ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল : রায়ে দুই বিচারপতির অভিমত-তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করলে ফিরে আসবে অর্থ ও পেশিশক্তি by আশরাফ-উল-আলম ও এম বদি-উজ-জামান
নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হলে আবারও অর্থ ও পেশিশক্তি জাতীয় নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। আর তাই ১৫ বছর পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রশ্নই ওঠে না। গত রবিবার বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে দুই বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ
করে তাঁদের রায়ে এ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সাংবিধানিক বলেও অভিহিত করেছেন। যদিও সাত বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা বাতিল করে দিয়েছেন।
দুই বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা রায়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁদের অভিমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বর্তমান সরকার (আওয়ামী লীগ) ও অন্য রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। ওই সংশোধনী গণতন্ত্রের নৌকাকে রক্ষা করেছিল, যা প্রায় ডুবতে বসেছিল। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
দুই বিচারপতি ১৭৮ পৃষ্ঠার লিখিত রায়ে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হলে নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ পিছিয়ে যাবে। বিষয়টি জনগণ গ্রহণ করায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ৪৯টি যুক্তি রায়ে তুলে ধরেছেন। রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
দুই বিচারপতি তাঁদের অভিমতে বলেন, বর্তমানে সংসদের সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতা মুখোমুখি হন না। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। বর্তমানে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
সংবিধানের কোনো সংশোধনীর অপব্যবহার করা হয়েছে বা করার আশঙ্কা আছে- নিছক এ অজুহাতে তাকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা যায় না, যদি তা সংবিধানের মৌল কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস না করে। ২০০৬-০৮ সালের ঘটনাপ্রবাহের সময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অপব্যবহার করা হয়েছে। তার দায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর চাপানো যায় না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংবিধানে যে কয়েকটি বিকল্প ছিল তিনি সেগুলোর প্রয়োগ করেননি। যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে সেটা ছিল রাষ্ট্রপতির ত্রুটি। আইনকে এ জন্য দোষারোপ করা যায় না।
দুই বিচারপতির আরো অভিমত, ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, অতীতের ক্ষমতাসীন দলের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এটা নিয়মে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় সবার সম্মতিতে ও জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল। এরপর তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণ করে ওই ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের সমর্থন প্রকাশ করেন। এখন ১৫ বছর পর ওই ব্যবস্থা বাতিল করার কোনো যুক্তি নেই। যদি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয় তাহলে আবারও অর্থ আর পেশিশক্তি নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সরকারি যন্ত্রের ওপর অযাচিত প্রভাব সৃষ্টি করে নির্বাচনে কারচুপি করে, ফলাফলকে পাল্টে দেয়। এমনটি হলে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণের যে সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে, তার আর অস্তিত্ব থাকবে না।
নির্বাচিত সরকারের অধীনে একটি, দুটি বা তার অধিক নির্বাচন অবাধ, অস্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হলেই এ গ্যারান্টি দেওয়া যায় না যে, ক্ষমতাসীন সরকার আগামী নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করবে না। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী একটি সরকার উপনির্বাচনে একটি-দুটি আসনে পরাজিত হলেও কিছু যায় আসে না। একইভাবে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছভাবে করলেও তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া নির্ধারিত হয় না।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণ প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ যদি অবাধে ভোট দিতে না পারে তবে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস_এটা বলা যাবে না। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের সেই অধিকারকেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে; ওই সংশোধনী গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেনি।
দুই বিচারপতি রায়ে আরো বলেন, গণতন্ত্র ও সংসদ বিষয়ে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের অংশ এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্যাস হলো অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ। কাজেই অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়া গঠিত সংসদ সত্যিকার অর্থে বৈধ হতে পারে না এবং তা সার্বভৌমত্ব হতে পারে না। এ ধরনের সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়া কোনো সংসদ গঠিত হলে ওই সংসদের জন্য আমাদের বিশেষ মোহ ও ভালোবাসা থাকা উচিত নয়।
সংবিধানের ৫৭ (২) অথবা ৭২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ বিলুপ্ত হলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সংসদ সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ধরা হবে। কাজেই তাঁরা সংসদ তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগেও সংবিধানের ৫৭ (৩) ও ৫৮ (৪) অনুচ্ছেদে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা ছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম দিয়ে এর গঠনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে মাত্র। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতিসাধন করা হয়নি উল্লেখ করে দুই বিচারপতি তাঁদের রায়ে বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান রেখে কোনো সাংবিধানিক সমস্যার সৃষ্টি করা হয়নি। বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও দুজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন যাঁরা সংসদ সদস্য নন (নির্বাচিত নন)।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে এমন একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা পরে পূর্ণ মেয়াদে সত্যিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকার দিয়ে এটা সম্ভব ছিল না। কাজেই সংবিধানের ওই সংশোধনীকে বাতিল করার প্রশ্নই ওঠে না।
দুই বিচারপতির রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের প্রধান হলেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। নির্দলীয় সরকারের সময় যেহেতু সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকে, সেহেতু (এ অবস্থায়) নির্বাচিত সরকারের চেহারা হারিয়ে যায় না। ওই সরকারও গণতান্ত্রিক এবং জনগণের দ্বারা গঠিত বলেই গণ্য। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেহেতু নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রের প্রধান থাকেন, কাজেই রাষ্ট্রের ও সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক চেহারাটা অটুট থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে না। কারণ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার তিনটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত যথা মেয়াদের নিরাপত্তা (সুনির্দিষ্টকরণ), আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
অভিমতে বলা হয়, গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আলোচনা ও ঐকমত্য। ১৯৯৬ সালের মতোই সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারেও সংবিধানের সংশোধনী আনা যেতে পারে। এটা অবৈধ হয় না।
দুই বিচারপতি বলেন, সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ নির্বাচনের ম্যান্ডেট দেয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীরা তো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁরা তখন একে লজ্জা বলে মন্তব্য করেননি। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেলও একে লজ্জা বলেননি।
এসব কারণে (ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ বলে ঘোষিত) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কোনো কারণ তাঁরা (বিচারপতিদ্বয়) দেখেন না। এ কারণে আপিল ও লিভ পিটিশন নামঞ্জুর করেন দুই বিচারপতি।
দুই বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা রায়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁদের অভিমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বর্তমান সরকার (আওয়ামী লীগ) ও অন্য রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। ওই সংশোধনী গণতন্ত্রের নৌকাকে রক্ষা করেছিল, যা প্রায় ডুবতে বসেছিল। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
দুই বিচারপতি ১৭৮ পৃষ্ঠার লিখিত রায়ে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হলে নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ পিছিয়ে যাবে। বিষয়টি জনগণ গ্রহণ করায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ৪৯টি যুক্তি রায়ে তুলে ধরেছেন। রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
দুই বিচারপতি তাঁদের অভিমতে বলেন, বর্তমানে সংসদের সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতা মুখোমুখি হন না। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। বর্তমানে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
সংবিধানের কোনো সংশোধনীর অপব্যবহার করা হয়েছে বা করার আশঙ্কা আছে- নিছক এ অজুহাতে তাকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা যায় না, যদি তা সংবিধানের মৌল কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস না করে। ২০০৬-০৮ সালের ঘটনাপ্রবাহের সময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অপব্যবহার করা হয়েছে। তার দায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর চাপানো যায় না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংবিধানে যে কয়েকটি বিকল্প ছিল তিনি সেগুলোর প্রয়োগ করেননি। যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে সেটা ছিল রাষ্ট্রপতির ত্রুটি। আইনকে এ জন্য দোষারোপ করা যায় না।
দুই বিচারপতির আরো অভিমত, ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, অতীতের ক্ষমতাসীন দলের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এটা নিয়মে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় সবার সম্মতিতে ও জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল। এরপর তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণ করে ওই ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের সমর্থন প্রকাশ করেন। এখন ১৫ বছর পর ওই ব্যবস্থা বাতিল করার কোনো যুক্তি নেই। যদি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয় তাহলে আবারও অর্থ আর পেশিশক্তি নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সরকারি যন্ত্রের ওপর অযাচিত প্রভাব সৃষ্টি করে নির্বাচনে কারচুপি করে, ফলাফলকে পাল্টে দেয়। এমনটি হলে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণের যে সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে, তার আর অস্তিত্ব থাকবে না।
নির্বাচিত সরকারের অধীনে একটি, দুটি বা তার অধিক নির্বাচন অবাধ, অস্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হলেই এ গ্যারান্টি দেওয়া যায় না যে, ক্ষমতাসীন সরকার আগামী নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করবে না। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী একটি সরকার উপনির্বাচনে একটি-দুটি আসনে পরাজিত হলেও কিছু যায় আসে না। একইভাবে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছভাবে করলেও তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া নির্ধারিত হয় না।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণ প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ যদি অবাধে ভোট দিতে না পারে তবে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস_এটা বলা যাবে না। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের সেই অধিকারকেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে; ওই সংশোধনী গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেনি।
দুই বিচারপতি রায়ে আরো বলেন, গণতন্ত্র ও সংসদ বিষয়ে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের অংশ এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্যাস হলো অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ। কাজেই অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়া গঠিত সংসদ সত্যিকার অর্থে বৈধ হতে পারে না এবং তা সার্বভৌমত্ব হতে পারে না। এ ধরনের সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়া কোনো সংসদ গঠিত হলে ওই সংসদের জন্য আমাদের বিশেষ মোহ ও ভালোবাসা থাকা উচিত নয়।
সংবিধানের ৫৭ (২) অথবা ৭২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ বিলুপ্ত হলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সংসদ সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ধরা হবে। কাজেই তাঁরা সংসদ তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগেও সংবিধানের ৫৭ (৩) ও ৫৮ (৪) অনুচ্ছেদে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা ছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম দিয়ে এর গঠনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে মাত্র। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতিসাধন করা হয়নি উল্লেখ করে দুই বিচারপতি তাঁদের রায়ে বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টা নিয়োগের বিধান রেখে কোনো সাংবিধানিক সমস্যার সৃষ্টি করা হয়নি। বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও দুজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন যাঁরা সংসদ সদস্য নন (নির্বাচিত নন)।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে এমন একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা পরে পূর্ণ মেয়াদে সত্যিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকার দিয়ে এটা সম্ভব ছিল না। কাজেই সংবিধানের ওই সংশোধনীকে বাতিল করার প্রশ্নই ওঠে না।
দুই বিচারপতির রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের প্রধান হলেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। নির্দলীয় সরকারের সময় যেহেতু সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকে, সেহেতু (এ অবস্থায়) নির্বাচিত সরকারের চেহারা হারিয়ে যায় না। ওই সরকারও গণতান্ত্রিক এবং জনগণের দ্বারা গঠিত বলেই গণ্য। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেহেতু নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রের প্রধান থাকেন, কাজেই রাষ্ট্রের ও সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক চেহারাটা অটুট থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে না। কারণ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার তিনটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত যথা মেয়াদের নিরাপত্তা (সুনির্দিষ্টকরণ), আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
অভিমতে বলা হয়, গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আলোচনা ও ঐকমত্য। ১৯৯৬ সালের মতোই সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারেও সংবিধানের সংশোধনী আনা যেতে পারে। এটা অবৈধ হয় না।
দুই বিচারপতি বলেন, সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ নির্বাচনের ম্যান্ডেট দেয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীরা তো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁরা তখন একে লজ্জা বলে মন্তব্য করেননি। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেলও একে লজ্জা বলেননি।
এসব কারণে (ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ বলে ঘোষিত) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কোনো কারণ তাঁরা (বিচারপতিদ্বয়) দেখেন না। এ কারণে আপিল ও লিভ পিটিশন নামঞ্জুর করেন দুই বিচারপতি।
No comments