ভূমিপুত্রের সঙ্গে সজ্ঞান শত্রুতা by মাহমুদ শামসুল হক
'সভ্য' শব্ধের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ভদ্র, শিষ্ট, সাধুজন এবং মার্জিত রুচির অধিকারী। তাদের সার্বিক জীবনযাত্রার নৃতাত্ত্বিক নাম সভ্যতা। অর্থাৎ শিক্ষা-দীক্ষা ও আচরণে অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজ। অন্যদিকে যারা নিজেদের বেশি সভ্য বলে অহঙ্কার করেন তাদের বলা হয় সভ্যতাভিমানী। এরাই এসব অভিধান রচনা করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য অন্যরকম। ইতিহাস জানাচ্ছে, 'সভ্য' তারাই যারা গায়ের জোর এবং বুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে।
এ অর্থে সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে জবরদখলের ইতিহাস। সভ্যতার সূচনাপর্বে জবরদখলকারীরাই নিজেদের একমাত্র সভ্য বলে দাবি করেছে। বাকিদের বলেছে অসভ্য, বর্বর, পশুবৎ। এই বোধ থেকেই মানবসমাজ বিভক্ত হয়েছে শাসক ও শোষিত শ্রেণীতে। প্রাচীন ফেরাউনদের বিবেচনায় তারা ভিন্ন আর সবাই ভারবাহী জন্তুর নামান্তর। শ্বেতাঙ্গদের চোখে কৃষ্ণাঙ্গরা জন্মসূত্রে দাস। আরবদের চেতনায় বেদুইনরা অশিষ্ট-অমার্জিত। ইউরোপ-এশিয়ার আর্যদের মতে, তারা ছাড়া বাকি মানুষ নিম্নবর্গীয়। শাসিত ও শোষিত হওয়াই তাদের অমোঘ নিয়তি। আমরা যাদের আদিবাসী বলি তারা ওই শেষোক্ত দলের। যারা হাজার হাজার বছর ধরে নিজভূমে পরবাসী। নৃ-বিজ্ঞানের ভাষায় ভূমিপুত্র (ঝড়হ ড়ভ ঃযব ঝড়রষ)। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে জবরদখলকারীদের সঙ্গে আদিবাসীদের লড়াই হয়েছে। ক্রমাগত পরাজিত হয়ে এদের সংখ্যাগুরু অংশ পরিণত হয়েছে অবনমিত মানুষগোষ্ঠীতে। এদের একাংশ নিজেদের আদি পরিচয় ধরে রাখার জন্য আশ্রয় নিয়েছে মানুষের আদিবাস স্থল অরণ্যে। কিন্তু 'সভ্য' মানুষ তাদের পিছু ছাড়েনি, ক্রমাগত ধাওয়া করেছে। কেউ উপনিবেশ গেড়েছে তাদের চিরায়ত দখলি ভূমিতে, কেউ সাধুজন সেজে চড়াও হয়েছে আদিবাসীদের মনোভূমিতে। এ ধরনের ভয়ভীতি, আঘাত-অভিঘাত, সন্দেহ-সংশয় নিয়ে আদিবাসীরা কেবলই পিছু হটেছে, পালিয়েছে বন থেকে বনান্তরে। তবু নিজেদের বেছে নেয়া সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার স্বাতন্ত্র্যকে বিকিয়ে দেয়নি কোনো প্রলোভন-প্ররোচনায়। নৃ-বিজ্ঞানী ড. এলুইনের ভাষায়, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে টেকসই মানুষ, যারা স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে বাঁচার ক্ষমতা রাখে। প্রকৃতি তাদের আহার জুগিয়েছে এতকাল, প্রকৃতিকে তারাই শুশ্রূষা দিয়েছে বিনাশর্তে। 'সভ্য সমাজ' তাদের ওপর নিজেদের রুচি, বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা আরোপ করার প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিছু নিতে রাজি হয়নি। এজন্য যে, আদিবাসীরা যেভাবে জীবন নির্বাহ করে তা অতীব নিম্নস্তরের, তারা যা চর্চা করে তার সবটাই কুসংস্কার। তথাকথিত সভ্য মানুষের এ ধরনের নাকউঁচু বিবেচনা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে। কেননা, পৃথিবীর অসংখ্য জানা-অজানা সম্প্রদায় আজ বিলুপ্তির পথে, বিলুপ্তির পথে তাদের চিরায়ত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অলিখিত ভাষাবৈচিত্র্য, সর্বোপরি সহজ-সরল-অকুটিল জীবনযাত্রার প্রকৌশল। বিজ্ঞানীদের মতে, জরা-ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা প্রকৃতি আদিবাসীদেরই দিয়েছিল সবার আগে। তাদের মধ্যে উন্মাদ রোগ নেই বললেই চলে। অরণ্য তাদের হাসপাতাল আর বনজ ভেষজ অসুখে ওষুধ। অসংখ্য আদিবাসী ভাষায় ধর্ষণ বা এর সমার্থক কোনো শব্ধ নেই। অর্থাৎ তারা জানে না এবং মানে না যে, এও সম্ভব। অথচ সভ্য সমাজের সাধুরা আদিবাসীদের কুসংস্কার নিয়ে নির্লজ্জভাবে উৎকণ্ঠিত। নৃ-বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানী, সমাজবিদ, ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেছেন-আদিবাসীদের চর্চিত শিল্পকলা, সঙ্গীত, নৃত্য শুধু গভীর মননশীলতারই পরিচায়ক নয়, মানের দিক থেকেও অনন্য প্রত্মসামগ্রী। আদিবাসীরা পৃথিবীর আদি কৃষকও বটে। তারা মাটির ফুসফুস চিপড়ে ফসল ফলায় না, উর্বরাশক্তি বাড়ানোর অপরিহার্য দায়িত্বও পালন করে। একটি বৃক্ষ ছেদন করে পুঁতে দেয় অগণিত বীজ। মাটি তাদের আরাধ্য দেবী; পাহাড়, প্রস্তর, ঝরনা, নদী, গাছ তো বটেই। মানুষকে প্রকৃতির পক্ষে রাখার এ-ও এক আদিম প্রয়াস। না হলে আরও বেশি হারে নিঃশেষ হতো অরণ্যের শ্যামলিমা, বায়ুর নির্মলতা, জীববৈচিত্র্য, ভূমির স্বাভাবিক গড়ন। এ-ও ধ্রুব সত্য যে, একমাত্র আদিবাসী সম্প্রদায়ই প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় জন্মগত অধিকার রাখে। তাই আমাদের সহমর্মিতা পাওয়ার অধিকারও রয়েছে তাদের। অহেতুক জ্ঞান দেয়ার দরকার নেই। পৃথিবীতে কোনো আদিবাসী জনজাতি স্বেচ্ছায় দাসত্ব নিয়েছে এমন প্রমাণ নেই। তাদের দাসত্বের তকমা পরানো হয়েছে জোর করে। তারা চায়নি, অভাববোধ করেনি, অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠেনি। অথচ তাদের 'মানুষ' বানানোর ব্রত নিয়েছে সভ্য সমাজের অনেক সুজন! আদিবাসীরা জন্মগতভাবেই স্বাধীন, সুশৃঙ্খলও বটে। অত্যাচারিত হলে প্রতিবাদী হতে কুণ্ঠা করে না। এমনকি জীবনপাত করতেও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের মতো ভারতবর্ষের আদিবাসী সম্প্রদায়ও সেই বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিস্তর লড়াই ও আন্দোলন করেছে এ উপমহাদেশের নির্যাতিত-শোষিত ভূমিপুত্ররা। উনিশ শতকে সংগঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহ তাদের সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের যে স্বাক্ষর রেখেছে, তা ইতিহাসে বিরল। যদিও প্রচলিত ইতিহাসে এবং পাঠ্যপুস্তকে তা নিষ্প্রভ। এও এক ধরনের সজ্ঞান অবহেলা। মানবাধিকারের কথা যদি বলা হয় তাহলে বলতে হবে, তা সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে আরণ্য জনপদে, অতীতকাল থেকে এখন পর্যন্ত। তাদের চিরায়ত ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেড়ে নেয়া হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক অবলম্বন। যে কোনো বিবেচনায় আদিবাসীদের চিরায়ত জ্ঞান, ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতি মূল্যবোধ সভ্যতার অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ সুরক্ষার দায় নেয়া মনুষ্যত্বের দাবি, মানবধর্মের দাবি। জাতিসংঘের তথ্য মতে, এখন বিশ্বের ৭০টি দেশে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী বাস করে। তাদের রয়েছে পাঁচ হাজার ভাষা। নির্যাতিত আদিবাসীদের অধিকার দেয়ার কথা এখন খুব চেঁচিয়ে বলছে জাতিসংঘ। অনেক দেশ সাড়াও দিয়েছে। এরই মধ্যে নিজ দেশের আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে অষ্ট্রেলীয় সরকার। বলতে দ্বিধা নেই, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার এই দৃষ্টান্ত অন্যান্য দেশকেও অনুপ্রাণিত করবে; পৃথিবী থেকে দূর হবে ভূমিপুত্রের সঙ্গে অন্যদের সজ্ঞান শত্রুতা।
No comments