এপার-ওপার-শিলাইদহে শান্তিনিকেতনের খোঁজ by অমিত বসু

ট্রেন ওভারটেক করতে পারে না। সহজ-সরল চলন লাইন ধরে। এদিক-সেদিক ঘোরে, ঘুরিয়ে দিলে। কাজটা লাইনম্যানের। ট্রেনের ব্রেনের দরকার নেই। ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস, ছুটতে ছুটতে এসে পোড়াদহ জংশনে একটু জিরানোর সুযোগ নিতেই মনে হলো, আহা, ওর যদি টার্নিংয়ের ক্ষমতা থাকত,


নিশ্চয়ই বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যেত। কলকাতা যাওয়া তো পালাচ্ছে না! এক ফাঁকে শিলাইদহটা দেখে নিলে ক্ষতি কী! সামান্য দৌড়ালেই কুষ্টিয়ার গায়ে রবীন্দ্রনাথের সাধন ক্ষেত্র শিলাইদহ। পদ্মায় সোনার তরীতে বসে মন নীল-নীলিমায় নিরুদ্দেশ। সাদা পাতার এক পিঠে জমিদারির টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাব। উল্টোদিকে 'বধূ মিছে রাগ কোরো না কোরো না।' গল্পে-গদ্যে-পদ্যে সৃজনের আদিগন্ত বিস্তার। এমনকি গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদও সেখানে। ভাবনার সঙ্গী হতে কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকলেন এস এম এ খালেক। এই রেলগাড়ির গার্ড। এমনিতে ডিউটি করেন রাজশাহীতে। হেসে বললেন, 'সবুজ সংকেত দিয়ে ট্রেনের যাত্রা শুরু করতে পারি। রাস্তা বদলানোর সাধ্য নেই।' আপনার ইচ্ছার কথা রেলমন্ত্রীকে বলুন না! সত্যিই তো আমার স্বপ্নের বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপানোর মানে হয় না। আন্তরিক আলাপনের মাঝে দরজায় ঠক ঠক। প্যানট্রি কার থেকে লাঞ্চের অর্ডার নিতে এসেছেন জাহিদ কামাল। বিশাল চেহারার সরল মানুষ। উঁকি দিয়ে প্রশ্ন- রুই, না চিকেন? উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন_মাছ খান, মাছ বেটার।
আফসোস হচ্ছে, এবার রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি। জানুয়ারিতে যখন এসেছিলাম তখনকার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। অনেক কথার মধ্যে শিলাইদহ-কলকাতা রুটের আর্জি জানানোর কথা মাথায় আসেনি। পরে কলকাতায় লোকদের কথায় মনে হয়েছে, তারা শিলাইদহ সফরে বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশ সফরের কথা ভাবলেই আগে শিলাইদহের কথা জিজ্ঞেস করে। তাদের চোখে শান্তিনিকেতনের মতো শিলাইদহ অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব যতটা, শিলাইদহ তার চেয়ে একটু বেশি। মাঝখানে ইমিগ্রেশন-কাস্টমস চেকিংয়ের সময় ধরেও ছয় ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ থেকে পর্যটকরা কলকাতায় এলে শান্তিনিকেতন দেখার সুযোগ ছাড়েন না। কলকাতা থেকে শিলাইদহে সরাসরি রুট চালু হলে ট্যুরিস্টের অভাব হবে না। পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা খুবই ঝাপসা। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে, কী দেখবে জানে না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে দুই দেশের মানুষের সমানতালে যাতায়াতটা জরুরি। সেটা শুরু হতে পারে শিলাইদহ দিয়ে। ওই একটা সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ পর্যটনের আগ্রহ বাড়তে পারে ভারতীয়দের। তাতে শিলাইদহেরও লাভ। পর্যটন বাণিজ্য নতুনমাত্রা পাবে। নতুন নতুন হোটেল-রেস্তোরাঁ মাথা তুলবে। বাংলাদেশি পণ্যের কেনাবেচা চলবে। বিশেষ করে হস্তশিল্পজাত সামগ্রীর বাজার তৈরি হবে।
বর্তমানে ট্যুরিস্টের ঠেলায় শান্তিনিকেতনের প্রাণান্ত। বাড়িতে বাড়িতে চারপাশের খালি জমি ভর্তি। ছুটি পেলেই লোকে ছুটছে সেখানে। একমাত্র প্রখর গ্রীষ্মে যাত্রাবিরতি। বীরভূমের পোড়া লাল মাটিতে এখন পা রাখার সাধ্য কার! খোয়াই নদীর কঙ্কাল দেখলেই আতঙ্ক শান্তিনিকেতন পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হয় না সে কারণেই। তার আগেই ছুটি। কুষ্টিয়ার গরম তুলনায় নরম। পদ্মা তাপ শুষে নেয়। কাঠফাটা দেখলেও মাটি ততটা তাঁতে না। রবীন্দ্র জন্মোৎসব শিলাইদহে হতে পারে। দুই দেশের মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের ধ্রুবতারাকে বরণ করতে অসুবিধা হবে না।
একটা চিনির দানা পেলে যেমন অজস্র পিঁপড়া ভিড় করে, শিলাইদহের যাত্রাপথ যুগল হলে তেমনই পর্যটকের ভিড় উপচে পড়বে। সেখানে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর আদলে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়া যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী শান্তিনিকেতনে পড়তে যায়। স্বদেশে সে সুযোগ পেলে তার দরকার হবে না। ঘর ছাড়া না হয়েও কবির রাস্তায় শিক্ষার আলো পাওয়া সম্ভব। প্রথম দিকে নৃত্যগীত-নাটক-সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষাক্রম চালু করা ভালো। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান বিষয়ে এগোনো যায়। পাঁচ বছর আগে যখন ড. সুজিত বসু বিশ্বভারতীর উপাচার্য, এ রকম একটা প্রস্তাব উঠেছিল। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। জায়গা খোঁজা শুরু হয়েছিল। তখন শিলাইদহের কথাটা কারো মাথায় আসেনি। বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরি যাওয়ার পর প্রজেক্টটা থমকে যায়। দুর্নীতি এখনো বিশ্বভারতীর পিছু ছাড়েনি। রবীন্দ্রভবনে বিশাল পরিমাণ কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্যের ব্যয় নির্বাহে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান সেই
সুজিত বসু।
রবীন্দ্রনাথ কী এমন শিক্ষায়তন চেয়েছিলেন; যেখানে চলতে গেলে পায়ে পায়ে অন্যায়ের কাঁটা ফোটে! প্রথাগত শিক্ষার শেকল ছিঁড়ে কিশলয়দের মুক্ত আলোয় উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তা আর হলো কই? আজ হাজার বন্ধনে হাঁসফাঁস করছে বিশ্বভারতী। চারপাশে শক্ত পাঁচিল উঠেছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের স্কুলজীবন কেটেছে সেখানেই। তিনি প্রতিবাদ করেছেন প্রাচীর তোলার বিরুদ্ধে। নিরাপত্তার খাতিরে নাকি এই ব্যবস্থা! তাও কী সুনিশ্চিত হচ্ছে? শর্ষের মধ্যে ভূত। এ অবস্থায় ভূত তাড়ানোর দরকার নেই। বরং ভূত মানে অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাটাই বেশি জরুরি। রবীন্দ্র সার্ধশতজন্মবার্ষিকীতে কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষিত। শিলাইদহে কবির আলোয় শিক্ষানিকেতন মাথা তুললে সেটাই হবে নতুন প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। তার অধিকাংশই ম্যানেজমেন্টকেন্দ্রিক। এ মুহূর্তে চারুকলার বিকাশের জন্য নতুন আকাশ দরকার। সেটা দিতে পারে বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয়।
মৈত্রী এক্সপ্রেস রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে, চুয়াডাঙ্গা পেরিয়ে দর্শনার দিকে। চিন্তায় বাদ সাধলেন অ্যাটেনডেন্ট আলী আহমেদ। ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রার শুরু থেকেই এই ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে আছেন। দর্শনায় ডিউটি শেষ হওয়ার আগেই তাঁর অভিমানের বাঁধ ভাঙল। বললেন, 'আপনারা সব বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবেন। আমাদের মতো ছোট মানুষদের দিকে তাকান না।' কষ্টের কারণ জানতে চাইতেই ক্ষোভ, 'আমাকে অ্যাটেনডেন্ট বলার দরকার নেই। বলুন, বাংলাদেশ রেলের খালাসি। এই ট্রেনে ভারতীয় কাউন্টারপার্টদের আরো গালভরা নাম। সেটা তাদের মানায়। আমাদের তিন গুণ বেতন পায়। আমার বেসিক সাত হাজার। সব মিলিয়ে ১২ হাজার। ওরা পায় ৩৫ হাজার। একই কাজ। বেতনে বিস্তর ব্যবধান। আগে আমাদের-ওদের আর্থিক দূরত্ব ঘোচান, তারপর বড় বড় কথা ভাববেন।'

লেখক : কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.