লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যার নেপথ্যে by অতুল আনেজা

‘লিবীয় বিপ্লবের’ তথাকথিত সাফল্যের পর দেশটি উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহের অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলার ১১তম বার্ষিকীর সময়ের সঙ্গে মিল রেখে লিবিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন ক্রিস্টোফার স্টিভেন্সকে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ঘাতকরা ভয়াবহ


এক হামলার মাধ্যমে হত্যা করেছে। ঘটনাদৃষ্টে মনে হবে, আক্রমণকারীরা ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ অপমানের নীলনকশা আর বরদাশত করবে না।
যেভাবে ১১ সেপ্টেম্বরের নৃশংস ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়ে সবার সামনে প্রকাশিত হলো, তাতে এ বিষয়টি স্পষ্টতর হচ্ছে যে, নিহত রাষ্ট্রদূত; যিনি একজন পেশাদার কূটনীতিক, সম্ভবত অত্যন্ত অভিজ্ঞ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সমন্বিত পরিকল্পনার শিকার হয়েছেন। এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, অন্তত ২০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ এই বর্বর হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। একটি আমেরিকান চলচ্চিত্রে ইসলামের নবীকে (স) অবমাননাকরভাবে উপস্থানের ঘটনায় ব্যথিত শত শত বিক্ষোভকারী লিবিয়ায় মার্কিন কনস্যুলেটের বাইরে গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে জড়ো হয়েছিল; স্পষ্টতই এ বিক্ষোভের মাধ্যমে তাদের তেমন কিছু করার ছিল না। সন্ধ্যা অবধি সেখানে তাদের অবস্থান ছিল সম্ভবত একটি ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য, যার সুযোগে হামলাকারীরা সেখানে অনুপ্রবেশের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছিল।
চরমপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাজকর্ম নিরীক্ষণে ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কুইলাম এই বিক্ষোভের জন্য জঙ্গী গ্রুপগুলোর দায়বদ্ধতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। কুইলামের প্রেসিডেন্ট নোমান বেনোটাম ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, হামলার সময় যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল, তা ছিল ‘নিয়ন্ত্রণ অসাধ্য জঙ্গীবাদী গ্রুপসমূহের একটি সংকেত।’
বিক্ষোভে ইসলামী জঙ্গীবাদী গ্রুপসমূহের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা জোরদার হয়েছে ২০১১ সালে আল কায়েদাপ্রধান ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরি কর্তৃক প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বানের মধ্য দিয়ে। গত ১০ সেপ্টেম্বর, সোমবার ৪২ মিনিটব্যাপী এক ভিডিও চিত্রে তিনি লিবিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ক্লেরিক হাসান মোহাম্মদ কায়েদ ওরফে আবু ইয়াহিয়া আল-লিবি গত জুন মাসে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করেন। জাওয়াহিরি তাঁর ভিডিওতে বলেন, ‘শাহাদাতের বিনিময়ে আল্লাহ্ শেখ হাসান মোহাম্মদ কায়েদের প্রতি করুণা করুন, জনগণ তাঁর লেখা এবং আহ্বানের দ্বারা আগের চেয়েও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে। ‘‘তার রক্ত তোমাদের উদ্দীপ্ত করবে এবং তোমাদের লড়াই করতে ও আক্রমণকারীদের হত্যা করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।’’
অতীতের দিকে দৃষ্টি দিলে মনে হয়, রাষ্ট্রদূত স্টিভেন্স তাঁর দেশের ৯/১১-পরবর্তী ‘সরকার পাল্টানোর’ অপরিণামদর্শী নীতির শিকার হয়ে থাকতে পারেন। এই নীতি ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন বৃহত্তর আরব জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের জন্য টার্গেট করে; যদিও তারা ইসলামী চরমপন্থীদের কঠোরভাবে দমন করেছিল। ৯/১১-পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ শুরু হয়, তার প্রথম ধাক্কাই ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে সরিয়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অনুমানভিত্তিক অভিযোগ তোলা হয় যে, তার সরকার ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্রভা-ার গড়ে তুলছে, যা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলশ্রুতিতে, বাথপার্টি সমর্থিত সরকারের পতনে জিহাদী গ্রুপসমূহের জন্য ইরাকে অনুপ্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তারা এ অঞ্চলে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর ন্যাটোর সমর্থনে চরমপন্থীদের নেতৃত্বদানকারী লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে নির্মমভাবে হত্যার পর লিবিয়া ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ (খওঋএ)-এর নেতৃত্বে নজিরবিহীন জিহাদী ঘোষণা জারি করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের নেতা আবদেল হাকিম বেলহাজ ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে অংশ নিয়ে তাঁর দক্ষতাকে শাণিত করেছেন। ৯/১১-এর ঘটনার পর বেলহাজ পাকিস্তানে চলে যান, তারপর ইরাকে। এখানে সন্ত্রাসীদের নেতা আবু মুসাব আল-জারকাউয়ির সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কলামিস্ট পেপে এস্কোবার এশিয়া টাইমস-এ লেখেন, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে লিবিয়া ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ আল কায়েদা ইসলামিক মাগরেব বা অছওগ-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়, এবং এই সম্মিলনের বিষয়টি আল কায়েদার তৎকালীন দ্বিতীয় শীর্ষনেতা জাওয়াহিরি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। ৯/১১ পর্যন্ত লিবিয়া ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ সিআই-এর সর্বক্ষণিক নিবিড় নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ছিল; এর প্রধান নেতা বেলহাজ ২০০৩ সালে মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার হন। ব্যাঙ্ককের একটি গোপন কারাকক্ষে বেলহাজের প্রতি উপর্যুপরি অত্যাচার চালানো হয় এবং এক বছর পর মার্কিন প্রশাসন ও লিবিয়া সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হলে তাকে লিবীয় গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চার অংশ হিসেবে গাদ্দাফি সরকার ২০১০ সালের মার্চে এই জিহাদী নেতাকে মুক্তি দেন। সাবেক সরকারের এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। কারণ মার্কিন বিশেষ সেনাবাহিনী দ্বারা সুপ্রশিক্ষিত বেলহাজের ‘ত্রিপোলি ব্রিগেড’ একটি সুচতুর অগ্রবর্তী বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী সমতল থেকে পর্বতমালা সর্বত্র বিচরণ করত এবং এই বাহিনীই গাদ্দাফির সুরক্ষিত প্রাসাদ বাব আল-আজিজিয়া অবরোধ করে।
আরব বসন্তের ছত্রছায়ায় লিবীয় বিপ্লবের তথাকথিত সাফল্যের পর লিবিয়া এখন উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার বৃহৎ অংশে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত জঙ্গীগোষ্ঠীসমূহের সন্ত্রাস বিস্তৃতির চারণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ব্রুস রিডেল জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত এক কলামে স্বীকার করেছেন, লিবিয়া ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের মিত্র অছওগÑযেমনটি উল্লেখ করেছেন এশিয়া টাইমসের মি. এস্কোবারÑ‘২০০১ সালে আফগানিস্তানে বড় ধরনের পতনের পর আফ্রিকার উত্তর মালিতে নতুন এক শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, অছওগ স্থানীয় চরমপন্থী গ্রুপ আনসার দাইনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে এবং এ দু’য়ে মিলে মালির উত্তরাঞ্চলে দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার ওপর তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রুস রিডেল লক্ষ্য করেছেন, ‘এই দুই মিত্র এখন প্রাচীননগরী তিমবুকতুর ইসলামী ঐতিহ্য বিপুলভাবে ধ্বংস করছে; যেমনভাবে ৯/১১-এর পর আল কায়েদা এবং তালিবান বহু বছরের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যসমূহ ধ্বংস করেছিল।’
আংশিকভাবে লিবিয়া ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের প্রচেষ্টায় আল কায়েদা এখন সিরিয়ার মাটিতে শক্তভাবে খুঁটি গেড়ে বসেছে। এই হলো ‘সরকার পরিবর্তন’ যা সমগ্র অঞ্চলব্যাপী নবনির্মাণের লক্ষ্যে আল কায়েদা কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে। এটি শুধু বিপর্যয়কেই প্রলম্বিত করতে পারে, যা বেনগাজিতে মার্কিন কূটনীতিকের দুঃখজনক হত্যার ঘটনার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ব্যাপক।ম
দি হিন্দু থেকে অনুবাদ : মুস্তাফা মাসুদ

No comments

Powered by Blogger.