আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-নিজামীদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল ৫ ডিসেম্বর

কাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে আরো এক মাসের বেশি সময় পেল রাষ্ট্রপক্ষ।বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে গতকাল মঙ্গলবার এ নির্দেশ দেন।


এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমসহ শীর্ষ পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন গতকাল ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তবে ট্রাইব্যুনালকে তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার কথা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল জামায়াতের শীর্ষ চার নেতার জামিনের আবেদন আবারও খারিজ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে ছয়বার তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ করা হলো।
সাক্ষীদের বক্তব্যের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড করতে জামায়াতের আরেক নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবীর আবেদনে বিধিমালা তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের নাম-পরিচয় চেয়ে তাঁর করা একটি আবেদন খারিজ করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ চার নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ
মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করার জন্য গতকাল দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তা দাখিল করেনি। এ জন্য আরো এক মাস সময় চেয়ে আবেদন জানান প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। তিনি বলেন, এ চারজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে যতটুকু দেখা গেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য সময় দরকার।
ট্রাইব্যুনাল প্রতিবেদন পাওয়ার কথায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, অবশেষে তদন্ত প্রতিবেদন এল। তবে চারজনের বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হবে, নাকি আলাদা আলাদা অভিযোগ দাখিল করা হবে_সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জানতে চান ট্রাইবুনাল।
জবাবে সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে ঠিক কিভাবে এবং কতগুলো অভিযোগ আনা হবে, তা নির্ধারণে সময় প্রয়োজন। এরপর ট্রাইব্যুনাল এক মাস পাঁচ দিন সময় মঞ্জুর করে আগামী ৫ ডিসেম্বর চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর জামায়াতের ওই চার নেতার পক্ষে জামিনের আবেদন উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুন্সী আহসান কবির ও ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। তাঁরা বলেন, ১৫ মাস ধরে এ চারজন বন্দি। আইন অনুযায়ী তদন্ত সংস্থা এক বছরের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারলে জামিন মঞ্জুর করতে পারেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষ আজ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে পারেনি।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'স্বাধীনতাযুদ্ধে স্বীকৃত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে তখনকার সরকার ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে সময়কার রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার কারণেই হয়রানি করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। যাঁদের আটক রাখা হয়েছে, তাঁরা বয়স্ক মানুষ। আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। কারাগারে নেওয়ায় আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই এ অবস্থায় যেকোনো শর্তে জামিন চাচ্ছি।' জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, ওই চারজনের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। ট্রাইব্যুনাল এ পর্যায়ে জামিনের আবেদন খারিজ করেন।
এরপর মাওলানা সাঈদীর পক্ষ থেকে তিনটি আবেদন উপস্থাপন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে '৭২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের পত্রিকা ও অপরাপর দলিল দেখার সুযোগ চেয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার ও বাংলা একাডেমীর প্রতি নির্দেশনা জারি করা, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের নাম-পরিচয় আসামিপক্ষকে সরবরাহ করা এবং সাক্ষীদের জেরার সুবিধার জন্য তাঁদের বক্তব্যের অডিও এবং ভিডিও রেকর্ড করা এবং তা দ্রুত লিখিত আকারে আসামিপক্ষকে সরবরাহ করার জন্য এ তিনটি আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব আবেদনের বিরোধিতা করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীদের নাম-পরিচয় চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে আদেশে বলেন, সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আবেদনটি খারিজ করা হলো। এরপর জাতীয় গ্রন্থাগার ও বাংলা একাডেমীবিষয়ক আবেদন নিষ্পত্তি করে দেওয়া আদেশে বলা হয়, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল তথ্য দিতে বা না দিতে আইনগতভাবে নির্দেশনা দিতে পারে না।
গোলাম আযম প্রসঙ্গ : এরপর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, তদন্ত সংস্থা জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আইন অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়ার সুবিধার্থে তা ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করা হলো। জবাবে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, ট্রাইব্যুনাল অবহিত হলো।
গতকাল মামলার দিন ধার্য থাকায় কারাবন্দি জামায়াতের শীর্ষ চার নেতা নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাঁদের উপস্থিতিতে সকাল ১০টা ৩৫ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল চলে। এরই মধ্যে একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের শোকজ নোটিশের শুনানিতে আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবাই উপস্থিত থাকতে পারবেন বলে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন। ওই নোটিশের শুনানিতে উভয় পক্ষের আইনীবী ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারবেন না, এমন সংবাদ প্রকাশের পর ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। নিউ এজ পত্রিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। তদন্ত সংস্থা নিজামীর বিরুদ্ধে ৪১১ পৃষ্ঠার, মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৩৬৬ পৃষ্ঠার, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৩২৭ পৃষ্ঠার ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৩৮৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করেছে। সোমবার তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদন তৈরি ও দাখিল করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.