চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে পুলিশী ব্যবস্থা
চীনে কমিউনিস্ট আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নেই। সেই ব্যবস্থা থেকে চীনারা অনেক আগেই দূরে সরে এসেছে। তবে যেটা আছে তাহলো কমিউনিস্ট পার্টির শাসন। দেশ পরিচালনার বেলায় তারা কমিউনিস্ট পার্টির মনোলিথিক শাসন ব্যবস্থা অটুট রেখেছে। পার্টির শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমনের কার্যক্রম আগের মতোই বলবৎ আছে।
দেশের প্রচলিত বিচার-পদ্ধতির বাইরেও পার্টির নিয়মশৃঙ্খলার কার্যকারিতা অনেক বেশি।
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা দারুণ রকমের অসদাচরণ করলে চীনের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি করা হয় না। এর জন্য রয়েছে এক প্যারালাল ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে পার্টির নিজস্ব ব্রান্ডের সুবিচার প্রদান করা হয়। সেই ব্যবস্থায় পার্টির শৃঙ্খলা বলবতকারীরা এ জাতীয় কর্মকর্তাকে ঝট করে চোখের পলকে তুলে নিয়ে গিয়ে এমন সব ক্ষেত্রে রেখে দেয় যেখানে তাদের সঙ্গে বাইরের কারোর যোগাযোগ করার উপায় থাকে না। এসব কেন্দ্রে তাদের মাসের পর মাস আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। ইত্যবসরে পার্টি বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেবে, নাকি নিজেরাই শাস্তি দেবে। আবার বিরল ক্ষেত্রে তাদের ছেড়েও দেয়া হতে পারে। তবে সেটাও ঠিক করবে পার্টি। এভাবে আটক রাখার ব্যবস্থাকে চীনের বহু আইনজীবী অনিয়মতান্ত্রিক আখ্যা দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তা গ্রাহ্য করে না। পার্টি এ ব্যবস্থাকে নিজ ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে।
উপরে যে প্যারালাল বা সমান্তরাল ব্যবস্থার কথা বলা হলো তার একটা নাম আছে। চীনা ভাষায় বলে শুয়াংগুই। ইংরেজিতে ‘ডবল ডেজিগনেশন’। নামেই বলে দেয় যে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে হাজির হতে হবে। বাস্তবে তারা নিজ থেকে হাজির হয় না। তাদের আটক করে ধরে আনা হয়। শুয়াংগুইয়ের সঙ্গে যুক্ত বেশিরভাগ সাধারণ চীনা নাগরিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকে বলে তাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয় এই হলো চীনা কর্মকর্তাদের যুক্তি। কিন্তু কখনও কখনও তা রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভিন্ন পথে বিচরণকারী ক্যাডারদের বিরুদ্ধেও অনুসরণ করা হয়। ইদানীং চীনা পার্টির তরফ থেকে শুয়াংগুইয়ের প্রয়োগ সংক্রান্ত বিধিনিয়ম কড়াকড়ি করা হলেও এর ঢালাও অপব্যবহারও করা হচ্ছে।
চংকিংয়ের সাবেক পার্টি প্রধান বো জিলাই এ ব্যবস্থাটি সম্পর্কে ভাল মতোই জানতেন। গত মার্চ মাসে পদচ্যুত হবার আগে তিনি নিজ এলাকায় পার্টির কর্মকর্তা ও অপরাধীদের মধ্যে যোগসাজশ বন্ধের অভিযানে প্রায়শই এই ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, আজ তিনি নিজেই এমন ব্যবস্থার শিকার। মার্চ থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এ বছরের শেষদিকে চীনা পার্টির কংগ্রেস হবার আগে তাঁর ব্যাপারে পার্টির রায় ঘোষিত হবে বলে অনুমান করছেন পর্যবেক্ষকরা।
শুয়াংগুইয়ের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের প্রথমভাগ থেকে। তার আগে পার্টি লাইন লঙ্ঘনকারীদের প্রায়শই গোপনে আটকে রাখা হতো। কেবল সাম্প্রতিককালেই কর্মকর্তারা এ ব্যবস্থা সম্পর্কে খোলাখুলি কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া এক উর্ধতন পার্টি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় যে, শুয়াংগুইয়ের অধীনে আটক ব্যক্তিদের দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটাই ছিল এই ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন পার্টি-কর্মকর্তার প্রথম প্রকাশ্য ব্যাখ্যা। গত বছরের এপ্রিলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা শুয়াংগুই স্থাপনার ছবি দেখার বিরল সুযোগ পায়। পরে অন্যরা ব্লগের মাধ্যমে পোস্ট করে দেয়। ছবিতে এমন সব কক্ষ দেখানো হয় যেখানে ছিল দেয়ালের গায়ে ছোপ ছোপ দাগ। এসব কক্ষে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পিটিয়ে মেরে ফেলার খবরও বেরিয়ে আসে।
এ জাতীয় অত্যাচার, নিগ্রহের ঘন ঘন ঘটনার কথা জানতে পেরে পার্টি ২০০৫ সালে শুয়াংগুইয়ের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬ মাস বেঁধে দেয় এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বন্দীদের যোগাযোগের সুযোগের কিছু অন্তত সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। তবে বন্দীদের মারধর বা গালিগালাজ নিষিদ্ধ করে ১৯৯৮ সালে নিয়ম জারি করা হলেও সেটা কতখানি মানা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। এসব স্থাপনায় আত্মহত্যা রোধের ব্যবস্থা করা হলেও শুধু ২০০৯ সালের প্রথম ৮ মাসে সাতজন বন্দীর আত্মহত্যার খবর সরকারীভাবে জানানো হয় যদিও এ হিসাবটা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল। মোট কতজন লোককে শুয়াংগুই ব্যবস্থায় এ পর্যন্ত আটক রাখা হয়েছে সে ব্যাপারে পার্টি অতিমাত্রায় গোপনীয়তা বজায় রেখে থাকে। তবে ধারণা করা হয়, প্রতিবছর যে দেড় লাখের মতো লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা পার্টি লাইনবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগ আনা হয়, তাদের অধিকাংশকেই শুয়াংগুই ব্যবস্থায় আটক রাখা হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজাররাও আছেন। এদের মধ্যে অতি সামান্য সংখ্যক লোককে সত্যিকার অর্থে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এক হিসাবে জানা গেছে যে, এই শ্রেণীর ১০ শতাংশেরও কম লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়ে থাকে। এরা কি ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তার কোন সুনির্দিষ্ট হিসাব সরকারী পরিসংখ্যানে মিলবে না। তবে সে দেশের এক সুপরিচিত ভাষ্যকারের মতে, এদের ৯৫ শতাংশই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে শুয়াংগুই তদন্ত পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত পার্টির শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দলীয় ক্যাডারদের সঠিক রাজনৈতিক লাইনে রাখা। সেই লাইন থেকে বিচ্যুত হলেই তাদের স্থান হতে পারে শুয়াংগুইয়ের বন্দীশালায়। ম
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
No comments