হলমার্ক কেলেঙ্কারি ॥ মামলায় যাচ্ছে না সোনালী ব্যাংক, প্রস্তুতি দুদকের আসামি করা হতে পারে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে by শাহ আলম খান ও মহিউদ্দিন আহমেদ

বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করছে না সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর পরিবর্তে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে শীঘ্রই মামলা করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে সরকারে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকটা মৌখিক সমঝোতা হয়েছে।


আর এ কারণেই মামলা করা না করা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। খবর সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সূত্রের। ইতোমধ্যে দুদক বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় সন্দেহভাজনদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রকৃত দোষীদের অনেকটাই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে দুদকের তালিকায় এমন সন্দেহভাজনের সংখ্যা অন্তত অর্ধ-শতাধিক। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী দায়িত্বে অবহেলা কিংবা জালিয়াতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততার দায়ে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা হতে পারে। অথচ সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করার বিষয়ে উচ্চ মহলের নির্দেশ পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে মাত্র ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলায় না গিয়ে কালক্ষেপণ করতে শুরু করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলা দায়েরে কালক্ষেপণের কারণ জানা গেছে। জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের মামলার খসড়ায় ৫ জনের নাম রাখায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুদকেরও এ ব্যাপারে চরম আপত্তি রয়েছে।
অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের ৩১ কর্মকর্তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগসূত্রতা থাকার কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আবার দুদকের তদন্তে যেখানে এ ঘটনায় অন্তরালে মদদ যুগিয়েছে কিংবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে প্রায় অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তির নাম এসেছে, সেখানে মাত্র ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মতপ্রকাশ করে মাত্র ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে অন্যরা পার পেয়ে যেতে পারে। অথবা মামলার গতি দীর্ঘসূত্রতায় চলে যেতে পারে। তাই মামলার শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা ও প্রকৃত দোষীদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গেও আলোচনা কিংবা সমঝোতায় যাওয়ার পরামর্শ দেয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সীমিত আকারে মাত্র ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের চেষ্টার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন উর্ধতন সূত্র বলেছে, বিষয়টি যেহেতু অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও জনমুখী। তাই এ ঘটনায় নিছক মামলা দায়েরের মাধ্যমে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই। আবার প্রকৃত দোষীদেরও মামলার বাইরে রাখার কোন অবকাশ নেই। এটি করা হলে প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তির আওতার বাইরে থেকে যাবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণœ হতে পারে, তেমনি ব্যাংকিং খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থাও নষ্ট হতে পারে।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত উল্লেখ করে অন্তত অর্ধ-শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হতে পারে। ইতোমধ্যে দুদক বিভিন্ন সময় দফায় দফায় ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আরও ১০ থেকে ১৫ জন জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় রয়েছে। খুব শীঘ্রই এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মোদাচ্ছের আলী এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এরপরই হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে গঠিত দুদকের অনুসন্ধানী টিমের পুরো জালিয়াতির বিষয়টিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হবে। এর পর দুদক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করবে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কেউ আইনের উর্ধে নয়, এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন। তারা প্রয়োজন মনে করলে যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।
ওদিকে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলার কালক্ষেপণ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, মামলা দায়েরের জন্য তাদের এখনও যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। তবে তাঁরা সময়ক্ষেপণও করছেন না। আবার কবে নাগাদ মামলা হবে সেটিও সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান, মামলার জন্য তাদের প্যানেল আইনজীবীর বাইরেও দু’জন বিশিষ্ট আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের কাগজপত্র ও আইনের ফাঁক-ফোকর পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আইনের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করেই মামলা দেয়া হবে। এজন্য আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুততার সঙ্গে ফৌজদারি মামলা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে তিনিও জোরালো যুক্তি দাঁড় করিয়ে জানিয়েছিলেন, অভিযুক্তদের কেউ যাতে আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারেন ও মামলা দায়েরে যাতে কোন দুর্বলতা প্রকাশ না পায় সে জন্যই সময় নেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন হোটেল) শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাত করা হয়েছে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাত করেছে ২ হাজার ৬৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এছাড়া এই ব্যাংকের গুলশান ও আগারগাঁও শাখা থেকেও ১৪০ কোটি টাকা করে ঋণ দেয়া হয়েছে, যা তাদের ঋণ সীমার অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিতে এই ধরনের দুর্নীতি পরিচালনাপর্ষদের নজরে আসেনি এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এজন্য বিবি কর্তৃপক্ষ পরিচালনাপর্ষদ পুনর্গঠন করার জন্য সুপারিশ করেছে।
এর আগে গত ২৬ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত সোনালী ব্যাংকের ২৯ কর্মকর্তাকে ৩১ আগস্টের মধ্যে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংক পরিচালনাপর্ষদ ভেঙ্গে দিতে সুপারিশ জানিয়েও চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ ঘটনায় ওই ২৯ কর্মকর্তাসহ ৩১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরিচালনাপর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার পরিবর্তে পর্ষদের চেয়ারম্যানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। পরে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অপরদিকে হাতিয়ে নেয়া অর্থের অর্ধেক আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নগদ পরিশোধের জন্য হলমার্ক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় সোনালী ব্যাংকপর্ষদ। এছাড়া লুণ্ঠিত অর্র্থের বাকি অর্ধেক আদায়ের জন্য হলমার্কের সম্পদ জামানতের আওতায় বন্ধক রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বাইরে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এলসিকৃত হলমার্কের সমুদয় রফতানি আয় ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.