ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক- বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক by আরাফাত মুন্না
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে আপীল বিভাগের দেয়া ঐতিহাসিক পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংশোধনী রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সংবিধানের মূল কাঠামোর মৌলিক নীতির পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।
সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে অভিমত দেয়া হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীকে মূল সংবিধানের স্বতঃসিদ্ধ আদর্শিক নীতিগুলোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক বলেও অভিহিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়টি লিখেছেন রায় ঘোষণাকারী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার এ রায়ের সঙ্গে একমত হয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহ আরও দুই বিচারপতি।
এদিকে, এ রায়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশকারী আপীল বিভাগের বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা রায়ে বলেছেন, সংবিধানের ৫৭ (৩) ও ৫৮ (৪) অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ছিল। ১৩তম সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে একটি শান্তিপূর্ণ স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কিছু পরিবর্তন এনেছিল মাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে, আপীল বিভাগের আরেক বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম না রেখে ‘নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নাম দেয়ারও প্রস্তাব করেছেন, যাতে কখনও রাজনৈতিক দলের পদধারী ছিলেন এমন কাউকে প্রধান না করার কথা বলেছেন। তিনি তাঁর লিখিত রায়ে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। গত রবিবার রাতে প্রকাশিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার দীর্ঘ ৪৯৫ দিন পর ৭৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে স্বাক্ষর করেছেন আপীল বিভাগের সাতজন বিচারপতি।
রায় ঘোষণাকারী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা), বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মোঃ ইমান আলী পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। এদের মধ্যে আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন সৈয়দা নাজমুন আরা এবং বিচারপতি ইমান আলী সংসদের হাতে ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৭৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায়ের সংক্ষিপ্ত রূপ নিচে দেয়া হলো।
এবিএম খায়রুল হক
তাঁর রায়ে বলেছেন
ত্রয়োদশ সংশোধনী কার্যকর হলে যে মেয়াদে ৫৮ (খ) অনুচ্ছেদের অধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে সেই মেয়াদে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আইন দ্বারা সরাসরি পরিচালিত হবে অর্থাৎ ঐ সময়ের জন্য তিনি রাজনৈতিক সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের সঙ্গে তিনি একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করবেন। সাধারণ সময়ে দায়িত্ব পালনরত প্রতিরক্ষামন্ত্রী একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি বটে কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিকভাবে প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। মূল সংবিধান প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের নির্বাহী দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করেনি, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের উপর করেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নির্বাহী দায়িত্ব পালন মূল সাংবিধানিক পরিকল্পনার সহিত সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘৫৮ (ঙ) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় বিবেচনা অনুসারে তাঁর একক সিদ্ধান্তে দেশে জরুরী-অবস্থা ঘোষণার নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করে। এই একক ক্ষমতা প্রথমতঃ রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক নিয়মাতান্ত্রিক অবস্থানের পরিপন্থী এবং দ্বিতীয়তঃ সংবিধানের ৪৮ (৩) ও ১৪১ ক (১) অনুচ্ছেদের শর্তে প্রদত্ত সাংবিধানিক রক্ষাকবচের সহিত সাংঘর্ষিক। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বৈরাচারীর ভূমিকায় যাবার একটি সম্ভাবনা থেকে যায়।’
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘৫৮ (খ) অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী থাকবে। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার মন্ত্রিসভার মন্ত্রিগণ তাঁহাদের কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট দায়বদ্ধ থাকেন না। বরঞ্চ ৫৫ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ও সংসদ-সদস্যগণের মাধ্যমে সার্বভৌম জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। ইহাই গণতান্ত্রিক নীতি ও রীতি। এমতা অবস্থায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মূল সংবিধানের সর্বশ্রেষ্ঠ শর্ত বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব তাহা খর্ব হয় এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে রাজার ন্যায় রাষ্ট্রপতি সার্বভৌম হন। ইহা সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেয়াদে খসড়া অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করে, কিন্তু উপদেষ্টাগণ কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নহেন। কাজেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের অধ্যাদেশগুলির খসড়া অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অনুমোদিত, যা জনগণের কর্তৃত্ব তথা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সহিত সাংঘর্ষিক। সর্বসময়ে ইহা হƒদয়ে খোদিত থাকিতে হইবে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি চিরন্তন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এমনকি তাত্ত্বিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সহিত সরাসরি সাংঘর্ষিক।’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৩তম সংশোধনী মূল সংবিধানের ভিত্তি দুই প্রধান মূল চরিত্র প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে গোষ্ঠীতন্ত্র আনয়ন করিয়াছে, যাহার প্রধান রাষ্ট্রপতি নিজে। এইরূপ গোষ্ঠীতন্ত্রের সহিত মূল সংবিধানের স্বতঃসিদ্ধ নীতিগুলি একেবারেই অসংগতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানের ‘চড়ষব-ংঃধৎ ৭ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এছাড়া রাষ্ট্রপতি যদি ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদের (৬) দফা অনুযায়ী স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাহা হইলে বাংলাদেশ একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হইবে। ইহাও মূল সংবিধানের স্বতঃসিদ্ধ আদর্শিক নীতিগুলির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।’
বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘প্রথমতঃ একজন বিচারকের মানসিক শক্তিই হইতেছে বিচার বিভাগের প্রধান শক্তি। প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের বিষয়টি না থাকিলে একজন প্রধান বিচারপতি মানসিক চাপ হইতে মুক্ত থাকিয়া সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকিতে পারিবেন। দ্বিতীয়তঃ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলের সমর্থক আইনজীবীগণের রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট চাপ হইতে প্রধান বিচারপতি মুক্ত থাকিতে পারিবেন। এই দুইটি বিষয়ই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বার্থে অবশ্যই প্রধান বিচারপতি ও আপীল বিভাগের বিচারকগণকে দেশের রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার দায়ভার হইতে রক্ষা করিতে হইবে। বিচারকগণের সাংবিধানিক দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের প্রতি ও সকল বিচার প্রার্থীগণের প্রতি। রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণে বিচারকগণের কোনই সাংবিধানিক বা নৈতিক দায়িত্ব নাই। উলেখ্য যে, তর্কিত সংশোধনীটি রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার কারণেই আনয়ন করিতে হইয়াছে। রাজনীতিবিদগণের নিজেদের দায় ও দায়িত্ব তাহাদের নিজেদেরকেই বহন করিতে হইবে। বিচার বিভাগ তাহা বহন করিবে না। অন্যথায় বিচার বিভাগ নিজেই আস্থা সংকটে পড়িবে।’
রায়ের অভিমতে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল পূর্বে, যথা, ৪২ (বেয়াল্লিশ) দিন পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এছাড়া সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ হতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে যাঁরা এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো। তবে, জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণকে বাদ দেয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করিতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাহাদিগকে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। বরঞ্চ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল কাঠামো এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হইয়াছে। ওপরে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বহাল থাকিবে। তবে শুধু আইনদ্বারা কোন ব্যবস্থাই সকল সময়ের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিñিদ্র করা সম্ভব নয়। জনগণের সদাসর্বদা সচেতনতাই প্রয়োজন।
রায়ে ১৬টি সারমর্ম দেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, এতে বলা হয়েছে, ‘(১) জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম; (২) বাংলাদেশের সরকার মানুষের সরকার নহে, আইনের সরকার (এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ষধংি ধহফ হড়ঃ মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ সবহ); (৩) সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, ইহা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে; (৪) জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব; (৫) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ধরনের ছেদ (রহঃবৎৎঁঢ়ঃরড়হ) বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না; (৬) সুপ্রীমকোর্ট ইহার ঔঁফরপরধষ জারির এর ক্ষমতাবলে যে কোন অসাংবিধানিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করিতে পারে বা বাতিল (ঝঃৎরশব ড়ভভ) করিতে পারে; (৭) কোন মোকদ্দমার শুনানিকালে কোন আইনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে সুপ্রীমকোর্ট সে সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না, আইনের প্রশ্নটি নিরসন করাই সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব; (৮) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে জাতীয় সংসদ সংবিধানের যে কোন সংশোধন করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব ক্ষুণœœ বা খর্ব বা সংশোধন করিতে পারে না; (৯) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন (ধসবহফসবহঃ) করিয়াছে; (১০) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব-কে খর্ব করিয়াছে বিধায় উক্ত তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ, সুতরাং বাতিল হইবে; (১১) বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ও কারণাধীনে কোন আইন ভাবীসাপেক্ষভাবে (চৎড়ংঢ়বপঃরাবষু) অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাইতে পারে; (১২) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল (ৎবধংড়হধনষব ঢ়বৎরড়ফ) পূর্বে, যথা, ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন; (১৩) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমত নূতনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে; (১৪) সাধারণ নির্বাচনের তফসীল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে; (১৫) বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬ (২) অনুচ্ছেদের শর্ত (চৎড়ারংড়) এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের স্বার্থে আনায়ন করা প্রয়োজন; (১৬) ২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বৎসর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (পড়হফড়হব) করা হইল।’ (অসমাপ্ত)
এদিকে, এ রায়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশকারী আপীল বিভাগের বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা রায়ে বলেছেন, সংবিধানের ৫৭ (৩) ও ৫৮ (৪) অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ছিল। ১৩তম সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে একটি শান্তিপূর্ণ স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কিছু পরিবর্তন এনেছিল মাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে, আপীল বিভাগের আরেক বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম না রেখে ‘নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নাম দেয়ারও প্রস্তাব করেছেন, যাতে কখনও রাজনৈতিক দলের পদধারী ছিলেন এমন কাউকে প্রধান না করার কথা বলেছেন। তিনি তাঁর লিখিত রায়ে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। গত রবিবার রাতে প্রকাশিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার দীর্ঘ ৪৯৫ দিন পর ৭৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে স্বাক্ষর করেছেন আপীল বিভাগের সাতজন বিচারপতি।
রায় ঘোষণাকারী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা), বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মোঃ ইমান আলী পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। এদের মধ্যে আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন সৈয়দা নাজমুন আরা এবং বিচারপতি ইমান আলী সংসদের হাতে ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৭৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায়ের সংক্ষিপ্ত রূপ নিচে দেয়া হলো।
এবিএম খায়রুল হক
তাঁর রায়ে বলেছেন
ত্রয়োদশ সংশোধনী কার্যকর হলে যে মেয়াদে ৫৮ (খ) অনুচ্ছেদের অধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে সেই মেয়াদে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আইন দ্বারা সরাসরি পরিচালিত হবে অর্থাৎ ঐ সময়ের জন্য তিনি রাজনৈতিক সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের সঙ্গে তিনি একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করবেন। সাধারণ সময়ে দায়িত্ব পালনরত প্রতিরক্ষামন্ত্রী একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি বটে কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিকভাবে প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। মূল সংবিধান প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের নির্বাহী দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করেনি, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের উপর করেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নির্বাহী দায়িত্ব পালন মূল সাংবিধানিক পরিকল্পনার সহিত সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘৫৮ (ঙ) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় বিবেচনা অনুসারে তাঁর একক সিদ্ধান্তে দেশে জরুরী-অবস্থা ঘোষণার নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করে। এই একক ক্ষমতা প্রথমতঃ রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক নিয়মাতান্ত্রিক অবস্থানের পরিপন্থী এবং দ্বিতীয়তঃ সংবিধানের ৪৮ (৩) ও ১৪১ ক (১) অনুচ্ছেদের শর্তে প্রদত্ত সাংবিধানিক রক্ষাকবচের সহিত সাংঘর্ষিক। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বৈরাচারীর ভূমিকায় যাবার একটি সম্ভাবনা থেকে যায়।’
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘৫৮ (খ) অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী থাকবে। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার মন্ত্রিসভার মন্ত্রিগণ তাঁহাদের কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট দায়বদ্ধ থাকেন না। বরঞ্চ ৫৫ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ও সংসদ-সদস্যগণের মাধ্যমে সার্বভৌম জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। ইহাই গণতান্ত্রিক নীতি ও রীতি। এমতা অবস্থায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মূল সংবিধানের সর্বশ্রেষ্ঠ শর্ত বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব তাহা খর্ব হয় এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে রাজার ন্যায় রাষ্ট্রপতি সার্বভৌম হন। ইহা সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেয়াদে খসড়া অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করে, কিন্তু উপদেষ্টাগণ কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নহেন। কাজেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের অধ্যাদেশগুলির খসড়া অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অনুমোদিত, যা জনগণের কর্তৃত্ব তথা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সহিত সাংঘর্ষিক। সর্বসময়ে ইহা হƒদয়ে খোদিত থাকিতে হইবে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি চিরন্তন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এমনকি তাত্ত্বিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সহিত সরাসরি সাংঘর্ষিক।’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৩তম সংশোধনী মূল সংবিধানের ভিত্তি দুই প্রধান মূল চরিত্র প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে গোষ্ঠীতন্ত্র আনয়ন করিয়াছে, যাহার প্রধান রাষ্ট্রপতি নিজে। এইরূপ গোষ্ঠীতন্ত্রের সহিত মূল সংবিধানের স্বতঃসিদ্ধ নীতিগুলি একেবারেই অসংগতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানের ‘চড়ষব-ংঃধৎ ৭ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এছাড়া রাষ্ট্রপতি যদি ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদের (৬) দফা অনুযায়ী স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাহা হইলে বাংলাদেশ একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হইবে। ইহাও মূল সংবিধানের স্বতঃসিদ্ধ আদর্শিক নীতিগুলির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।’
বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘প্রথমতঃ একজন বিচারকের মানসিক শক্তিই হইতেছে বিচার বিভাগের প্রধান শক্তি। প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের বিষয়টি না থাকিলে একজন প্রধান বিচারপতি মানসিক চাপ হইতে মুক্ত থাকিয়া সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকিতে পারিবেন। দ্বিতীয়তঃ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলের সমর্থক আইনজীবীগণের রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট চাপ হইতে প্রধান বিচারপতি মুক্ত থাকিতে পারিবেন। এই দুইটি বিষয়ই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বার্থে অবশ্যই প্রধান বিচারপতি ও আপীল বিভাগের বিচারকগণকে দেশের রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার দায়ভার হইতে রক্ষা করিতে হইবে। বিচারকগণের সাংবিধানিক দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের প্রতি ও সকল বিচার প্রার্থীগণের প্রতি। রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণে বিচারকগণের কোনই সাংবিধানিক বা নৈতিক দায়িত্ব নাই। উলেখ্য যে, তর্কিত সংশোধনীটি রাজনীতিবিদগণের ব্যর্থতার কারণেই আনয়ন করিতে হইয়াছে। রাজনীতিবিদগণের নিজেদের দায় ও দায়িত্ব তাহাদের নিজেদেরকেই বহন করিতে হইবে। বিচার বিভাগ তাহা বহন করিবে না। অন্যথায় বিচার বিভাগ নিজেই আস্থা সংকটে পড়িবে।’
রায়ের অভিমতে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল পূর্বে, যথা, ৪২ (বেয়াল্লিশ) দিন পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এছাড়া সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ হতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে যাঁরা এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো। তবে, জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণকে বাদ দেয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করিতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাহাদিগকে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। বরঞ্চ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল কাঠামো এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হইয়াছে। ওপরে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বহাল থাকিবে। তবে শুধু আইনদ্বারা কোন ব্যবস্থাই সকল সময়ের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিñিদ্র করা সম্ভব নয়। জনগণের সদাসর্বদা সচেতনতাই প্রয়োজন।
রায়ে ১৬টি সারমর্ম দেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, এতে বলা হয়েছে, ‘(১) জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম; (২) বাংলাদেশের সরকার মানুষের সরকার নহে, আইনের সরকার (এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ষধংি ধহফ হড়ঃ মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ সবহ); (৩) সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, ইহা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে; (৪) জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব; (৫) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ধরনের ছেদ (রহঃবৎৎঁঢ়ঃরড়হ) বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না; (৬) সুপ্রীমকোর্ট ইহার ঔঁফরপরধষ জারির এর ক্ষমতাবলে যে কোন অসাংবিধানিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করিতে পারে বা বাতিল (ঝঃৎরশব ড়ভভ) করিতে পারে; (৭) কোন মোকদ্দমার শুনানিকালে কোন আইনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে সুপ্রীমকোর্ট সে সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না, আইনের প্রশ্নটি নিরসন করাই সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব; (৮) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে জাতীয় সংসদ সংবিধানের যে কোন সংশোধন করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব ক্ষুণœœ বা খর্ব বা সংশোধন করিতে পারে না; (৯) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন (ধসবহফসবহঃ) করিয়াছে; (১০) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব-কে খর্ব করিয়াছে বিধায় উক্ত তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ, সুতরাং বাতিল হইবে; (১১) বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ও কারণাধীনে কোন আইন ভাবীসাপেক্ষভাবে (চৎড়ংঢ়বপঃরাবষু) অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাইতে পারে; (১২) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল (ৎবধংড়হধনষব ঢ়বৎরড়ফ) পূর্বে, যথা, ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন; (১৩) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমত নূতনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে; (১৪) সাধারণ নির্বাচনের তফসীল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে; (১৫) বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬ (২) অনুচ্ছেদের শর্ত (চৎড়ারংড়) এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের স্বার্থে আনায়ন করা প্রয়োজন; (১৬) ২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বৎসর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (পড়হফড়হব) করা হইল।’ (অসমাপ্ত)
No comments