দলীয়, জোট-মহাজোটের রাজনীতির মূল্যায়ন by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের মতোই বাংলাদেশের রাজনীতি নানা সমস্যা, সম্ভাবনা, উত্থান-পতন ও স্বপ্ন দেখা, না দেখার মধ্য দিয়ে চলছে। রাজনীতিতে এটিই স্বাভাবিক বিষয়। গত একচল্লিশ বছরে আমাদের রাজনীতি নানা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে চলেছে।


এতে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা হচ্ছে দলীয় রাজনীতি কখনও কখনও আদর্শিক এবং অস্তিত্বের অবস্থানে চরম প্রতিকূলতায় পড়েছে। কখনও আন্দোলন সংগ্রামের মাঠে জোট গঠন করেছে, কখনও জোটের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ ধরনের নানান আশা-নিরাশার অভিজ্ঞতা আমাদের ঘটেছে। সব অভিজ্ঞতাই রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা ও প্রবণতা। কিন্তু রাজনৈতিক দল এবং জনগণ বিষয়গুলো কতখানি বিচার বিশ্লেষণে নেন, শিক্ষা গ্রহণ করেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর বলে মনে হয় না। আমরা ফিরে দেখা, মূল্যায়ন করা, শিক্ষা নেয়া, রাজনীতির সঠিক পথ রচনা ও করণীয় নির্ধারণকে খুব একটা আমলে নিচ্ছি না বলেই হতাশার জন্ম বেশি বেশি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ত্রিদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের দিকে। তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রধান দুটো বিরোধী দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ মুজাফফর এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে ওই জোট গঠন করেছিল। এর বিরুদ্ধে জাসদ, অতি বাম কিছু দল বেশ মুখরোচক, সমালোচক ছিল। ত্রিদলীয় জোট যতটা কাছাকাছি আদর্শিকভাবে ছিল ততটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কিন্তু নেয়নি। ফলে বিরোধীদের সমালোচনাই রাজনীতির মাঠে জায়গা দখল করে নিতে পেরেছিল। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নিরীক্ষার উদ্দেশ্য থেকে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল গঠন করে নতুনভাবে জোট রাজনীতি ও দেশ শাসনের যাত্রা করতে চেয়েছিলেন। নতুনভাবে রাজনৈতিক শক্তির গঠনে শুধু তিন দলই নয়, এর বাইরের কিছু কিছু দল, গোষ্ঠী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংস্থাও এতে যুক্ত হতে থাকে। এর রূপান্তরটি শেষ পর্যন্ত কেমন হতো, দেশ শাসন ও পুনর্গঠনে এটি কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা বা অবদান রাখতে পারত তা দেখা বা পাওয়ার আগেই ১৫ আগস্ট ৩ নবেম্বরের জেলহত্যা, ৭ নবেম্বর প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে বাংলাদেশের নতুনভাবে পথ চলার সকল সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দেয়া হলো। এরপর কঠোর সামরিক শাসন এবং সব কিছুকে ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দেয়ার পর্ব শুরু হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে নতুনভাবে জোট ও দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাতে যুক্ত হয় এতদিনের বিরোধী সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী, নেপথ্যের শক্তি, অতি বিপ্লবী, ডান, অতি বাম শক্তি যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়, মহান মুক্তিযুদ্ধকে ১৯৭১-এর বাঙালী জাতীয়তাবাদের সশস্ত্র যুদ্ধের বাস্তবতা থেকে দেখেনি, গ্রহণ করেনি, কেউবা সরাসরি বিরোধিতা করেনি।
কেউবা নিজেদের তত্ত্বে অংশগ্রহণ করেও রাষ্ট্র দর্শনে যুদ্ধপরবর্তী সরকার ও শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে সম্মুখে নিয়ে এসব নানা মত, পথ ও উদ্দেশ্যসাধকদের জমায়েত ঘটে, রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রত্যক্ষ মদদে গঠিত হয় নতুন জোট ও দলÑযা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে পরিচিতি পায়। সেই সময় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি দলীয়ভাবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলেও রাজনীতিতে এদের পথ ছিল চরমভাবে প্রতিকূল অবস্থায়, ১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জোটগত প্রার্থী দেয়া হলেও জোটের অবস্থান সংহত হওয়ার পর্যায়ে রাখা হয়নি। জাসদ ছিল তখন তত্ত্ব বিতর্কে ভঙ্গুর, কোন কূলেই স্থির হতে পারছিল না। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকা- ১৯৭৮ পরবর্তী দক্ষিণ পন্থার শক্তিদেরও বেশ সঙ্কটে ফেলে দেয়, সুবিধাবাদীদের বড় অংশটি তখন বিএনপি ছেড়ে সামরিক শাসক এরশাদের লাঙ্গল টানতে গরু ও চাষীর আসনে চলে যায়। ১৯৮৩ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ছাত্র সংগঠনগুলোর বৃহত্তর ঐক্যের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। এর প্রভাব পড়ে বড় দলগুলোর মধ্যে। এখানে সকলেরই অলক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান দু’টো পরস্পরবিরোধী ধারা একটি আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল ও পথের সকল দলের সমন্বয়ে ১৫ দলীয় জোট, অন্যদিকে সকল ডানপন্থীর সমন্বয়ে ৭ দলীয় জোট গঠিত হয়। উভয় জোট এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করল। অথচ ৭ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপি পূর্ববর্তী সামরিক শাসন আমলেই গঠিত হয়েছিল, সেটির রাজনৈতিক আদর্শ ও চরিত্র এরশাদের সামরিক শাসন ও চরিত্র থেকে মৌলিকগতভাবে কতখানি আলাদা ছিল তা খুব কমই দেখা হয়েছে, বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বিশেষত আওয়ামী লীগ এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলো এ সব বিষয়ে সিরিয়াস কোন রাজনৈতিক ও একাডেমিক বিশ্লেষণে তখন যায়নি, এরশাদের সামরিক শাসনকে ‘স্বৈরশাসন’ হিসেবে দেখলেও জিয়ার আমলকে কেবলই সামরিক শাসন হিসেবে দেখেছে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও গতিপথ নির্ণয়হীনভাবে পরিচালিত হয়েছে। এর পরিণতি কী হতে পারে তা তখন স্পষ্ট করা হয়নি। তবে দুই জোটের আন্দোলন রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া, না যাওয়ার সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে বিভক্তও হয়েছে, ১৫ দল থেকে বামদের একটি অংশ বের হয়ে ৫ দলীয় জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। জাসদ তত দিনে খ- বিখ- হয়েছে, একপক্ষ এরশাদের পক্ষে, অন্যপক্ষ বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, কোন পক্ষে না যাওয়া, না থাকার অবস্থান কারও কারও ঘটেছে। ১৯৯০ সালে ৩ জোট আন্দোলনের দিক থেকে ব্যাপক সফলতা লাভ করেছিল, যখন এটি একটি ঐক্যবদ্ধ ঘোষণাপত্র দিতে সক্ষম হয়। এটি ছিল জনগণের দিক থেকে কাক্সিক্ষত, তবে তিন জোটের ভেতরের চরিত্রগত দিক থেকে একেবারেই ‘অবাস্তব’ ও অবাস্তবায়নযোগ্য ঘোষণা। ৭ দলীয় জোট আদর্শগতভাবে ঐ চার্টার মানবে এটা মনে করার কোন কারণ না থাকার পরও তারা স্বাক্ষর করেছে। এটি ছিল এরশাদ সরকারের পতনলাভের বাস্তবতায় তাদের উদিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কৌশলমাত্র। এদিন থেকে ৭ দলীয় জোট ৮ দল ও ৫ দলীয় জোটকে বোকা বানাতে পেরেছিল। রাজনৈতিকভাবে এটি তাদের সাফল্য, এর ফল তারা লাভও করেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব তখন দেশের রাজনীতিতে বিগত দুই দশকের ভাঙ্গা-গড়া, মনমানসিকতাকে ধর্তব্যে নেয়নি, ৫ দলও তা করেনি। ফলে দলীয় এবং জোটের রাজনীতিতে ৮ ও ৫ দল আটলান্টিক মহাসাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৭ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত দলসমূহের ‘গণতান্ত্রিক বৈধতা’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৯০-এর আন্দোলনের সাফল্যকে ৮ ও ৫ দল ঘরে তুলতে না পারার কারণে ৭ দল জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার বৈধতা নেয়ার সুযোগ পায়- ১৯৯১-এর নির্বাচন তাদের তা প্রদান করে। তবে উক্ত নির্বাচনে ১৮টি আসন লাভের পর জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিজস্ব পথের সন্ধান করে, তাতে তরুণদের নিয়ে গঠিত ছাত্রশিবির হয়ে ওঠে তাদের বিপ্লবের জন্য উৎসর্গীকৃত ক্যাডার বা যোদ্ধাবাহিনী, এদেরকে আর্থিকভাবে সমর্থন প্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা হয়, বাংলাদেশকে একটি ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় জামায়াত-বিএনপি তথা ৭ দলীয় জোটকে কৌশলে ব্যবহার করেছে, হাতের পাঁচ হিসেবে রেখেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের অবস্থান ছিল সশস্ত্র পন্থায় বিপ্লব ঘটানো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার ফলে জামায়াত এবং ইসলাম নামধারী বেশিরভাগ দলই কৌশল পরিবর্তন করে। তবে তখন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রশিবিরের ক্যাডারগণ শক্তভাবে ছাত্রলীগ, মৃদুভাবে ছাত্রদলকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তখন ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্ব ধরে রাখার ঘটনাগুলো উপস্থাপন করলে এ ধারণার যথেষ্ট বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়। ২০০০ সালে ৪ দলীয় জোট গঠন ও এর ঘোষণাপত্রে বর্ণিত বক্তব্যে পরিলক্ষিত হয় যে, বিএনপি এবং জামায়াত যৌথভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের রাষ্ট্রদর্শন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেটি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর ৫ বছর দেশ শাসনকালে উদ্যোগ নেয়া হয়। ৪ দলীয় জোট তখন আওয়ামী ভোটারদের মধ্য থেকে সংখ্যালঘুদের জীবন, জীবিকা ও সম্পদ ইত্যাদির ওপর একাত্তরের বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক সংখ্যালঘু পরিবার তখন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, যারা যেতে পারেনি তারা নিঃস্ব, স্তব্ধ ও হতভম্ব হয়ে পড়ে। ৪ দলীয় জোট একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে নির্যাতন, দখল ইত্যাদির মধ্যে সংকোচিত করার উদ্যোগ নেয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী ভোটারদের জানিয়ে দেয়া হয় যে, বিএনপি-জামায়াত জোট অটুট থাকবে, ক্ষমতায় এই জোটই থাকবে। সুতরাং সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে জোটে টেনে আনা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরও অনুরূপ বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়। এর পরই জেলা এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃবৃন্দকে একের পর এক হত্যার সুযোগ করে দেয়া হয়, এসএএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মমতাজ, মঞ্জুরসহ উল্লেখযোগ্য নেতাদের হত্যার পর শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে খতম করার লক্ষ্যে ২১ আগস্টকে বেছে নেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের মতো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে ২০০১ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জোর করে দখল করা হয়। জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের কা-ারীরূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়, বাংলাদেশ, রাষ্ট্রের আদর্শকে ধুয়েমুছে ফেলে দেয়ার কাজ প্রচারযন্ত্র, পাঠ্যপুস্তক, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে করা হয়, জঙ্গীবাদকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দেয়া হয়। বাংলাদেশকে কার্যত পাকিস্তানের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৪ দলীয় জোট রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষমতা ও শক্তিকে ব্যবহার করে অগ্রসর হয়েছে। জোটকে দ্বিতীয় মেয়াদে অনায়াসে ক্ষমতায় আনার জন্য সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়স বৃদ্ধি করা হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার পর ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে ২২ জানুয়ারির ‘ইঞ্জিনিয়ারিং নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত ছিল। বলা চলে ৪ দলীয় জোট ভেতরগতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য অগ্রসর হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে প্রথমে ১৪ দল গঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ প্রধান দল হলেও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বামপন্থী দল আদর্শিক অবস্থানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তবে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সূচিত নির্বাচন কমিশন বিরোধী এবং তত্ত্বাবধায়ক বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয় জাতীয় পার্টি, এলডিপিসহ কিছু পার্টি, গঠিত হয় মহাজোট। মহাজোট দুর্দান্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেও ‘নির্বাচন’ ঠেকাতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একের পর এক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা কতে থাকে। এরই প্রেক্ষাপটে দেশে ১/১১ ঘটে। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। দেশ ২ বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শাসন করে। নানা অনিশ্চয়তার পরও অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ করে। ধারণা করা হয়েছিল যে, মহাজোট আদর্শিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভে তৎপর হবে। মহাজোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ৪ দলীয় জোট যা অতিসম্প্রতি ১৮ দলীয় পরিচয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে তার আদর্শিক অবস্থানের বিরুদ্ধে জনমতকে সুগঠিত করতে তৎপর হবে, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও রাজনীতি নিয়ে অগ্রসর হবে। সেটিই আশা করা গিয়েছিল। বাস্তবে দেখা গেল, মহাজোট ২০০৯ সাল থেকে কার্যত কোন রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় চলার কথা ভাবেনি, উদ্যোগ নেয়নি। অথচ ৪ দলীয় জোট ২০০১-২০০৬ সালে অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে তাদের জোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিল। এই বিষয়গুলোও মহাজোট স্পষ্ট করে মানুষের কাছে তুলে ধরার কোন চেষ্টা করেনি। জোট মহাজোটের রাজনীতিতে ৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় দানবীয় শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিল, আচরণ করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল, এ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ২০০৭ সালে প্রস্তুত ছিল, তখন রায় বা জবাব দিতে পারেনি, কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তা দিয়েছিল। মহাজোটকে মানুষ সে ধরনের ভয়ঙ্কর কোন জোট হিসেবে ভাবেনি, পায়ওনি। তবে যে রূপে বা নামে পেয়েছে তাকে তো কোন নামেই অভিহিত করা যায় না। মনে হচ্ছে, মহাজোটের নামটি মহা হলেও কার্যত এটি কুম্ভকর্ণের ঘুমে আছে।
মহাজোটকে এমন কার্যকরহীন কারা করেছেন, কেন করেছেন, এর ফল কি হতে যাচ্ছে তা যদি মহাজোটভুক্ত নেতৃবৃন্দ এখনও নৈর্ব্যক্তিকভাবে না ভাবেন তা হলে ২০১৩-১৪ সালে দেশে কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক এখনই অনুমান করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের কথাবার্তা ও আচরণে মনে হয় ক্ষমতায় তারা আসছেন এটা তাদের কাছে নিশ্চিত। এবং তখন দেশে ২০০১-৬ এর চাইতেও বর্বরতা, পাশবিকতা, হত্যা, ধর্ষণ, খুন, গুম ও নির্যাতন শুরু হলে মোটেও আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু থাকবে না। ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতা ১৮ দলীয় জোটের কর্মী, সমর্থকদের কথাবার্তায় শোনা যাচ্ছে। মহাদানবের দূরবর্তী হুঙ্কার ও গর্জন শোনা যাচ্ছে। জোটের শক্তির এমন তা-ব, মহাজোটের এমন নীরবতা ও কর্মহীনতা বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা জনগণকেও ভাবতে হবে, বুঝতে হবে। মহাজোট কি আসলেই বিষয়গুলো নিয়ে সেভাবে ভাবছে? নাকি এখনও মানঅভিমান ও বাকবিতণ্ডায় সময় কাটাবে?

লেখক : অধ্যাপক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.