স্মরণ-এপিটাফ : কড়ইতলা by মাহমুদ হাসান আরিফ
তাকে সাদা কাপড়ে সাজিয়ে ততক্ষণে গ্রামের বাড়ি কড়ইতলা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মা-বাবা আর স্বজনদের কাছে। তাকে এ অবস্থায় পেয়ে স্বজনদের অভিব্যক্তি কেমন ছিল, জানতে পারিনি। সে জন্য হয়তো দায়ী আমাদের আটপৌরে নগরজীবন।
প্রতিদিন কত মানুষ চলে যাচ্ছে দুনিয়া ছেড়ে! কিন্তু দুনিয়া কি তাদের না থাকার অজুহাতে থমকে যাচ্ছে মুহূর্তের জন্যও? হয়তো কাছের কিছু মানুষ বিহ্বল হয়ে পড়ে কিছু সময়ের জন্য। তারপর ওই 'না থাকা' ব্যক্তির জন্য আমাদের আর কিছু যায়-আসে না। তেমনি আপনের 'না থাকায়' সেদিন কাজের চাপ কিছুটা বেড়ে যাবে, এ কারণে আমাদের বিভাগের কেউ হয়তো তার সঙ্গে যেতে পারিনি।
তাকে বিদায় দিয়ে শোকে বিহ্বল কান্ট্রি ডেস্কের আমাদের সবাইকে নিয়ে বসেছেন বিভাগীয় সম্পাদক খায়রুল বাশার শামীম। তিনি শুরু করলেন এই বলে যে 'আপন মাহমুদ অন্তত দুটি দিক দিয়ে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রথমত, তাঁর সততা আর ভালো মানুষি; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। শামীম ভাই আরো অনেক কথাই বলেছেন। আমরাও বলেছি কিছু।
আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, মানুষ মারা গেলে বলার চেষ্টা করি, 'সে বড় ভালো লোক ছিল।' আপন কখনো চুপিচুপি-কানাকানি ভঙ্গিতে কথা বলেনি। যা বলার, প্রকাশ্যেই বলত। কারো আড়ালে সমালোচনা করেনি। কাউকে কষ্ট দিয়ে, কটাক্ষ করে কথা বলেনি। কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি, ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বা মন্তব্য করত না কখনো। সে ছিল নির্লোভ, নিরহংকারী, বন্ধুবৎসল...। আজ সে গত হয়েছে বলে নয়, তার বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনের লম্বা তালিকার কেউই মনে হয় এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করবে না।
আপনের বয়সে কি কেউ মারা যায়! হ্যাঁ, মারা যায়। কারণ মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করার ক্ষমতা তো একজনেরই। তাই আপনকে চলে যেতে হলো। কিন্তু ক্ষণজন্মা আপন স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে চিনিয়ে গেছে। আপনের সঙ্গে আমার কয়েকজন বন্ধুর পরিচয় ছিল। আমার আরো কয়েকজন কলিগের সঙ্গেও তাদের পরিচয় আছে। কিন্তু আমার বন্ধুরা প্রায়ই বিশেষ করে আপনের খোঁজখবর নিত। আসলে আপন কথার ভেতর দিয়ে যেকোনো বিষয়ের প্রতি একধরনের ঘোর সৃষ্টি করতে পারত। আজ মনে হচ্ছে, সেই ঘোরটা আসলে সৃষ্টি হতো প্রকারান্তরে তার প্রতিই। কথা বলার ধরন, দৃঢ়তা, স্পষ্টবাদিতা, যুক্তিনির্ভরতা আর কৌশলে ছিল স্বাতন্ত্র্য।
'আমি কবি ও সাংবাদিক, নাকি সাংবাদিক ও কবি?' এর উত্তর খুঁজে ফিরত সে। কবিতার আগে সাংবাদিকতাকে স্থান দিলে কবিকে খাটো করা হয়। আবার উল্টোভাবে ভাবলে সাংবাদিকতাকে। কিন্তু সে দুই জায়গাকে সমান গুরুত্ব দিয়েই কাজ করে গেছে।
অবশ্য কবি হতেই তার ঢাকায় আসা। ঢাকায় আসার পর তার বর্ণনাতীত স্ট্রাগল সে সাক্ষ্যই দেয়। চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে তিন হাজার টাকা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এক হাজার টাকায় ঢাকায় থাকা! (একটি দৈনিকে প্রথম চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে আপন।) এ-ও কি সম্ভব? এই কঠিন অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেয়েছিল আপন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'অনেক লেখক আপনার স্টাইলকে ঝম্ঝম্ করিয়া বাজাইতে থাকে, লোককে জানাইতে চায়, তাহার কাছে সোনা আছে বটে।' এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল আপন। আজকের সমাজে লোভ-মোহমুক্ত, বিশেষ করে কবি হিসেবে নিজের এতটা প্রচারবিমুখতা সত্যিই বিরল। প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক তাদের বিবেচনায় সেরা ১০ তরুণ কবি-সাহিত্যিককে তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফরম দাঁড় করিয়েছে। যেখানে নিজের নাম দেখতে অনেকেই লালায়িত। কিন্তু এ চেষ্টা আপন কখনো করেছে, কেউ বলতে পারবে না। আপনের কাব্য-প্রতিভার কথা জানতে পেরে তারা নিজেরাই আপনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের বিবেচনায় সেরা দশে আপন স্থান পেয়েছিল।
মাহমুদ হাসান আরিফ, arif24jan@gmail.com
তাকে বিদায় দিয়ে শোকে বিহ্বল কান্ট্রি ডেস্কের আমাদের সবাইকে নিয়ে বসেছেন বিভাগীয় সম্পাদক খায়রুল বাশার শামীম। তিনি শুরু করলেন এই বলে যে 'আপন মাহমুদ অন্তত দুটি দিক দিয়ে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রথমত, তাঁর সততা আর ভালো মানুষি; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। শামীম ভাই আরো অনেক কথাই বলেছেন। আমরাও বলেছি কিছু।
আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, মানুষ মারা গেলে বলার চেষ্টা করি, 'সে বড় ভালো লোক ছিল।' আপন কখনো চুপিচুপি-কানাকানি ভঙ্গিতে কথা বলেনি। যা বলার, প্রকাশ্যেই বলত। কারো আড়ালে সমালোচনা করেনি। কাউকে কষ্ট দিয়ে, কটাক্ষ করে কথা বলেনি। কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি, ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বা মন্তব্য করত না কখনো। সে ছিল নির্লোভ, নিরহংকারী, বন্ধুবৎসল...। আজ সে গত হয়েছে বলে নয়, তার বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনের লম্বা তালিকার কেউই মনে হয় এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করবে না।
আপনের বয়সে কি কেউ মারা যায়! হ্যাঁ, মারা যায়। কারণ মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করার ক্ষমতা তো একজনেরই। তাই আপনকে চলে যেতে হলো। কিন্তু ক্ষণজন্মা আপন স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে চিনিয়ে গেছে। আপনের সঙ্গে আমার কয়েকজন বন্ধুর পরিচয় ছিল। আমার আরো কয়েকজন কলিগের সঙ্গেও তাদের পরিচয় আছে। কিন্তু আমার বন্ধুরা প্রায়ই বিশেষ করে আপনের খোঁজখবর নিত। আসলে আপন কথার ভেতর দিয়ে যেকোনো বিষয়ের প্রতি একধরনের ঘোর সৃষ্টি করতে পারত। আজ মনে হচ্ছে, সেই ঘোরটা আসলে সৃষ্টি হতো প্রকারান্তরে তার প্রতিই। কথা বলার ধরন, দৃঢ়তা, স্পষ্টবাদিতা, যুক্তিনির্ভরতা আর কৌশলে ছিল স্বাতন্ত্র্য।
'আমি কবি ও সাংবাদিক, নাকি সাংবাদিক ও কবি?' এর উত্তর খুঁজে ফিরত সে। কবিতার আগে সাংবাদিকতাকে স্থান দিলে কবিকে খাটো করা হয়। আবার উল্টোভাবে ভাবলে সাংবাদিকতাকে। কিন্তু সে দুই জায়গাকে সমান গুরুত্ব দিয়েই কাজ করে গেছে।
অবশ্য কবি হতেই তার ঢাকায় আসা। ঢাকায় আসার পর তার বর্ণনাতীত স্ট্রাগল সে সাক্ষ্যই দেয়। চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে তিন হাজার টাকা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এক হাজার টাকায় ঢাকায় থাকা! (একটি দৈনিকে প্রথম চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে আপন।) এ-ও কি সম্ভব? এই কঠিন অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেয়েছিল আপন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'অনেক লেখক আপনার স্টাইলকে ঝম্ঝম্ করিয়া বাজাইতে থাকে, লোককে জানাইতে চায়, তাহার কাছে সোনা আছে বটে।' এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল আপন। আজকের সমাজে লোভ-মোহমুক্ত, বিশেষ করে কবি হিসেবে নিজের এতটা প্রচারবিমুখতা সত্যিই বিরল। প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক তাদের বিবেচনায় সেরা ১০ তরুণ কবি-সাহিত্যিককে তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফরম দাঁড় করিয়েছে। যেখানে নিজের নাম দেখতে অনেকেই লালায়িত। কিন্তু এ চেষ্টা আপন কখনো করেছে, কেউ বলতে পারবে না। আপনের কাব্য-প্রতিভার কথা জানতে পেরে তারা নিজেরাই আপনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের বিবেচনায় সেরা দশে আপন স্থান পেয়েছিল।
মাহমুদ হাসান আরিফ, arif24jan@gmail.com
No comments