স্মরণ- যে লাল কখনো বদলায়নি by জয়া শহীদ
ব্রিটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম নির্ধারণ করেছিল পাঁচ হাজার টাকা। সেটা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কথা। তখন কত জায়গায়ই না লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আবদুশ শহীদকে। কখনো পরিত্যক্ত বাড়িতে, কখনো ভাঙা কবরে, কখনো জঙ্গলে-গর্তে থাকতে হয়েছে। সে সময় পাঁচ হাজার টাকা মানে অনেক টাকা।
তা সত্ত্বেও গ্রামের সাধারণ মানুষ সেই লোভে পড়েনি। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি কেউ। মানুষের প্রতি কতটা নিবেদিত ছিলেন তিনি, এ ঘটনাই তার প্রমাণ। ব্রিটিশ সরকার পারেনি, কিন্তু সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তান তাঁকে গ্রেপ্তার করে ফেলে। ১৯৪৮ সালেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তাঁকে কাটাতে হয় দীর্ঘ আটটি বছর। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের সময় ওই ওয়ার্ডেই ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর যতটা ব্যাপকভাবে সবার সামনে আসা উচিত ছিল, ততটা প্রচারিত হয়নি।
আজ খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আবদুশ শহীদের ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৬ সালের এই দিনে রামপুরার নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুশ শহীদের জন্ম ১৯১৭ সালের ১৭ নভেম্বর। রুশ বিপ্লবের বছর। বরিশাল জেলার চাখারের বলহার গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। লেখাপড়া শুরু করেন গ্রাম্য মক্তবে। মেজো বোনের বিয়ে হয় শর্ষিনার পীর পরিবারে। তিনি ছয়-সাত বছর বয়সে শর্ষিনার মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে কঠোর অনুশাসনে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে আসেন বলহার গ্রামে। ভর্তি হন খালিসাটোলা হাইস্কুলে। সে সময় এই স্কুলে হিন্দু ছাত্র-শিক্ষকই ছিল বেশি। মুসলমান ছাত্র ছিল হাতেগোনা। একজন মুসলমান ছাত্র এত দূর থেকে এসে স্কুল করে দেখে শিক্ষকেরা তাঁর প্রতি উৎসুক হন। তাঁর স্মরণশক্তি, মেধা, বিনয় তাঁকে অচিরেই জনপ্রিয় করে তোলে।
পঞ্চম শ্রেণীতে থাকতেই তিনি একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেন, যার নাম ছিল দুর্বার। স্কুলের উঁচু ক্লাসে ওঠার পর তিনি বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন ছাত্রনেতা সুখেন সেন।
১৯৪০ সালে তিনি বরিশাল জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময়কার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে তিনি তরুণদের সংগঠিত করে দুস্থ ব্যক্তিদের সেবায় এগিয়ে যান। লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ওই সময়ের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যাবে তাঁর লেখা আত্মকথা বইয়ে। ১৯৪২ সালে যখন তিনি বরিশাল চাখার কলেজের ছাত্র, তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তেমন প্রসার ঘটেনি। এ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে ছিল। ছাত্রজীবনে অগ্রগতির জন্য যে পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধার দরকার হয়, তা মধ্যবিত্ত গ্রামীণ পরিবারে ছিল আরও কম। মূলত জ্ঞানপিপাসা ও অদম্য স্পৃহায় আবদুশ শহীদ বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় একটি লোভনীয় প্রস্তাব এসেছিল তাঁর কাছে। জনৈক ইংরেজ কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানান যে আবদুশ শহীদ যদি গোপনে কলেজের রাজনৈতিক খবরাখবর তাঁর কাছে সরবরাহ করেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এমএ পর্যন্ত পড়ার খরচ দেবে এবং পড়াশোনা শেষে বড় চাকরি দিয়ে দেবে। আবদুশ শহীদ এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি চাখার কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে দেখি, কলকাতা পোর্ট, সওগাত পত্রিকাসহ অনেক বড় বড় চাকরির অফার তিনি পার্টির নির্দেশে ফিরিয়ে দেন। কলকাতার ঝলমলে জীবনে অভ্যস্ত না হয়ে তিনি ফিরে আসেন বরিশালে। কম জৌলুশপূর্ণ পেশা শিক্ষকতাকে বেছে নেন ব্রত হিসেবে। এরপর শুরু করেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখির কাজ—যার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি স্কুল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন প্রাচ্যবার্তা, সংবাদ, দৈনিক দেশ, হলিডেসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। কাহলিল জিবরানের একটি কবিতার বই অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। কীত্তনখোলা নামে একটি অনিয়মিত পাক্ষিক বের করতেন। সম্পাদনা করেছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গণমুখী কবিতা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি মেকং থেকে মেঘনা নামে একটি বই লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন মাও সেতুং ও লংমার্চ নামের একটি বই। এ ছাড়া সমাজতন্ত্রের পথে গণসংস্কৃতির ধারা, উৎপাদন ও শ্রমের সঙ্গে শিক্ষা বইগুলো লিখেছেন। ১৯৭০ সালের দিকেই কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত পার্টির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের ভেতরে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন।
শেষজীবনে নিজেকে তিনি বলতেন ইনডিভিজ্যুয়াল মার্ক্সিস্ট বা ব্যক্তি মার্ক্সবাদী। পার্টি-বিচ্ছিন্ন কিন্তু দায়বদ্ধ। এ রকম মার্ক্সবাদী সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও কেউ কেউ তো ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকবেন আবদুশ শহীদ। লাল পতাকাকেই তিনি জীবনের আদর্শ মেনেছিলেন। সে লাল কখনো বদলায়নি।
আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে তাঁকে নিয়ে একটি আলোচনা সভা হবে। অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়। কামাল লোহানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, এম এম আকাশ, আনু মুহাম্মদ আবদুশ শহীদ ও সমকালীন রাজনীতি নিয়ে স্মৃতিচারণা করবেন। আপনার সময় হলে আপনিও আসুন এই আলোচনা সভায়।
জয়া শহীদ
আজ খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আবদুশ শহীদের ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৬ সালের এই দিনে রামপুরার নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুশ শহীদের জন্ম ১৯১৭ সালের ১৭ নভেম্বর। রুশ বিপ্লবের বছর। বরিশাল জেলার চাখারের বলহার গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। লেখাপড়া শুরু করেন গ্রাম্য মক্তবে। মেজো বোনের বিয়ে হয় শর্ষিনার পীর পরিবারে। তিনি ছয়-সাত বছর বয়সে শর্ষিনার মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে কঠোর অনুশাসনে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে আসেন বলহার গ্রামে। ভর্তি হন খালিসাটোলা হাইস্কুলে। সে সময় এই স্কুলে হিন্দু ছাত্র-শিক্ষকই ছিল বেশি। মুসলমান ছাত্র ছিল হাতেগোনা। একজন মুসলমান ছাত্র এত দূর থেকে এসে স্কুল করে দেখে শিক্ষকেরা তাঁর প্রতি উৎসুক হন। তাঁর স্মরণশক্তি, মেধা, বিনয় তাঁকে অচিরেই জনপ্রিয় করে তোলে।
পঞ্চম শ্রেণীতে থাকতেই তিনি একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেন, যার নাম ছিল দুর্বার। স্কুলের উঁচু ক্লাসে ওঠার পর তিনি বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন ছাত্রনেতা সুখেন সেন।
১৯৪০ সালে তিনি বরিশাল জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময়কার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে তিনি তরুণদের সংগঠিত করে দুস্থ ব্যক্তিদের সেবায় এগিয়ে যান। লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ওই সময়ের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যাবে তাঁর লেখা আত্মকথা বইয়ে। ১৯৪২ সালে যখন তিনি বরিশাল চাখার কলেজের ছাত্র, তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তেমন প্রসার ঘটেনি। এ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে ছিল। ছাত্রজীবনে অগ্রগতির জন্য যে পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধার দরকার হয়, তা মধ্যবিত্ত গ্রামীণ পরিবারে ছিল আরও কম। মূলত জ্ঞানপিপাসা ও অদম্য স্পৃহায় আবদুশ শহীদ বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় একটি লোভনীয় প্রস্তাব এসেছিল তাঁর কাছে। জনৈক ইংরেজ কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানান যে আবদুশ শহীদ যদি গোপনে কলেজের রাজনৈতিক খবরাখবর তাঁর কাছে সরবরাহ করেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এমএ পর্যন্ত পড়ার খরচ দেবে এবং পড়াশোনা শেষে বড় চাকরি দিয়ে দেবে। আবদুশ শহীদ এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি চাখার কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে দেখি, কলকাতা পোর্ট, সওগাত পত্রিকাসহ অনেক বড় বড় চাকরির অফার তিনি পার্টির নির্দেশে ফিরিয়ে দেন। কলকাতার ঝলমলে জীবনে অভ্যস্ত না হয়ে তিনি ফিরে আসেন বরিশালে। কম জৌলুশপূর্ণ পেশা শিক্ষকতাকে বেছে নেন ব্রত হিসেবে। এরপর শুরু করেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখির কাজ—যার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি স্কুল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন প্রাচ্যবার্তা, সংবাদ, দৈনিক দেশ, হলিডেসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। কাহলিল জিবরানের একটি কবিতার বই অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। কীত্তনখোলা নামে একটি অনিয়মিত পাক্ষিক বের করতেন। সম্পাদনা করেছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গণমুখী কবিতা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি মেকং থেকে মেঘনা নামে একটি বই লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন মাও সেতুং ও লংমার্চ নামের একটি বই। এ ছাড়া সমাজতন্ত্রের পথে গণসংস্কৃতির ধারা, উৎপাদন ও শ্রমের সঙ্গে শিক্ষা বইগুলো লিখেছেন। ১৯৭০ সালের দিকেই কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত পার্টির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের ভেতরে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন।
শেষজীবনে নিজেকে তিনি বলতেন ইনডিভিজ্যুয়াল মার্ক্সিস্ট বা ব্যক্তি মার্ক্সবাদী। পার্টি-বিচ্ছিন্ন কিন্তু দায়বদ্ধ। এ রকম মার্ক্সবাদী সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও কেউ কেউ তো ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকবেন আবদুশ শহীদ। লাল পতাকাকেই তিনি জীবনের আদর্শ মেনেছিলেন। সে লাল কখনো বদলায়নি।
আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে তাঁকে নিয়ে একটি আলোচনা সভা হবে। অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়। কামাল লোহানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, এম এম আকাশ, আনু মুহাম্মদ আবদুশ শহীদ ও সমকালীন রাজনীতি নিয়ে স্মৃতিচারণা করবেন। আপনার সময় হলে আপনিও আসুন এই আলোচনা সভায়।
জয়া শহীদ
No comments