গঠনতন্ত্র নিয়ে আরও জটিলতায় জামায়াতে ইসলামী- ৫ম সংশোধনী বাতিল হওয়ায় তারা আরও সঙ্কটে

 চাপে রয়েছে জামায়াত। হুমকির মধ্যে দলের গঠনতন্ত্র। একদিকে দলের নিবন্ধন বাঁচাতে গঠনতন্ত্র সংশোধনে নির্বাচন কমিশনের তাগিদ, অন্যদিকে জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক দলের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার নিয়ামক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে উচ্চ আদালতের দেয়া রায়।
এ অবস্থায় জামায়াতের গঠনতন্ত্র আগের চেয়ে আরও হুমকির মুখে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি সামলে উঠতে আলোচনার মাধ্যমেই দলীয় গঠনতন্ত্র ছাড় করাতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি এখন বলছে, গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনত্মব্য করে গত ২৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের দেয়া চিঠির বক্তব্য পরিষ্কার হয়নি। চিঠির বক্তব্য বুঝে নিতে খুব শীঘ্রই কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে শনিবার জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সেক্রেটারি জেনারেল কামারম্নজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মনে করি না দলের গঠনতন্ত্রে সাংঘর্ষিক কিছু আছে। সংবিধান এবং ইসির নিবন্ধন শর্ত মেনেই গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হয়েছে। তাই ইসির চিঠি পেলেও সেটার বক্তব্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। কোথায় কোথায় কিভাবে সাংঘষির্ক হয়েছে তা স্পষ্টভাবে জানতে কমিশনের সঙ্গে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে। আলোচনার জন্য কমিশনের কাছে কবে সময় চাওয়া হবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, খুব শীঘ্্রই আমরা সময় চাইব। কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের প্রেৰিতেই গঠনতন্ত্রে কেমন সংশোধন আনা হবে তা পরবতর্ীতে সিদ্ধানত্ম নেয়া হবে। এদিকে কমিশনের এক উর্ধতন কর্মকতর্া জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী জামায়াতের জন্য বিশেষ কোন ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। তবে কমিশন দেখবে জামায়াত ইসির চিঠির জবাবে কি রকম ব্যাখ্যা দিতে চায়। ব্যাখ্যা মনঃপুত না হলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন শর্ত অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
গত ২৫ জানুয়ারি জামায়াতকে দেয়া চিঠিতে ইসি দলের গঠনতন্ত্রের ২ (৫) ৩, ৬, ৭, ১১ ধারা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায়। কমিশন জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২ (৫) ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, এ ধারায় দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত রীতিনীতিকেও অবজ্ঞা করা হয়েছে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ওই ধারায় ইসলামী সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। জীবনের সব বিষয়ে কেবল আলস্নাহর বিধানকেই একমাত্র হেদায়াত হিসেবে মেনে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আলস্নাহ ব্যতীত কাউকে রাজা-বাদশাহ হিসেবে না মানা, কাউকে কোন আদেশ-নিষেধের অধিকার মনে না করা, কাউকে আইন প্রণেতা হিসেবে মেনে না নিতে নিষেধ করা হয়েছে।
ধারা-৩ এ ইসলামে আইনগত সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আলস্নাহ। এতে বলা হয়েছে, ইসলামী মূল্যবোধের মাধ্যমে ঐক্য সৃষ্টি করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রৰা করতে হবে। ইসির মতে, এ ধারায় কৌশলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার চেতনাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ইসলামের পূণর্াঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংশোধন এনে সরকার পরিবর্তন এবং সর্বসত্মরে খোদাভীরম্ন নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করতে হবে। এ ধারাটিকেও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেছে ইসি। ইসির মতে, এ ধারায় দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে ইসি বলেছে, এ ধারায় নিবন্ধন আইনের পরিপন্থী একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, এমন কোন দল বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না যাদের লৰ্য জামায়াতের লৰ্যের পরিপন্থী।
গঠনতন্ত্রের ১১ ধারা অনুযায়ী আলস্নাহ ও রাসুলকে বিশ্বাস করে একজন অমুসলিমকে দলের সদস্য হতে হবে। এ ছাড়াও আলাদা শপথের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মুসলিম ও অমুসলিমদের জন্য। অমুসলিম নাগরিকদের দলের সদস্য হওয়ার জন্য আলাদা নিয়ম রাখার ব্যবস্থাকে ইসি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক বলে উলেস্নখ করেছে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের দুটো ৰেত্রে ব্যাখ্যা চেয়েছে ইসি। ১৬ ধারার ২ (খ) তে জামায়াতের লৰ্য অর্জনে জান-মাল দিয়ে চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে। 'জান-মাল' শব্দটি স্পষ্ট করতে বলেছে ইসি। এ ছাড়া জামায়াতের সর্বসত্মরের কমিটিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী সদস্য আছে বলা হলেও বিষয়টি কেন গঠনতন্ত্রের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি তা জানতে চাওয়া হয় কমিশনের চিঠিতে।
সংশিস্নষ্টদের মতে, কমিশনের আপত্তির মুখে প্রথম দফায় নাম পরিবর্তনসহ কয়েক ধারায় সংশোধন আনলেও দেশের সার্বভৌমত্ব, বিচার ব্যবস্থা, নারী ও পুরম্নষ, ধর্ম-বর্ণে এখনও জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানবিরোধী। ইসির চিঠি সেটাই প্রমাণ করে। তবে জামায়াত নেতা কামারম্নজ্জামান মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের আরপিওর শর্ত অনুসারে তাহলে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলোরও নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। কারণ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ধর্মনিরপেৰতার কথা আছে। আর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর গঠনতন্ত্রে ধর্মের লেশও নেই। দুটোই বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যবস্থায় সমাজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমাদের একটি আদর্শ। প্রত্যেক দলেরই এমন স্বতন্ত্র আদর্শ আছে। ইসির চিঠিতে উলেস্নখ করা শেষ দু'টি বিষয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামের পদর্াপ্রথা অনুসরণ করতে গিয়ে মজলিশে শূরায় সরাসরি নারীদের বক্তব্য নেয়া হয় না। তবে পদর্ার ওপাশে তারা উপস্থিত থাকেন। কমিশনের চিঠির জবাবে এটা আমরা অবশ্যই স্পষ্ট করব।
অমুসলিমদের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে থেকেই অমুসলিমদের জামায়াতে যোগ দিতে কোন বাধা নেই। তবে এটা ঠিক কেন্দ্রীয় পযর্ায়ে জামায়াতে কোন অমুসলিম নেতা নেই। কেন্দ্রীয় নেতা তৈরি হয় পযর্ায়ক্রমে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে অমুসলিমরা কখনই কেন্দ্রীয় নেতা হবে না তা নয়।
উলেস্নখ্য, ২০০৮ সালে আরপিওর শর্ত মেনে গঠনতন্ত্রে সংশোধন এনে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন নেয়ার বিধান চালু করে। শর্ত ছিল, দলগুলোর গঠনতন্ত্র সংবিধান সম্মত হতে হবে। সে সময় জামায়াতের নাম ভারতের একটি দলের অঙ্গ সংগঠনের পযর্ায়ে পড়ায় নামসহ গুরম্নত্বপূর্ণ সব ধারায় তীব্র আপত্তি জানায় কমিশন। নিবন্ধন নেয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সে সময় নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাখে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত দলটি চাপে পড়ে প্রথম বারের মতো মুক্তিযুদ্ধের কথা গঠনতন্ত্রে যুক্ত করে। দলটির মুখবন্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা উলেস্নখ করা হয়। গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদ থেকে বাদ দেয়া হয় আলস্নাহ ও আকিমুদ্দিন শব্দ দু'টি। একাধিক জায়গায় যুক্ত করা হয় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কথাগুলো। যা আগে ছিল না।

No comments

Powered by Blogger.