মানুষের মুখ-‘ছকরবনদের জীবনকথা by সালেক খোকন
উপজেলার নামটি কেন ‘বিরল’, জানা নেই তা স্থানীয়দের। আমাদের গন্তব্য বিরলের জগতপুর গ্রাম। সেখানে বন্ধু মহসিনের বাড়ি। মাস দেড়েক আগে যাই সেখানে। বিরলে পা রাখতেই দেখি অন্য দৃশ্য। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘের দেখা নেই। ফকফকে আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্যটা।
অথচ খানিক আগেই দিনাজপুর শহরে দেখে এলাম ঝুম বৃষ্টি। বলছি, বর্ষা আসার কয়েক দিন আগের কথা।
আম-কাঁঠালের বাগান পেরোতেই ধানখেতের সবুজ আলিঙ্গন। আইল পেরিয়ে একটু উঁচুতে উঠান করা একটি বাড়ি। মাটি আর ছনে ছাওয়া তিনটি ঘর বাড়িটিতে। জলপান আর হাসি-তামাশায় চলে মহসিনের সঙ্গে আমাদের আড্ডা। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে পুরুষ কণ্ঠে গানের সুর। হেঁড়ে গলায় একজন গাইছে, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই...’। খানিক বাঁশ কাটার ফট ফট শব্দ। আবারও গান। গানের সুর ধরেই আমরা বাইরে বেরিয়ে আসি।
মহসিনদের উঠানের পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি শণের ঘর। বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর দাঁড়ানো ঘরটি। চালে বিশেষ ঢঙে শণ বেঁধে দিচ্ছেন একজন। বয়স ষাটের মতো। কাজের ফাঁকে গান গাইছেন তিনি। সমবয়সী অন্য আরেকজন বাঁশ কাটায় ব্যস্ত। ঠোঁটের কোণে জ্বালানো বিড়িতে সুখটান দিয়ে মাপমতো তিনি কেটে নিচ্ছেন বাঁশগুলো। যেন এক অন্যরকম শিল্পকর্ম।
আমাদের পায়ের শব্দে তাঁদের গান থেমে যায়। পরিচয় জানতেই চালায় বসে জহুরুল নিজের সঙ্গে জানালেন আজিজুরের নামটিও। দলের সরদার জহুরুল। শণের ঘর তৈরিতে এখানকার দশ গ্রামের ভরসা এঁরাই।
আপনাদের কী বলে ডাকে সবাই? উত্তরে জহুরুল বলেন, ‘হামরা ছকরবন। অন্য দেশে এটা ঘরকাজ, বাঁশমিস্ত্রি, ঘরামি।’ জহুরুলের বাড়ি বিরলের পশ্চিমপাড়ায়। মা ফেলানির স্মৃতি মনে নেই তাঁর। বাবা মকবুল হোসেনের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় খানেরা মারিছে।’
এই পেশায় কত দিন? জহুরুলের উত্তর, ‘বিয়ের বয়স যত দিন, ছকরবন হওয়া অত দিন।’ হাতের দা দেখিয়ে বলেন, ‘৩০ বছর আগে হাতে নিছি এই দা।’
ছকরবনের কাজ কী? গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে আজিজুর এবার উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘ঘর ছাহি, টিন ছাহি, বাঁশ ফাটাই, বাতা করি।’ কী কী বাঁশ লাগে? আজিজুর বলেন, ‘লাগে মাকলা আর জেওঠা বাঁশ। পোয়া করি জেওঠা বাঁশকে আর মাকলা বাঁশের বাতা করি, রুয়া করি।’
আলাপ জমতেই জহুরুল জানান তাঁর ছকরবনের কাজে আসার ঘটনাটি। সাহাপাড়া গ্রামের এক বৃদ্ধ ছিলেন নামকরা ছকরবন। সবাই তাঁকে ছপো নামে ডাকত। তিনি যখন গ্রামে কাজ করতে আসতেন, জহুরুল তখন পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতেন। একবার অনুমতি চেয়ে তিনি বলেন, ‘দাদা, এইটা চালে বান দেই।’ আগ্রহ দেখে ছপো খুশি হন। সেদিন জহুরুলকে ছপো বলেন, ‘তুই তো বান সুন্দর পারতেছিস, আস্তে আস্তে পারি যাবি তুই।’ এভাবে ছপোর হাত ধরেই জহুরুল আসেন ছকরবন পেশায়।
ছকরবনেরা ঘর তৈরির কাজ নেন ঠিকা হিসেবে। ৭ থেকে ১০ হাতের একটি ঘর তৈরিতে তাঁরা পারিশ্রমিক নেন তিন হাজার টাকা।
কীভাবে কাজ শুরু করেন? জহুরুলের উত্তর, ‘দড়ি দিয়া আগে মাড়োয়া করি, গর্ত করি, পাইরামো করি, খুঁটি লাগাই। এরপর চাল বান্ধা হবে।’ ভালো ঘর তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যত মাল দিবু, অত ভালো হবি। যত সময় দিমু, অত ভালো।’
ঘর তৈরি শেষে বাড়ির মালিক প্রশংসা করলে ছকরবনদের মন ভরে যায়। জহুরুলের ভাষায়, ‘মহাজন ভালো কইলে হামারও ভালো।’
জহুরুল জানালেন, একসময় নতুন ঘর তৈরির জন্য প্রথম খুঁটির গর্তে বাড়ির কর্তাকে পান-সুপারি ও চুন ফেলতে হতো। ছকরবনকে দেওয়া হতো শোকরানা। সময়ের আবর্তে সেই সব আচার এখন আর কেউ পালন করে না।
সারা বছর টুকিটাকি মেরামতের কাজ থাকলেও ছকরবনদের কাজ থাকে না বর্ষায়। ফাল্গুন-চৈত্রে আবার যখন শণের ঘর তৈরির ধুম পড়ে, তখন কদর বেড়ে যায় ছকরবনদের।
একসময় গ্রামের প্রায় বাড়িতেই শণের ঘর ছিল। সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে গ্রামের চিত্র। শণের জায়গা দখলে নিয়েছে টিনের চালা। জহুরুলের ভাষায়, ‘আগে মাইনসের পাইসা আছলোনি। এখন পাইসা হইছে, বাড়িত টিন দেছে।’ ফলে কাজ কমে গেছে ছকরবনদের। জহুরুল বলেন, ‘দিনে দিনে ছকরবনের কাম উঠি যাচ্ছে।’
বিয়ের শুরুতেই ছকরবনের খাতায় নাম লেখান জহুরুল। এভাবে কেটে যায় ৩০টি বছর। এত দিন পর তাঁর স্ত্রী রাতেকা বানু যখন তাঁকে বলেন, ‘সবার কাম ফুরায়ে যাচ্ছে। ছকরবনের কাম শেষ। কী করি খাবেন?’ উত্তরে জহুরুল মলিন মুখে শুধুই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।
জহুরুল জানালেন তাঁর কষ্টের কথা। অন্যের ঘরের চালা ঠিক করে দিলেও তাঁর নিজের ভাঙা ঘরের চাল বেয়েই পানি পড়ে। তা সারাতে টাকার অভাবে শণ কিনতে পারেন না তিনি। জহুরুলের ঘরের চালা দেখে পাড়ার লোকেরা ঠাট্টা করে বলে, ‘ছকরবনের ভাঙ্গা টুহি।’
এরই মধ্যে নতুন ঘরের পুরো চালা ঢেকে যায় শণে। ছকরবন জহুরুল আর আজিজুর ব্যস্ত হয়ে পড়েন আপন কাজে। বাঁশ আর শণের সঙ্গে এভাবেই মিশে যায় ছকরবনদের দুঃখ-কষ্টগুলো।
সালেক খোকন
contact@ salekkhokon.me
আম-কাঁঠালের বাগান পেরোতেই ধানখেতের সবুজ আলিঙ্গন। আইল পেরিয়ে একটু উঁচুতে উঠান করা একটি বাড়ি। মাটি আর ছনে ছাওয়া তিনটি ঘর বাড়িটিতে। জলপান আর হাসি-তামাশায় চলে মহসিনের সঙ্গে আমাদের আড্ডা। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে পুরুষ কণ্ঠে গানের সুর। হেঁড়ে গলায় একজন গাইছে, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই...’। খানিক বাঁশ কাটার ফট ফট শব্দ। আবারও গান। গানের সুর ধরেই আমরা বাইরে বেরিয়ে আসি।
মহসিনদের উঠানের পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি শণের ঘর। বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর দাঁড়ানো ঘরটি। চালে বিশেষ ঢঙে শণ বেঁধে দিচ্ছেন একজন। বয়স ষাটের মতো। কাজের ফাঁকে গান গাইছেন তিনি। সমবয়সী অন্য আরেকজন বাঁশ কাটায় ব্যস্ত। ঠোঁটের কোণে জ্বালানো বিড়িতে সুখটান দিয়ে মাপমতো তিনি কেটে নিচ্ছেন বাঁশগুলো। যেন এক অন্যরকম শিল্পকর্ম।
আমাদের পায়ের শব্দে তাঁদের গান থেমে যায়। পরিচয় জানতেই চালায় বসে জহুরুল নিজের সঙ্গে জানালেন আজিজুরের নামটিও। দলের সরদার জহুরুল। শণের ঘর তৈরিতে এখানকার দশ গ্রামের ভরসা এঁরাই।
আপনাদের কী বলে ডাকে সবাই? উত্তরে জহুরুল বলেন, ‘হামরা ছকরবন। অন্য দেশে এটা ঘরকাজ, বাঁশমিস্ত্রি, ঘরামি।’ জহুরুলের বাড়ি বিরলের পশ্চিমপাড়ায়। মা ফেলানির স্মৃতি মনে নেই তাঁর। বাবা মকবুল হোসেনের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় খানেরা মারিছে।’
এই পেশায় কত দিন? জহুরুলের উত্তর, ‘বিয়ের বয়স যত দিন, ছকরবন হওয়া অত দিন।’ হাতের দা দেখিয়ে বলেন, ‘৩০ বছর আগে হাতে নিছি এই দা।’
ছকরবনের কাজ কী? গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে আজিজুর এবার উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘ঘর ছাহি, টিন ছাহি, বাঁশ ফাটাই, বাতা করি।’ কী কী বাঁশ লাগে? আজিজুর বলেন, ‘লাগে মাকলা আর জেওঠা বাঁশ। পোয়া করি জেওঠা বাঁশকে আর মাকলা বাঁশের বাতা করি, রুয়া করি।’
আলাপ জমতেই জহুরুল জানান তাঁর ছকরবনের কাজে আসার ঘটনাটি। সাহাপাড়া গ্রামের এক বৃদ্ধ ছিলেন নামকরা ছকরবন। সবাই তাঁকে ছপো নামে ডাকত। তিনি যখন গ্রামে কাজ করতে আসতেন, জহুরুল তখন পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতেন। একবার অনুমতি চেয়ে তিনি বলেন, ‘দাদা, এইটা চালে বান দেই।’ আগ্রহ দেখে ছপো খুশি হন। সেদিন জহুরুলকে ছপো বলেন, ‘তুই তো বান সুন্দর পারতেছিস, আস্তে আস্তে পারি যাবি তুই।’ এভাবে ছপোর হাত ধরেই জহুরুল আসেন ছকরবন পেশায়।
ছকরবনেরা ঘর তৈরির কাজ নেন ঠিকা হিসেবে। ৭ থেকে ১০ হাতের একটি ঘর তৈরিতে তাঁরা পারিশ্রমিক নেন তিন হাজার টাকা।
কীভাবে কাজ শুরু করেন? জহুরুলের উত্তর, ‘দড়ি দিয়া আগে মাড়োয়া করি, গর্ত করি, পাইরামো করি, খুঁটি লাগাই। এরপর চাল বান্ধা হবে।’ ভালো ঘর তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যত মাল দিবু, অত ভালো হবি। যত সময় দিমু, অত ভালো।’
ঘর তৈরি শেষে বাড়ির মালিক প্রশংসা করলে ছকরবনদের মন ভরে যায়। জহুরুলের ভাষায়, ‘মহাজন ভালো কইলে হামারও ভালো।’
জহুরুল জানালেন, একসময় নতুন ঘর তৈরির জন্য প্রথম খুঁটির গর্তে বাড়ির কর্তাকে পান-সুপারি ও চুন ফেলতে হতো। ছকরবনকে দেওয়া হতো শোকরানা। সময়ের আবর্তে সেই সব আচার এখন আর কেউ পালন করে না।
সারা বছর টুকিটাকি মেরামতের কাজ থাকলেও ছকরবনদের কাজ থাকে না বর্ষায়। ফাল্গুন-চৈত্রে আবার যখন শণের ঘর তৈরির ধুম পড়ে, তখন কদর বেড়ে যায় ছকরবনদের।
একসময় গ্রামের প্রায় বাড়িতেই শণের ঘর ছিল। সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে গ্রামের চিত্র। শণের জায়গা দখলে নিয়েছে টিনের চালা। জহুরুলের ভাষায়, ‘আগে মাইনসের পাইসা আছলোনি। এখন পাইসা হইছে, বাড়িত টিন দেছে।’ ফলে কাজ কমে গেছে ছকরবনদের। জহুরুল বলেন, ‘দিনে দিনে ছকরবনের কাম উঠি যাচ্ছে।’
বিয়ের শুরুতেই ছকরবনের খাতায় নাম লেখান জহুরুল। এভাবে কেটে যায় ৩০টি বছর। এত দিন পর তাঁর স্ত্রী রাতেকা বানু যখন তাঁকে বলেন, ‘সবার কাম ফুরায়ে যাচ্ছে। ছকরবনের কাম শেষ। কী করি খাবেন?’ উত্তরে জহুরুল মলিন মুখে শুধুই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।
জহুরুল জানালেন তাঁর কষ্টের কথা। অন্যের ঘরের চালা ঠিক করে দিলেও তাঁর নিজের ভাঙা ঘরের চাল বেয়েই পানি পড়ে। তা সারাতে টাকার অভাবে শণ কিনতে পারেন না তিনি। জহুরুলের ঘরের চালা দেখে পাড়ার লোকেরা ঠাট্টা করে বলে, ‘ছকরবনের ভাঙ্গা টুহি।’
এরই মধ্যে নতুন ঘরের পুরো চালা ঢেকে যায় শণে। ছকরবন জহুরুল আর আজিজুর ব্যস্ত হয়ে পড়েন আপন কাজে। বাঁশ আর শণের সঙ্গে এভাবেই মিশে যায় ছকরবনদের দুঃখ-কষ্টগুলো।
সালেক খোকন
contact@ salekkhokon.me
No comments