হলমার্ক কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতে অশনিসংকেত by শাহজাহান মিয়া

বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে। বিভিন্ন সরকারের আমলে আমাদের এই গরিব দেশে এ প্রবণতাটি যেন একটু বেশিই লক্ষ করা যায়। কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।


গত বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এ বছর কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টির সুরাহা না হতেই হঠাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতে এক নজিরবিহীন দুর্নীতির কথা জানা গেল। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা জালিয়াতির খবর প্রকাশ পেল। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের এ পর্যন্ত অর্জিত উজ্জ্বল আভা মলিন হয়ে একবারে বিবর্ণ হয়ে গেল। ব্যাংকিং খাতে এত বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। সংবাদপত্রের পাতায় ও টেলিভিশনের টক শোতে সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত কিছু মন্তব্য দেশব্যাপী সৃষ্ট সমালোচনাকে আরো তীব্র করে তোলে। চারদিকে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। এমনকি দেশের আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মতো প্রবীণ সদস্যরাও কঠোর ভাষায় এ জালিয়াতির সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় 'চার হাজার কোটি' টাকার বিপুল অঙ্কের ঋণকে 'বেশি নয়' বলে মন্তব্য করায় অর্থমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেন তাঁরা। তাঁরা অর্থমন্ত্রীকে কম কথা বলারও পরামর্শ দিয়েছেন। ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রিমান্ডে নিয়ে তথ্য বের করা ও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা। শেখ সেলিম বলেন, 'তাঁর (অর্থমন্ত্রী) কাছে হয়তো চার হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু নাও হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে তা অনেক কিছু।' বেফাঁস কথাবার্তা বলা থেকে তাঁর বিরত থাকা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'রাজনৈতিক কারণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিলে এর ফল সব সময় ভালো হয় না। ব্যাংক পরিচালনায় যাঁদের সামান্য অভিজ্ঞতা নেই, তাঁদের পরিচালনা পর্ষদে রাখলে এমন ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক।' তিনি আরো বলেন, একজন উপদেষ্টাসহ আরো যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর মিডিয়াকে দায়ী করার সমালোচনা করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় সেসব বিষয়ে লেখালেখি হবেই। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে এ রকম ঘটনার জবাবদিহি তাঁদেরই করতে হয়। সরকারের ব্যর্থতায় আমাদেরও দায়িত্ব বর্তায়। তাই বসে থাকলে চলবে না। পরদিন ৫ সেপ্টেম্বরও কয়েকজন সদস্য সংসদে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেন।
সবারই বিশ্বাস, অর্থমন্ত্রী একজন সৎ ব্যক্তি। তাঁর রয়েছে ঈর্ষণীয় এডুকেশনাল ক্যারিয়ার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বহীন উক্তি ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে দেশের ভেতরে ও বাইরে অশনিসংকেত পাঠাবে। তাঁরা মনে করেন, লোপাট হওয়া অর্থ আদায় ও দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি বিধানের কথা না বলে বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। সন্দেহ নেই, আমাদের অর্থমন্ত্রী একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর মুখে অনেক সময় অনেক বিষয়ে রাগতস্বরে বেফাঁস মন্তব্য উচ্চারণ তাঁর সম্পর্কে মানুষকে বিরূপ ধারণাই দিয়ে থাকে। তিনি হয়তো সহজ-সরল। কিন্তু তাঁর মধ্যে আত্মম্ভরিতার ভাবটি স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে।
সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠনের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের লেখা চিঠি নিয়েও তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারি ব্যাংকের পর্ষদের ব্যাপারে এ ধরনের সুপারিশ করার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। অথচ ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংক সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ যে আমলে নেওয়া হয়নি, তা গত ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদকাল দুই বছর বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারির পরই পরিষ্কার হয়ে গেছে। সোনালী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ধারণা নেই_এমন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগের বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৩৩ কর্মকর্তার যোগসাজশে হলমার্কসহ কয়েকটি গ্রুপ ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের গুলশান ও আগারগাঁও শাখা থেকেও প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জালিয়াতি হয়েছে বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে। বিষয়টি গত ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতু ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দুই সহকর্মীর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে অর্থমন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলেছিলেন, 'আমার সহকর্মীরাই যখন আমার সমালোচনা করছেন, তখন আমার এই পদে থাকার যোগ্যতা নেই। আই শুড রিজাইন।' পরে প্রধানমন্ত্রী নিজে সবাইকে শান্ত করেন।
এবার হলমার্ক কম্পানির কর্ণধার তানভীর মাহমুদের আমলনামার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। মাত্র ১০ বছর আগে তিনি ছিলেন কপর্দকহীন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁকে খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটাতে হতো। এমন অবস্থায় আগারগাঁও তালতলা বাজারে বাবাকে নিয়ে ছোট্ট একটা মুদি দোকান খোলেন তিনি। এর পরও অভাবের তাড়নায় পরিবারের সদস্যদের ঠিকমতো খাবার জোটাতে ব্যর্থ হয়ে মাত্র তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে তিনি একটি গার্মেন্টে চাকরি নেন। বহুল আলোচিত-সমালোচিত সেই মুদি দোকানি পরে তিন হাজার টাকা বেতনের গার্মেন্ট শ্রমিক তানভীর মাহমুদই আজ তিন হাজার কোটি টাকার মালিক! কপর্দকশূন্য ব্যক্তির কী অভাবনীয় রাজকপাল। কী জাদুবলে তাঁর ভাগ্য খুলে গেল। আরব্য রজনীর রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? ভাবতে অবশ্যই অবাক লাগে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশে এটা কী করে সম্ভব হলো! মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় আলিশান বাড়ির বিশাল গ্যারেজে নাকি আছে তাঁর ২৭টি পাজেরো ও প্রাডোর মতো গাড়ি। সাভারের হেমায়েতপুরে যান ঘন ঘন। সব সময় চলাফেরা করেন অস্ত্রধারী বিশাল ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। নানা দিক থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অর্থ জালিয়াতির কথা উঠলেও তিনি সদর্পে সবাইকে হতবাক করে বলেছিলেন, 'আমার এর চেয়ে বিশ গুণ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আছে।' হলমার্ক কম্পানির কর্ণধার তানভীরের নিশ্চয়ই কোনো বিরল জাদু 'বল' আছে। সেই 'বল' কোথায় এবং এই 'বল' জোগানদাতাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে। তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা হোক বা প্রভাবশালী সরকারি দলের লোকও যদি হয়, তাদের শুধু চোর নয়, ডাকাত বলার সাহস দেখাতে হবে। অবশ্যই ঢালাওভাবে নয়। প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করেই বলতে হবে। প্রভাবশালী কেউ জড়িত না থাকলে এ রকম বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ পাওয়া তানভীর মাহমুদের পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব ছিল না। ওই মদদদানকারীরাই আসল কালপ্রিট। তাই কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে সেই চোর-ডাকাত-হার্মাদদের ধরতে হবে, যাতে পালাতে না পারে। দ্রুত বিচার করে দোষীদের জেলে পুরতে হবে।
জানি না, আমার নিবন্ধটি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হবে কি না। তবুও বলতে চাই। বর্তমান সরকারের মেয়াদ আর আছে মাস পনেরো। সময় একেবারে কমও নয়। এ সময়েই অনেক কিছু করা যায় এবং করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত নজিরবিহীন এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে আস্থা ফেরানোর কোনো বিকল্প নেই। আরো একটি কথা বলতেই হচ্ছে যে অর্থ আত্মসাৎকারী বা তাদের সহায়তা প্রদানকারীরা চোর-ডাকাতের চেয়েও ভয়ংকর। তাই তারা যাতে কোনোমতেই পার না পেয়ে যায়, সে বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। ওদিকে শেয়ারবাজারে এখনো পর্যন্ত প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। স্বাভাবিক নিয়মে শেয়ারবাজারে দর ওঠানামা করা আপত্তিকর কিছু নয়। কিন্তু এ খাতে বিপত্তি ঘটে তখন, যখন বিপর্যয় ঘটানোর জন্য কোনো কোনো মহল তৎপর হয়ে ওঠে। তাই ৩২ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যেও বিরাজ করছে একধরনের অস্থিরতা। এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লোটার চেষ্টা করবেই। সে জন্য সব দিকেই সজাগ ও তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.