বিদেশ সফরে দীপু মনির সেঞ্চুরি : অর্জন শূন্য by বশীর আহমেদ

বিদেশ সফরে সেঞ্চুরি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ১০১তম সফরে তিনি গতকাল রাতে সৌদি আরব গেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর গত ৩৪ মাসে তিনি প্রায় ১৩ মাস কাটিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। রেকর্ড গড়া এই বিদেশ সফরে দেশের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। বাংলাদেশের আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিদেশ সফরের রেকর্ড অনেক আগেই ভেঙেছেন ডা. দীপু মনি। শুধু রেকর্ড গড়া বিদেশ সফর নয়, নানা কারণে আলোচিতও তিনি। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন তিনি। বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে কিনা—এমন প্রশ্ন হরহামেশাই তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। তাতেও তিনি দমে যাননি।


বিরামহীনভাবে দেশে দেশে ঘুরছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ এ মন্ত্রীর দিল্লিকে খুশি রাখার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। ভারতের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু উজাড় করে দেয়ার পরও বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এ ব্যর্থতার দায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই।
ডা. দীপু মনির এই ১০১ বার বিদেশ সফরের মধ্যে তিনি মাত্র ১৫-১৬ বার গেছেন দ্বিপক্ষীয় সফরে। বাকি সফরে গিয়েছেন তিনি বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর সম্পর্কে বলেন, আমরা এখন আর কোনো হিসাব রাখি না।
৯৭তম সফর পর্যন্ত হিসাব ছিল। এখন আর রাখছি না। মন্ত্রী তো কোনো একটা দাওয়াত পেলেই বিমানে চড়ে বসেন। দেশের জন্য তেমন কোনো ফল আসে না এসব সফর থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০৯ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন। ১ বছরে বাংলাদেশের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটা ছিল রেকর্ড সংখ্যক বিদেশ সফর। ওই ৩৪ বার বিদেশ সফরে তিনি প্রায় ৪ মাস বিদেশের মাটিতে কাটান। কাকতালীয়ভাবে ২০১০ সালেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন।
তবে এসব সফরে তিনি ১৪৬ দিন অর্থাত্ প্রায় ৫ মাস বিদেশের মাটিতে কাটান। চলতি বছর গত ১০ মাসে ডা. দীপু মনি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, মিসর, তিউনিসিয়া, কুয়েত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ অন্তত ৩৩ বার সফর করেছেন। সৌদি আরব, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সফর করেছেন একাধিকবার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ডা. দীপু মনি ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। গত ৩ বছরে ভারতকে রীতিমতো সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ফ্রি ট্রানজিট, করিডোর সুবিধা, বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে সঙ্গী করা, উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া, বন্দর ব্যবহারসহ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ভারত যা যা চেয়ে আসছিল তার সবই পূরণ করা হয়েছে। ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা সঠিকভাবে কার্যকরের জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে উচ্চ সুদে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতেও কোনো কুণ্ঠাবোধ করেনি সরকার। যদিও এই ঋণ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। সন্ত্রাস দমনে ভারতকে সহায়তা দিতে ভারতের প্রস্তাবিত ৩টি চুক্তিও সই করেছে বাংলাদেশ।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই করিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের মতো বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে রীতিমতো ঢাকার সঙ্গে প্রতারণা করেছে দিল্লি। এরপরও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত বন্দনার শেষ নেই। কোনো ফি ছাড়াই ভারতের পণ্য এখন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদেশের স্বার্থরক্ষায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে সব চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপেক্ষিত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং ড. গওহর রিজভী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাদ দিয়েই অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই বার বার প্রশ্ন উঠছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালায় কে?
শুধু ভারতকে খুশি করতে গিয়ে বাংলাদেশ এখন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে জনশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে। বার বার সৌদি আরব সফর করেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের আকামা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির দুয়ার এখনও বন্ধ। গ্রামীণ ব্যাংকসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক অবনতিশীল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে আস্থায় নিতে পারছে না চীন।
সব মিলিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতার চিত্রই ফুটে উঠছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত এতো ঘোরাঘুরি করেও বাংলাদেশের ইমেজ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচকভাবে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা। দুর্নীতির ব্যাপারে কড়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অব্যাহতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়ার বিষয় নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অর্থাত্ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বদনাম বাড়ছে আর বাড়ছে।
বিদেশ ভ্রমণ আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পাশাপাশি উদ্ভট সব মন্তব্য এবং কাজের জন্য সব সময়ে আলোচনায় আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে আসেন। তখন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক ভারতীয় সাংবাদিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বাফার স্টেট বলে মন্তব্য করেন। সেদিন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেদিন বলেছিলেন, ভারতীয় সাংবাদিকদের মন্তব্যের গুরুত্ব বোঝেননি দীপু মনি।
গত ১৯ অক্টোবর ফটোগ্রাফার হিসেবে ডা. দীপু মনিকে দেখা গেছে। তিনি ছবি তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যান। প্রধানমন্ত্রী সেখানে বিদ্যুত্ সঞ্চালন কার্যক্রম, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এবং ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। এছাড়া তিনি তিনবিঘা করিডোরে ১৫ মিনিটের এক চা-চক্র অনুষ্ঠানে অংশ নেন। দেখা যায়, এ সময় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ছবি তোলার দৃশ্য কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। এটা নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছে। এর একদিন আগে গত ১৮ অক্টোবর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজের এলাকার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছেন। এ ঘটনাও পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।
এর আগে একবার বিদেশের মাটিতে তিনি সবার নজর কাড়েন অটোগ্রাফ শিকারি হিসেবে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে যান। ওই সফরে প্রধানমন্ত্রীকে ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার দেয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল রাষ্ট্রপতি ভবনে ওই পুরস্কার প্রদান করেন। ওই অনুষ্ঠানে দীপু মনিকে দেখা গেল অটোগ্রাফ শিকারি হিসেবে। সেই ভরা মজলিসে সবাই দেখলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিভা পাতিল, সোনিয়া গান্ধী এবং ড. মনমোহন সিংয়ের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন অটোগ্রাফগুলো নিয়েছিলেন আমন্ত্রণপত্রের ওপর। এছাড়া সম্প্রতি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি গণক নই। এই গণক নিয়ে এখনও আলোচনা হয়। তবে তিনি গণক না হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ব্যর্থ তা বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকে তাকে ভ্রমণপ্রিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন।

No comments

Powered by Blogger.