গাছতলার স্কুল by মাহফুজুর রহমান মানিক

শ্রেণীকক্ষের অভাবে গাছতলায় ক্লাস হচ্ছে_ এ ধরনের চিত্র গণমাধ্যমে প্রায়ই আসে। অবশ্য সোমবারের ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় 'গাছতলায় আসন পেতে গুরুদক্ষিণার পাঠশালা' শিরোনামে যে পাঠশালার কথা বলা হচ্ছে এবং সে পাঠশালার ক্লাস যে গাছতলায় হচ্ছে সেটা কিছুটা ভিন্ন ধরনের।


মুর্শিদাবাদের পৃথি্বরাজ ঘোষ হাজরা যিনি স্কুলজীবনে এলাকার সোলেমান স্যারের কাছে পড়তেন। স্যারের দক্ষিণা সামান্য হলেও পৃথি্বরাজের সেটা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। স্যার কিন্তু যথার্থ গুরুর দায়িত্ব পালন করে বলেছেন, তোমাকে গুরুদক্ষিণা দিতে হবে না, তুমি বড় হয়ে তোমার মতো অসামর্থ্যদের পড়াশোনা করাবে, সেটাই গুরুদক্ষিণা। পৃথি্বরাজ অবশ্য কথা রেখেছেন। স্নাতক পাস করেই পাড়ার একটা বাড়ির ভাঙা বারান্দায় তিনজনকে নিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছিলেন, যাদের দু'জন যাযাবরের সন্তান এবং একজন শিশু শ্রমিক। বিনাবেতনে পৃথি্বরাজের পড়ানো দেখে গরিব পরিবারগুলো তাদের ছেলেমেয়েদের তার কাছে পাঠাতে লাগল। পৃথি্বরাজের শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় তাকে শেষ পর্যন্ত যেতে হয়েছে গাছতলায়। ছয় বছর ধরে গাছতলায়ই সহায়-সম্বলহীন পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিষ্ঠার সঙ্গে পড়িয়ে যাচ্ছেন। এখন তার ছাত্রছাত্রী ষাট। পৃথি্বরাজের ছয় বছরের নিষ্ঠা মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মকর্তারাও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার গাছতলার বিদ্যালয়ই হয়তো একদিন পাকা দালান হবে। পৃথি্বরাজের বিদ্যালয়ের সফলতা এখানেই যে, তিনি সমাজের একেবারে অবহেলিত পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর বন্দোবস্ত করেছেন। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো শিশু শ্রমিকরাও এই বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করতে পারছে। বিদ্যালয়টি বসে সকালে।
আমাদের দেশে এখনও অনেক শিশু শিক্ষার বাইরে। সরকারের হিসাব মতে ৯৯ ভাগ শিশু বিদ্যালয়ে গেলেও অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ে। গণসাক্ষরতা অভিযান তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, এখনও ৪৯ লাখ শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এ শিশুদের অধিকাংশই নানা ধরনের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। পরিসংখ্যান ব্যুরো এক হিসাবে দেখাচ্ছে, ৩২ লাখ শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত, এর মধ্যে ১৩ লাখ একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম করে যাচ্ছে।
পৃথি্বরাজদের বিদ্যালয়ে কিন্তু সবাই পড়তে পারছে, হোক যাযাবর কিংবা হরিজন। আমাদের দেশে এখনও অনেক জায়গায় সে বৈষম্যটা রয়ে গেছে। সামাজিক বৈষম্য আমাদের এ রকম নানা পশ্চাৎপদ পরিবারের শিশুদের পিছিয়ে রাখছে।
শিশু শ্রমিক ও এ শিশুদের জন্য শিক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্য অনেকে স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে এদের শিক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে সেটা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। একটি উদ্যোগের কথা তো বলাই যায়, ১৯৯৪ সালে রংপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার ফাতেমা ইয়াসমিন ইরার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সুইপার শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল হরিজন প্রাথমিক বিদ্যালয়। অর্থাভাবে সেটি একদিন
বন্ধ হয়ে যায়।
সরকার সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়, ফলে তাদের এ রকম স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো প্রমোট করা দরকার, যেন এ ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়ে।
পৃথি্বরাজের উদ্যোগ যেভাবে আনন্দবাজার সামনে নিয়ে এসেছে, একইভাবে আমাদের এ রকম উদ্যোগগুলোকেও গণমাধ্যমের মাধ্যমে সামনে আসা উচিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি সরকারের সহযোগিতায় সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত হবে, হোক না সেটা গাছতলার কোনো স্কুল।
 

No comments

Powered by Blogger.