তেভেজই এখন তুরুপের তাস by মোঃ সোহেল রানা

কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের বিতর্ক নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির আর্জেন্টাইন তারকা কার্লোস তেভেজের সঙ্গে দলীয় কোচ রবার্তো ম্যানচিনির বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। যে কারণে তেভেজর ক্যারিয়ারই পড়েছিল হুমকির মুখে। অবশেষে ম্যানচিনির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।


কিছুদিন আগে শুরু হওয়া নতুন মৌসুমে সেই তেভেজ যেন ফিরে পেয়েছেন পুরনো ফর্ম। এ পর্যন্ত লীগে খেলা তিনটি ম্যাচসহ মোট চারটি ম্যাচেই গোল করেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি ম্যাচেই দলের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। পুরনো বিভেদ ভুলে কোচ রবার্তো ম্যানচিনিও তেভেজ বন্দনায় ব্যস্ত রয়েছেন। আর তেভেজও বলছেন, তিনি সুখেই আছেন সিটিতে। কত ঝক্কি-ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছে গত বছর। ম্যানচেস্টার সিটি কোচ রবার্তো ম্যানচিনির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে ক্যারিয়ারই ফেলে দিয়েছিলেন হুমকির মুখে। কার্লোস তেভেজের তাই সিটি ছেড়ে যাওয়ার গুঞ্জনও রটেছিল। স্বয়ং সিটিই তেভেজকে বিক্রি করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল! সেই বিবাদের সুরাহা হয়েছিল তেভেজ নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে। এরপর থেকে আবার স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন ২৮ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। নতুন করে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই মাঠে দুর্দান্ত পারফরমেন্স প্রদর্শন করে চলেছেন। সদ্যই শুরু হওয়া নতুন মৌসুমেও আলো ছড়াচ্ছেন। ফর্মের তুঙ্গে থাকা তেভেজ তাই সিটি ছেড়ে যাওয়ার কথা আর ভাবছেন না। কিছুদিন আগে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ম্যানসিটিতে আমি ভাল আছি। এখানেই থেকে যেতে চাই। এর কয়েকদিন দেয়া আরেক সাক্ষাতকারেও তেভেজ একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে তেভেজের চুক্তির মেয়াদ ২০১৪ সাল পর্যন্ত। তেভেজ এখন সিটির প্রেমে এতটাই মুগ্ধ যে, নির্ধারিত সময়ের পরও থেকে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। সাময়িক বিবাদ যে আর তেভেজের মনে নেই সে প্রমাণ মেলে এ কথাতেই, ম্যানচেস্টার সিটিতে থাকতে আমার সমস্যা নেই। আমার পরিবার এখানে আছে, সন্তানেরা আছে। আমি খুশি, আমার স্ত্রীও খুশি। চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে আরও দুই বছর বাকি। তবে আরও বেশি সময় থাকতে পারি আমি। তিনি আরও বলেন, অতীত নিয়ে আমি ভাবছি না। এখনকার অবস্থা নিয়ে সবাই খুশি। আমিও খুশি। মোটকথা সিটিতেই আমি সুখে আছি। গত বছরের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছর সময়টা কঠিন কেটেছে। যখন ফিরে এসে খেললাম, আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম। গত মৌসুমে এটা আমার বড় পাওয়া। আমি খুশি, রবার্তোও (মানচিনি) খুশি, ক্লাবও খুশি। এরপর তিনি বলেন, এখন আর কোন সমস্যা নেই। সব সমস্যা মিটে গেছে। দুঃসময় কাটিয়ে স্বরূপে প্রত্যাবর্তনের জন্য পরিবার ও সমর্থকদের প্রশংসা করেন তেভেজ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুঃসময়ে সবসময় আমার পাশে ছিল আমার পরিবার, আমার বাবা-মা, ভাই-বোন এবং গোটা আর্জেন্টাইনবাসী। আমার জন্য ওই সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এটাই আমার চাকরি। কারণ আমি ফুটবলকে ভালবাসি।
সিটি কোচ রবার্তো ম্যানচিনিও মনে হয় আগের তিক্ততা ভুলে গেছেন। তাই তো তাঁর মুখেও তেভেজর প্রশংসা। পারফরমেন্সের কারণেই যে কোচকে খুশি করতে পেরেছেন তেভেজ তা বলাইবাহুল্য। কেননা মৌসুমের শুরু থেকেই দারুণ ফর্মে রয়েছেন তেভেজ। রবিবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে লিভারপুলের বিরুদ্ধেও দুর্দান্ত খেলেন সাবেক সিটি অধিনায়ক। দ্য রেডসদের বিরুদ্ধে দলের হার ঠেকিয়েছেন তিনিই। ম্যাচে দু-দু’বার পিছিয়ে পড়েছিল সিটি। তেভেজের গোলেই শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে ম্যানচিনির দল। ম্যাচ শেষে তাই তেভেজের প্রশংসা করতে ভোলেননি ম্যানসিটি কোচ কার্লোস (তেভেজ) খুব ভাল ফর্মে আছে। গত দু-তিন ম্যাচ ও যেভাবে খেলেছে, এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোচের সঙ্গে গত বছরের ঝামেলা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিটিয়ে ফেলেন সাবেক আর্জেন্টাইন তারকা। নিঃশর্ত ক্ষমা চান তিনি। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে কোচ ম্যানচিনির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে দলের বাইরে ছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা তেভেজ। এরপর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে তেভেজকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ম্যানচিনি। কিন্তু পাল্টা জবাব দিয়ে আবারও পরিবেশ ঘোলাটে করেছিলেন তেভেজ। তবে শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির উদয় হয় সাবেক ম্যানইউ তারকার। কোচের সঙ্গে বিবাদের বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত ক্ষমা চান তেভেজ। দলীয় শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তেভেজ বলেছিলেন, আমি ম্যানচেস্টার সিটির কাছে আমার সাম্প্রতিক আচরণ ও কর্মকা-ের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আমার এই ক্ষমাপ্রার্থনা সম্পূর্ণ নিঃশর্ত। তিনি আরও বলেছিলেন, এখন আমার লক্ষ্য একটাই, দলের সাফল্যে ভূমিকা রাখা। এরপর থেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি আরও স্বাভাবিক হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। গ্রীষ্মের দলবদলের শেষ ২৪ ঘণ্টায় ম্যানচেস্টার সিটি ঢেলেছে তিন কোটি ৭০ লাখ পাউন্ড। শক্তি বাড়িয়েছে গার্সিয়া, সিনক্লেয়ার, নাস্তাসিচ, মাইকনদের মতো খেলোয়াড়দের দলে টেনে। এসব তারকা দলে আসায় শক্তি আরও বেড়েছে। তবে কার্লোস তেভেজ যেন চলছেন আপন গতিতে। এক বছর আগের সেই বিতর্ককে মাটিচাপা দিয়ে তেভেজ হয়ে উঠছেন ম্যানচেস্টার সিটির প্রধান হাতিয়ার। আর কয়েক সপ্তাহ পরই কোচ রবার্তো মানচিনির সঙ্গে তেভেজের সেই দ্বন্দ্বের এক বছর পূর্তি। তার আগে মাঠে নেমে আগুন ঝরাচ্ছেন আর্জেন্টাইন তারকা। ক’দিন আগেই যেমন কিউপিআরের বিরুদ্ধে দলের ৩-০ গোলের জয়ে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার করেছেন শেষ গোলটি। এ নিয়ে নতুন মৌসুমে সিটির চার ম্যাচেই গোল করলেন তেভেজ। চেলসির বিপক্ষে কমিউনিটি শিল্ডের পর লীগের তিন ম্যাচেই গোল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিউপিআর ম্যাচেই তেভেজ ছিলেন দুর্দান্ত। ম্যাচসেরার পুরস্কার এরই স্বীকৃতি। কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিরুদ্ধে সিটির কোচ হিসেবে মানচিনির শততম লীগ ম্যাচ ছিল। কোচের মাইলফলক ম্যাচটি রঙিন হয় তেভেজ, ইয়া তোরে ও এডিন জেকোর গোলে। গত ২০১০-১১ মৌসুমে তেভেজের অধিনায়কত্বে এফএ কাপের শিরোপা জিতেছিল ম্যানসিটি। ১৯৭৬ সালের পর এটিই ছিল দলটির জন্য বড় কোন শিরোপা জয়। ওই সময় তেভেজ তাঁর পরিবারের কাছাকাছি থাকার জন্য (আর্জেন্টিনায় বাস করে তেভেজের স্ত্রী ও দুই মেয়ে) ম্যানসিটি ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন অনেকদিন ধরেই। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়ায় ও ক্লাবের অপরিহার্য ফুটবলার বিধায় ক্লাবও তাঁকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাঁকে একাধিকবার ক্লাবে থেকে যেতে অনেক কষ্টে রাজি করায়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারও ক্লাব ছাড়ার ভূত মাথায় চেপে বসে তেভেজের। সর্বশেষ চলে যেতে চেয়েছিলেন ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। দলবদলের মৌসুমে অন্য দলে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। কিন্তু ম্যানসিটি ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড দর হাঁকানোয় অন্য কোন ক্লাব এত মূল্যে তাঁকে কিনতে অনাগ্রহী হওয়ায় তেভেজ আবারও আটকা পড়েন ক্লাবে। গত মৌসুমে কোচ ম্যানচিনির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোর পর মনে হচ্ছিল তেভেজের সিটি ছাড়া সময়ের ব্যাপার।

No comments

Powered by Blogger.