সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-রাষ্ট্রকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না by সাদিক আহমদ
পদ্মা সেতুর ঋণ জোগাতে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এখন অতি দ্রুত ঋণের অর্থ ছাড় করে সেতুটির নির্মাণ শুরুর জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে আশা করব। শর্ত পূরণে সরকারের তরফে বিলম্ব হয়েছে কি-না, সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যে মতপার্থক্য তাতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে কে হারল আর কে জিতল
কিংবা বিশ্বব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-জাপানের ঋণের যথার্থ বিকল্প কিছু আছে কি-না_ সে প্রসঙ্গে যাব না। বিদেশি ঋণের পরিবর্তে নিজস্ব অর্থে সেতুটি নির্মাণের স্লোগানে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এতে আবেগ আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান কতটা সেটাও এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগ সহজ ও দ্রুততর করার জন্য আমাদের পদ্মা সেতু প্রয়োজন এবং এটা নির্মাণের পথে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় তা নিরসন করা উচিত_ এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। মহাকালের সৃষ্ট প্রাকৃতিক ব্যবধান অর্থাৎ পদ্মা নদীর কারণে বরিশাল-যশোর-খুলনা অঞ্চলকে রাজধানী থেকে অনেক দূরের বলে মনে হয়। অথচ মানচিত্র নিয়ে বসলে আমরা দেখব যে, বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে কাছের হচ্ছে বরিশাল। উন্নত সড়কপথে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টাতেই ঢাকা থেকে বরিশাল পেঁৗছানো সম্ভব। সেতুতে রেলপথ থাকলে বেনাপোল স্থলবন্দর এবং মংলা নৌবন্দরে যোগাযোগের সময়ও কমে যাবে। এভাবে আমরা ব্যবসায়ের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারব।
পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিশ্বব্যাংকও এ প্রশ্ন তোলেনি। তারা স্বচ্ছতার ইস্যুতে কিছু বিষয় উত্থাপন করে এবং তাতে সরকারের দিক থেকে কিছু পাল্টা বক্তব্য ছিল। এখন সব জটিলতার নিরসন হয়েছে বলে মনে করি। এরপর বিশ্বব্যাংক যদি তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত পরিবর্তন না করে এবং নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হয়, তাহলে নতুন করে নানা প্রশ্ন উঠবে। তাদের প্রতি অভিযোগের তীর ছুটে যাবে। ঋণের অর্থ ছাড় করার বিষয়ে বিধিনিষেধ উঠে গেলে সরকারের দিক থেকে অপরিহার্য হবে স্বচ্ছতার প্রতি মনোনিবেশ করা। কাজের নানা পর্যায়ে কোনোভাবেই যেন দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং চাই। বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাশা অবশ্যই পূরণ করা চাই। ব্যক্তি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে এ কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে আমরা মূল্যবান দুটি বছর হারিয়েছি। এখন এটা 'ইতিহাসের বন্ধ অধ্যায়ে' পরিণত হয়ে থাকুক, এটাই কাম্য। বাংলাদেশের জনগণের জন্যই সেতুটি যত দ্রুত সম্ভব নির্মাণ করা চাই এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিজ নিজ দায়িত্বটুকু সুচারুরূপে পালন করা চাই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাত্রা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে এটা যে রয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু যে কেউ স্বীকার করবেন যে, সার্বিকভাবে অর্থনীতির চিত্র বরং ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি-রফতানি, প্রবাসে কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স_ এসব সূচক তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না, কিন্তু খাদ্য নিয়ে তেমন কোনো দুর্ভাবনা নেই। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে যে ঝড়-ঝাপটা তা থেকে নিজেদের যতটা সম্ভব মুক্ত রাখার আন্তরিক প্রয়াস লক্ষণীয় এবং তাতে সাফল্যও রয়েছে। তবে এর মধ্যেই সামনে এসেছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিষয়টি। প্রায় এক দশক আগে ২০০৩ সালে আমি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকার ব্যাংকিং খাতের চিত্র নিয়ে আমিসহ আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছিলেন যে, ব্যাংকের আকার বড় হয়েছে, কিন্তু দক্ষতা বাড়েনি। ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক ও অন্যান্য ধরনের চাপ প্রতিটি দেশেই কমবেশি দেখা গেছে। এ প্রেক্ষাপটেই সংস্কারের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারসাধিত হলেও মূল সমস্যা রয়েই গেছে।
হলমার্ক গ্রুপকে দেশের প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত সোনালী ব্যাংক প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং তা আদায় যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলেই ধারণা করা হয়। কারণ, ঋণ গ্রহণের সময় যে জামানত বা বন্ধক রাখার কথা তা পর্যাপ্ত ছিল না এবং যাও-বা রাখা হয়েছে তাতে মিথ্যা ও অসততা রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। হলমার্ককে সরকারি ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে তা গত বছরে বাস্তবায়িত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ। এখন এ ঋণ যদি আদায় না হয় তাহলে শেষ বিচারে দায় চাপবে সরকারের ওপরেই। কেন একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য সরকার দায়ভার বহন করবে? বাংলাদেশের জনগণের সরকারি ব্যাংকের ওপরে যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। এর কারণ এটা নয় যে, এসব ব্যাংক ভালো চলছে। বরং এটাই ধারণা যে, সরকারি ব্যাংকে অর্থ রাখা হলে কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হলে সরকার তার দায় বহন করবে। আমরা জানি যে, এ ঝুঁকি আসে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মানা না হলে কিংবা দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটলে। বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার খুবই ছোট। এর কারণ সরকারের সম্পদের অপ্রতুলতা। অথচ অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, দরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রাখা এবং এ ধরনের আরও অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। শুল্ককর আদায়ের খাত থেকে পর্যাপ্ত অর্থ মিলছে না বলেই সরকারকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছোট রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় হলমার্কের মতো একটি গোষ্ঠীর অনিয়মের জন্য কেন সরকার এক বছরের মোট উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ গচ্চা দেওয়ার ঝুঁকি নেবে?
সোনালী-জনতা-অগ্রণী-রূপালী ব্যাংকের ওপর কার্যকর তদারকির ভার সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেয়নি, বরং এটা রেখেছে নিজের হাতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এ কাজ করে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তদারকির ভার রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, গত কয়েক বছরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তাদের ঋণ শ্রেণীকরণে সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকের লিকুইডিটি বা তারল্য সমস্যাও রয়েছে। কিন্তু তারপরও বলা যায় যে, এগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের ঝুঁকি নিয়মিত মূল্যায়ন করছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি ব্যাংক সমস্যায় পড়লে তার দায়দেনা রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে মেটাতে হয় না।
সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের দাওয়াই রয়েছে। তবে এ কাজে রাজনৈতিক ঝুঁকিও যথেষ্ট। বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করতে গিয়েও নানা প্রভাব যে চলে আসে সেটা দেখা গেছে রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে। তবে জরুরি ভিত্তিতে প্রথমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা চাই। পরিচালনা পরিষদ নিয়ে ভাবতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। যাদের কারণে ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না।
দীর্ঘমেয়াদে আমানত ও ঋণ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাদের আমানতের বড় উৎস সরকারের অর্থ। পেনশন তহবিলও নিরাপদ উৎস। কিন্তু ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যারো ব্যাংকিংয়ের নীতিতে যেতে হবে। ব্যক্তিগত খাতে ঋণ প্রদান করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য চাপের কাছে নতি স্বীকারের অনেক ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকেও নানা বাধ্যবাধকতায় তারা ঋণ দিয়েছে এবং এর উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে বা পড়ছে। ন্যারো ব্যাংকিং করতে গিয়ে স্বভাবতই আয় কমে যাবে এবং এ কারণে আমানত গ্রহণেও তারা সতর্ক থাকবে।
বর্তমানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ভূমিকা বেড়ে চলেছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের কথাও বলা যায়। এ ধরনের আরও কয়েকটি বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান নিয়ম লঙ্ঘন করে দীর্ঘ সময় ধরে জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করেছে। জনসাধারণ অতি লাভের আশায় তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। এ জন্য তাদের ওপর দোষ চাপানো যেতেই পারে, যেমনটি করা হয়েছে শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের সময়। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে যে, জনসাধারণ না হয় ভুল বুঝে অসৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করেছে? সোমবার মন্ত্রিসভায় এমএলএম লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করলে বা ব্যবসার নামে প্রতারণা করলে তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করে একটি আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। মিথ্যা তথ্য বা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করলে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং প্রতারিত ব্যক্তির যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তার দ্বিগুণ আদায় করা হবে। বলা যায় যে, আমরা ঠেকে শিখেছি এবং একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন আইনটি দ্রুত প্রণীত হওয়া দরকার। এর প্রয়োগেও যেন ধীরে চলার ঘটনা না ঘটে। জনসাধারণকে ফাঁকি দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অপচেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করা চাই এবং এ দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। যারা আইন লঙ্ঘন করে এতদিন জনসাধারণকে ঠকিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া চাই।
সবশেষে আবারও বলব যে, রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ কম এবং ব্যয়ের অনেক খাত রয়েছে। এ অর্থ কেন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসততা ও দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য ব্যয় করা হবে? তাছাড়া সম্পদ থাকলেও এভাবে ব্যয় করার যুক্তি নেই নৈতিক কারণে। রাষ্ট্রীয় অর্থ জনগণের এবং তা ব্যবহারে অবশ্যই বিচক্ষণতা ও যৌক্তিকতা থাকতে হবে।
ড. সাদিক আহমদ :পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান
পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিশ্বব্যাংকও এ প্রশ্ন তোলেনি। তারা স্বচ্ছতার ইস্যুতে কিছু বিষয় উত্থাপন করে এবং তাতে সরকারের দিক থেকে কিছু পাল্টা বক্তব্য ছিল। এখন সব জটিলতার নিরসন হয়েছে বলে মনে করি। এরপর বিশ্বব্যাংক যদি তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত পরিবর্তন না করে এবং নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হয়, তাহলে নতুন করে নানা প্রশ্ন উঠবে। তাদের প্রতি অভিযোগের তীর ছুটে যাবে। ঋণের অর্থ ছাড় করার বিষয়ে বিধিনিষেধ উঠে গেলে সরকারের দিক থেকে অপরিহার্য হবে স্বচ্ছতার প্রতি মনোনিবেশ করা। কাজের নানা পর্যায়ে কোনোভাবেই যেন দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং চাই। বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাশা অবশ্যই পূরণ করা চাই। ব্যক্তি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে এ কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে আমরা মূল্যবান দুটি বছর হারিয়েছি। এখন এটা 'ইতিহাসের বন্ধ অধ্যায়ে' পরিণত হয়ে থাকুক, এটাই কাম্য। বাংলাদেশের জনগণের জন্যই সেতুটি যত দ্রুত সম্ভব নির্মাণ করা চাই এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিজ নিজ দায়িত্বটুকু সুচারুরূপে পালন করা চাই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাত্রা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে এটা যে রয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু যে কেউ স্বীকার করবেন যে, সার্বিকভাবে অর্থনীতির চিত্র বরং ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি-রফতানি, প্রবাসে কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স_ এসব সূচক তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না, কিন্তু খাদ্য নিয়ে তেমন কোনো দুর্ভাবনা নেই। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে যে ঝড়-ঝাপটা তা থেকে নিজেদের যতটা সম্ভব মুক্ত রাখার আন্তরিক প্রয়াস লক্ষণীয় এবং তাতে সাফল্যও রয়েছে। তবে এর মধ্যেই সামনে এসেছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিষয়টি। প্রায় এক দশক আগে ২০০৩ সালে আমি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকার ব্যাংকিং খাতের চিত্র নিয়ে আমিসহ আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছিলেন যে, ব্যাংকের আকার বড় হয়েছে, কিন্তু দক্ষতা বাড়েনি। ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক ও অন্যান্য ধরনের চাপ প্রতিটি দেশেই কমবেশি দেখা গেছে। এ প্রেক্ষাপটেই সংস্কারের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারসাধিত হলেও মূল সমস্যা রয়েই গেছে।
হলমার্ক গ্রুপকে দেশের প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত সোনালী ব্যাংক প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং তা আদায় যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলেই ধারণা করা হয়। কারণ, ঋণ গ্রহণের সময় যে জামানত বা বন্ধক রাখার কথা তা পর্যাপ্ত ছিল না এবং যাও-বা রাখা হয়েছে তাতে মিথ্যা ও অসততা রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। হলমার্ককে সরকারি ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে তা গত বছরে বাস্তবায়িত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ। এখন এ ঋণ যদি আদায় না হয় তাহলে শেষ বিচারে দায় চাপবে সরকারের ওপরেই। কেন একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য সরকার দায়ভার বহন করবে? বাংলাদেশের জনগণের সরকারি ব্যাংকের ওপরে যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। এর কারণ এটা নয় যে, এসব ব্যাংক ভালো চলছে। বরং এটাই ধারণা যে, সরকারি ব্যাংকে অর্থ রাখা হলে কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হলে সরকার তার দায় বহন করবে। আমরা জানি যে, এ ঝুঁকি আসে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মানা না হলে কিংবা দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটলে। বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার খুবই ছোট। এর কারণ সরকারের সম্পদের অপ্রতুলতা। অথচ অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, দরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রাখা এবং এ ধরনের আরও অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। শুল্ককর আদায়ের খাত থেকে পর্যাপ্ত অর্থ মিলছে না বলেই সরকারকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছোট রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় হলমার্কের মতো একটি গোষ্ঠীর অনিয়মের জন্য কেন সরকার এক বছরের মোট উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ গচ্চা দেওয়ার ঝুঁকি নেবে?
সোনালী-জনতা-অগ্রণী-রূপালী ব্যাংকের ওপর কার্যকর তদারকির ভার সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেয়নি, বরং এটা রেখেছে নিজের হাতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এ কাজ করে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তদারকির ভার রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, গত কয়েক বছরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তাদের ঋণ শ্রেণীকরণে সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকের লিকুইডিটি বা তারল্য সমস্যাও রয়েছে। কিন্তু তারপরও বলা যায় যে, এগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের ঝুঁকি নিয়মিত মূল্যায়ন করছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি ব্যাংক সমস্যায় পড়লে তার দায়দেনা রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে মেটাতে হয় না।
সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের দাওয়াই রয়েছে। তবে এ কাজে রাজনৈতিক ঝুঁকিও যথেষ্ট। বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করতে গিয়েও নানা প্রভাব যে চলে আসে সেটা দেখা গেছে রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে। তবে জরুরি ভিত্তিতে প্রথমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা চাই। পরিচালনা পরিষদ নিয়ে ভাবতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। যাদের কারণে ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না।
দীর্ঘমেয়াদে আমানত ও ঋণ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাদের আমানতের বড় উৎস সরকারের অর্থ। পেনশন তহবিলও নিরাপদ উৎস। কিন্তু ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যারো ব্যাংকিংয়ের নীতিতে যেতে হবে। ব্যক্তিগত খাতে ঋণ প্রদান করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য চাপের কাছে নতি স্বীকারের অনেক ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকেও নানা বাধ্যবাধকতায় তারা ঋণ দিয়েছে এবং এর উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে বা পড়ছে। ন্যারো ব্যাংকিং করতে গিয়ে স্বভাবতই আয় কমে যাবে এবং এ কারণে আমানত গ্রহণেও তারা সতর্ক থাকবে।
বর্তমানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ভূমিকা বেড়ে চলেছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের কথাও বলা যায়। এ ধরনের আরও কয়েকটি বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান নিয়ম লঙ্ঘন করে দীর্ঘ সময় ধরে জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করেছে। জনসাধারণ অতি লাভের আশায় তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। এ জন্য তাদের ওপর দোষ চাপানো যেতেই পারে, যেমনটি করা হয়েছে শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের সময়। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে যে, জনসাধারণ না হয় ভুল বুঝে অসৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করেছে? সোমবার মন্ত্রিসভায় এমএলএম লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করলে বা ব্যবসার নামে প্রতারণা করলে তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করে একটি আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। মিথ্যা তথ্য বা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করলে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং প্রতারিত ব্যক্তির যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তার দ্বিগুণ আদায় করা হবে। বলা যায় যে, আমরা ঠেকে শিখেছি এবং একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন আইনটি দ্রুত প্রণীত হওয়া দরকার। এর প্রয়োগেও যেন ধীরে চলার ঘটনা না ঘটে। জনসাধারণকে ফাঁকি দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অপচেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করা চাই এবং এ দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। যারা আইন লঙ্ঘন করে এতদিন জনসাধারণকে ঠকিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া চাই।
সবশেষে আবারও বলব যে, রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ কম এবং ব্যয়ের অনেক খাত রয়েছে। এ অর্থ কেন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসততা ও দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য ব্যয় করা হবে? তাছাড়া সম্পদ থাকলেও এভাবে ব্যয় করার যুক্তি নেই নৈতিক কারণে। রাষ্ট্রীয় অর্থ জনগণের এবং তা ব্যবহারে অবশ্যই বিচক্ষণতা ও যৌক্তিকতা থাকতে হবে।
ড. সাদিক আহমদ :পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান
No comments