জের চেয়ারম্যান সবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে জাহাঙ্গীর রাকিবকে আলী হোসেনদের হাতে তুলে দেন। ১ সেপ্টেম্বর রাত নয়টা নাগাদ রাকিব মায়ের কাছে ফিরে আসে।
এদিকে সকালেই বাড়ি ফিরে চুপচাপ বসেছিলেন রাকিবের কথিত চাচা জাফর হোসেন। চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন ভুঁইয়া জানালেন, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সকালেই গ্রাম পুলিশ পাঠিয়ে জাফরকে নিয়ে আসি। কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সব ঘটনা জানার পর তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিই।’ বিল্লাল হোসেন আরও জানান, ধরা পড়ার পর জাফর তাঁকে বলছিল, ‘রাকিবরে যেইখানে ফালাইছি, ওইখানে আপনারে ফালাইলেও বাঁচতেন না। এই পোলা বাঁচল ক্যামনে?’
অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে জাফরের বিরুদ্ধে।
ঘোড়াশালা আর বোরোচর—দুই গ্রামের মধ্যে এখন দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জেলে পরিবারকে দাওয়াত করা হয়েছিল ঘোড়াশালা গ্রামে। রাকিবকে ফিরে পেয়ে একসঙ্গে আনন্দ করেছে সবাই। সবাই খুশি, শুধু খুশি হতে পারেনি একজন। জেলে জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে ইয়ামিন! চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়ে সে বলেছে, ‘রাকিব আমার ভাই! ওরে আমি যাইতে দিমু না!’
বোরোচরের জেলে
মতলবের উত্তরে দক্ষিণ বোরোচর গ্রামের জেলে জাহাঙ্গীর বেপারি। নদীতে চাঁই পেতে মাছ ধরেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে চারটা। জাহাঙ্গীর চাঁই পেতেছিলেন এখলাছপুরের কাছে, নদীর পশ্চিম পাড়ে।
জাহাঙ্গীর মাছ তুলছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটু দূরে একটা ছোট বাচ্চার অবয়ব ভাসছে। গ্রামের অনেক ছেলেপুলেই গভীর রাত পর্যন্ত ডুবোডুবি করে মাছ ধরে, জাহাঙ্গীর প্রথমে ভেবেছিলেন সে রকমই কেউ। কেমন যেন একটু খটকা লাগল, জাহাঙ্গীর কাছে এগিয়ে গেলেন। কাছ থেকে দেখেই আঁতকে উঠলেন, একটা বাচ্চা ছেলের লাশ!
জাহাঙ্গীর বলছিলেন—‘এত দিন ধইরা মাছ ধরি, এমন ঘটনা আমার জীবনেও হয় নাই। ভাবছিলাম মইরা গেছে। পরে আমি ওর নাড়ি টের পাইছিলাম। দেইখা মনে হইল আগে ওপরে নিয়া যাই। বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়া বাড়ির দিক যাইতেছিলাম। ছেলেটার নাকমুখ দিয়া তখন পানি বাইর হইতাছিল। এর মধ্যে দেখি ছেলেটা আমার গায়ে প্রস্রাব কইরা দিছে। বুঝলাম ছেলেটা মরে নায়!’
এরপর স্বাভাবিকভাবেই জাহাঙ্গীরের পায়ের গতি বেড়ে যায়। গা মুছিয়ে গায়ে লেপ টেনে দিলেন, সারা শরীর সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করলেন ছেলেটার। ততক্ষণে আশপাশের বাড়ির লোকজনও খবর পেয়ে গেছে। সবাই মিলে অচেনা ছেলেটার সেবা-শুশ্রূষা শুরু করলেন।
একসময় ছেলেটার জ্ঞান ফিরল। জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, তোমার নাম কী? বাড়ি কই?’ ছেলেটা তখনো বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোনোমতে জানাল, তার নাম রাকিব। বাড়ি ফরিদগঞ্জ। বাবার নাম, মায়ের নাম সবই বলল ঠিকঠাক। জাহাঙ্গীর জানতে চাইলেন, ‘তুমি এইখানে আসলা কীভাবে?’ রাকিব প্রশ্নটা শুনে আবার জ্ঞান হারায়।
মোবাইল ফোনে সেদিন রাতের পুরো বর্ণনা শোনাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর। ফোন রাখার আগে যোগ করলেন, ‘সেই রাতের ভয় আমার এখনো কাটে নাই।’
No comments