কে এফ রুস্তামজির চোখে ১৯৭১-বেদনা ও রক্তপাতের গল্প কখনোই শেষ হয় না
শেষ পর্ব ২২ নভেম্বর বিএসএফের মহাপরিদর্শকের বাসভবনে মুখ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও বিভাগীয় কমিশনার মিলিত হন। রুস্তামজিও সেখানে ছিলেন। বিএসএফের মহাপরিদর্শক একটি টেলিফোন পেলেন, যাতে তাঁকে জানানো হয়, বনগাঁর বয়রায় দুটি পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।
দুজন পাইলট আটক হয়েছে, যাদের বয়স ২১-২২ বছরের মতো। পাইলটদ্বয়কে তাঁর অফিসে নিয়ে আসা হলো এবং ভালো ব্যবহার করা হলো। তাঁরা জানালেন, পাকিস্তান সরকার যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছে, তাতে তাঁরা অত্যন্ত সন্ত্রস্ত ছিলেন এবং আশঙ্কা করেছিলেন, ‘তাদের শরীর টুকরো টুকরো করে খাওয়া হবে।’
নভেম্বরের মধ্যে স্পষ্ট হয়, পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য। বিভিন্ন স্থানে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খাচ্ছিল। আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এটিকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ঘটানো। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হয় পাকিস্তানকে।
৩ ডিসেম্বরের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আমাদের বেশ কিছু বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায় ছিলেন। আমি গোলক মজুমদারকে বললাম, তাঁকে যেন খবরটি অতিসত্বর জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। গোলক ভাবলেন, জনসভার ভিড় ঠেলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। তিনি রাজভবনে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে খবরটি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে বললেন।’
রুস্তামজি আরও লিখেছেন, ‘আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানের পরিকল্পনা জানানো হয়। আমাদের বলা হলো, সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বের করে আনতে হবে এবং ছত্রভঙ্গ করে ছোট ছোট পকেটে নিয়ে যেতে হবে। আক্রমণ পরিচালনা করবেন মুক্তিযোদ্ধারা, বিএসএফ থাকবে সাহায্যকারীর ভূমিকায়। সীমান্তজুড়ে সেভাবেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। আমরা তাদের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে বলি। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় যখন আমরা অভিযান চালাই, তখন সামনে কোনো বাধাই লক্ষ করা যায়নি।’
লে. জেনারেল সাগত সিংয়ের বাহিনী পাকিস্তানি সেনানিবাসগুলোতে আক্রমণ চালায় এবং ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। জেনারেল মানেকশর কৌশল ছিল, সব পথে ঢাকার দিকে এগোতে থাকলে সুবিধা হবে। সব পথে বিএসএফ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পাশাপাশি সেনাবাহিনীও তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। মেজর জেনারেল দলবীর সিংহের নেতৃত্বে একটি ব্যাটালিয়ন যশোর ও খুলনায় চলে যায়। মেজর জেনারেল এল এস সেহালের নেতৃত্বে দুটি ব্যাটালিয়ন উত্তর থেকে এবং আরও দুটি ব্যাটালিয়ন দক্ষিণ দিক থেকে এগোতে থাকে।
রুস্তামজির পর্যবেক্ষণ হলো, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। এই যুদ্ধের ফলে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, পরে সিমলা শান্তি চুক্তির মাধ্যমে তারা মুক্তি পায়।’
সে সময়ের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যাও উঠে এসেছে রুস্তামজির লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তির বিরোধিতা সম্পর্কেও সজাগ ছিলেন।’ এ প্রসঙ্গে ইন্দিরার স্মরণীয় উক্তি ছিল, ‘পশ্চিমা মিত্ররা দাবি করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। কিন্তু গণতন্ত্র যখন ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন তাদের কণ্ঠ শুনতে পাই না।’ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বলেছিলেন, ‘এই বিজয় শুধু অস্ত্রের বিজয় নয়, এটি হলো আদর্শের বিজয়। স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ নামের পৃথক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রচণ্ড আবেগ ও ভালোবাসা না থাকলে মুক্তিবাহিনী এতটা সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারত না। যদি তাদের আদর্শের ব্যাপারে আমাদের সেনারা একমত না হতো, তাহলে তারাও নিঃশঙ্কচিত্তে লড়াই করতে পারত না।’
রুস্তামজি পাকিস্তানের যুদ্ধপরিকল্পনার ত্রুটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘প্রথমেই বিমান হামলা ছিল তাদের জন্য আত্মঘাতী। এর মাধ্যমে তারা “পূর্ব পাকিস্তানে” অভিযান চালাতে ভারতের জন্য একটি অজুহাত তৈরি করল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি বাহিনী যদি নদী বরাবর (পদ্মা) প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলত, তাহলে সাগত সিং এত কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারতেন না। তাতে হয়তো যুদ্ধ প্রলম্বিত হতো এবং বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেত।’
রুস্তামজি মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসের প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্রোহের সঙ্গে বিএসএফের যোগসূত্র খোঁজা ঠিক হবে না। কিন্তু এই যুদ্ধে বহু বাঙালি যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি করেছেন বিএসএফের সদস্যরাও। আমি মনে করি, গত নয় মাসে যে সংখ্যক বাঙালি মারা গেছে, তা গণনা করা সম্ভব নয়। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিস্তারিত বিবরণ আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে ব্যাপকসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অন্য নেতৃত্বস্থানীয় লোকদের হত্যা করা। আমরা দেশের ভেতর গিয়ে বহু গণকবরের সন্ধান পাই।’
তাঁর মতে, ‘যখন আমাদের সময়ের ইতিহাস শেখা হবে তখন আমি নিশ্চিত, বাঙালি কর্মকর্তা (মুক্তিযোদ্ধা) ও তাঁদের সহযোগীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। এবং সেটি ছিল ভারত ও বাংলাদেশ সহযোগিতার শুভসূচনা।’
এর পরই রুস্তামজি লিখেছেন, ‘কিন্তু আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কারও কারও শ্লেষ উক্তির কথা মনে রাখব। ভারতীয় পতাকাবাহী গাড়িতে যেতে যেতে তাঁরা বলেছিলেন, “কেন বাংলাদেশের একটি সেনাবাহিনী থাকতে হবে?” এবং কেউ কেউ অস্ত্রশস্ত্রও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দুই পক্ষের কিছু ক্ষুদ্রমনা লোকের কারণে মহান মৈত্রীর বন্ধন শিথিল হয়েছে।’
রুস্তামজি উপসংহারে লিখেছেন, ‘বিজয়ের পর ২২ ডিসেম্বরের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন, যাঁরা এপ্রিল থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।’ তিনি তাঁদের বদান্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তাঁরা কখনোই অভিযোগ করেননি, তাঁরা কখনোই কোনো কিছু চাননি, তাঁদের যা পাওয়ার কথা ছিল, তা পাননি বলে আক্ষেপ করেননি।’
দমদমে তাজউদ্দীন আহমদকে বিদায় জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, “আশা করি আমাদের বন্ধুত্ব অমর হবে।” তাজউদ্দীন আহমদ জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। আমিও তাই মনে করি”।’
সবশেষে রুস্তামজি তাজউদ্দীনের সঙ্গে দুই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর আলোচনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি মনে করতেন, পারস্পরিক নির্ভরতাই বন্ধুত্বকে স্থায়ী করতে পারে।
স্বাধীনতার পর রুস্তামজি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখে বলেছেন, ‘তুমিই সেই রুস্তামজি যাঁর নাম আমি বহুবার শুনেছি?’
রুস্তামজি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব না নিলে বাঙালির প্রতিরোধ আন্দোলন এভাবে সফল হতো না। তাঁর ভাষায়, তাজউদ্দীন ছিলেন একজন হতভাগ্য মানুষ। স্বাধীনতার পর মুজিব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো দিন তাঁর কাছে জানতে চাননি, সেই জটিল ১০ মাস তিনি কীভাবে কাজ করেছেন। জেলখানায় মুজিব নগর সরকারের অপর তিন সহকর্মীসহ তাজউদ্দীন আহমদের নিহত হওয়ার ঘটনাও রুস্তামজিকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।
রুস্তামজি চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সার্কিট হাউসেও এক বিকেল কাটান, যে কক্ষে জিয়া ১৯৮১ সালে নিহত হন সেই কক্ষেই তাঁরা পুরোনো স্মৃতিচারণা করেছিলেন। সেদিন সেই আলোচনায় ছিলেন একাত্তরের বিজয়ী বীরেরা। রুস্তামজির ভাষায়, ‘গল্প কখনোই শেষ হয় না। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশ সব সময় একটি মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যে দেশটি তার জন্মমুহূর্তে অপরিসীম বেদনা ও অভূতপূর্ব রক্তপাত প্রত্যক্ষ করেছে।’ [শেষ]
নভেম্বরের মধ্যে স্পষ্ট হয়, পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য। বিভিন্ন স্থানে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খাচ্ছিল। আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এটিকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ঘটানো। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হয় পাকিস্তানকে।
৩ ডিসেম্বরের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আমাদের বেশ কিছু বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায় ছিলেন। আমি গোলক মজুমদারকে বললাম, তাঁকে যেন খবরটি অতিসত্বর জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। গোলক ভাবলেন, জনসভার ভিড় ঠেলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। তিনি রাজভবনে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে খবরটি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে বললেন।’
রুস্তামজি আরও লিখেছেন, ‘আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানের পরিকল্পনা জানানো হয়। আমাদের বলা হলো, সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বের করে আনতে হবে এবং ছত্রভঙ্গ করে ছোট ছোট পকেটে নিয়ে যেতে হবে। আক্রমণ পরিচালনা করবেন মুক্তিযোদ্ধারা, বিএসএফ থাকবে সাহায্যকারীর ভূমিকায়। সীমান্তজুড়ে সেভাবেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। আমরা তাদের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে বলি। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় যখন আমরা অভিযান চালাই, তখন সামনে কোনো বাধাই লক্ষ করা যায়নি।’
লে. জেনারেল সাগত সিংয়ের বাহিনী পাকিস্তানি সেনানিবাসগুলোতে আক্রমণ চালায় এবং ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। জেনারেল মানেকশর কৌশল ছিল, সব পথে ঢাকার দিকে এগোতে থাকলে সুবিধা হবে। সব পথে বিএসএফ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পাশাপাশি সেনাবাহিনীও তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। মেজর জেনারেল দলবীর সিংহের নেতৃত্বে একটি ব্যাটালিয়ন যশোর ও খুলনায় চলে যায়। মেজর জেনারেল এল এস সেহালের নেতৃত্বে দুটি ব্যাটালিয়ন উত্তর থেকে এবং আরও দুটি ব্যাটালিয়ন দক্ষিণ দিক থেকে এগোতে থাকে।
রুস্তামজির পর্যবেক্ষণ হলো, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। এই যুদ্ধের ফলে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, পরে সিমলা শান্তি চুক্তির মাধ্যমে তারা মুক্তি পায়।’
সে সময়ের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যাও উঠে এসেছে রুস্তামজির লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তির বিরোধিতা সম্পর্কেও সজাগ ছিলেন।’ এ প্রসঙ্গে ইন্দিরার স্মরণীয় উক্তি ছিল, ‘পশ্চিমা মিত্ররা দাবি করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। কিন্তু গণতন্ত্র যখন ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন তাদের কণ্ঠ শুনতে পাই না।’ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বলেছিলেন, ‘এই বিজয় শুধু অস্ত্রের বিজয় নয়, এটি হলো আদর্শের বিজয়। স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ নামের পৃথক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রচণ্ড আবেগ ও ভালোবাসা না থাকলে মুক্তিবাহিনী এতটা সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারত না। যদি তাদের আদর্শের ব্যাপারে আমাদের সেনারা একমত না হতো, তাহলে তারাও নিঃশঙ্কচিত্তে লড়াই করতে পারত না।’
রুস্তামজি পাকিস্তানের যুদ্ধপরিকল্পনার ত্রুটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘প্রথমেই বিমান হামলা ছিল তাদের জন্য আত্মঘাতী। এর মাধ্যমে তারা “পূর্ব পাকিস্তানে” অভিযান চালাতে ভারতের জন্য একটি অজুহাত তৈরি করল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি বাহিনী যদি নদী বরাবর (পদ্মা) প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলত, তাহলে সাগত সিং এত কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারতেন না। তাতে হয়তো যুদ্ধ প্রলম্বিত হতো এবং বৃহৎ শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেত।’
রুস্তামজি মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসের প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্রোহের সঙ্গে বিএসএফের যোগসূত্র খোঁজা ঠিক হবে না। কিন্তু এই যুদ্ধে বহু বাঙালি যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি করেছেন বিএসএফের সদস্যরাও। আমি মনে করি, গত নয় মাসে যে সংখ্যক বাঙালি মারা গেছে, তা গণনা করা সম্ভব নয়। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিস্তারিত বিবরণ আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে ব্যাপকসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অন্য নেতৃত্বস্থানীয় লোকদের হত্যা করা। আমরা দেশের ভেতর গিয়ে বহু গণকবরের সন্ধান পাই।’
তাঁর মতে, ‘যখন আমাদের সময়ের ইতিহাস শেখা হবে তখন আমি নিশ্চিত, বাঙালি কর্মকর্তা (মুক্তিযোদ্ধা) ও তাঁদের সহযোগীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। এবং সেটি ছিল ভারত ও বাংলাদেশ সহযোগিতার শুভসূচনা।’
এর পরই রুস্তামজি লিখেছেন, ‘কিন্তু আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কারও কারও শ্লেষ উক্তির কথা মনে রাখব। ভারতীয় পতাকাবাহী গাড়িতে যেতে যেতে তাঁরা বলেছিলেন, “কেন বাংলাদেশের একটি সেনাবাহিনী থাকতে হবে?” এবং কেউ কেউ অস্ত্রশস্ত্রও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দুই পক্ষের কিছু ক্ষুদ্রমনা লোকের কারণে মহান মৈত্রীর বন্ধন শিথিল হয়েছে।’
রুস্তামজি উপসংহারে লিখেছেন, ‘বিজয়ের পর ২২ ডিসেম্বরের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন, যাঁরা এপ্রিল থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।’ তিনি তাঁদের বদান্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তাঁরা কখনোই অভিযোগ করেননি, তাঁরা কখনোই কোনো কিছু চাননি, তাঁদের যা পাওয়ার কথা ছিল, তা পাননি বলে আক্ষেপ করেননি।’
দমদমে তাজউদ্দীন আহমদকে বিদায় জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, “আশা করি আমাদের বন্ধুত্ব অমর হবে।” তাজউদ্দীন আহমদ জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। আমিও তাই মনে করি”।’
সবশেষে রুস্তামজি তাজউদ্দীনের সঙ্গে দুই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর আলোচনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি মনে করতেন, পারস্পরিক নির্ভরতাই বন্ধুত্বকে স্থায়ী করতে পারে।
স্বাধীনতার পর রুস্তামজি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখে বলেছেন, ‘তুমিই সেই রুস্তামজি যাঁর নাম আমি বহুবার শুনেছি?’
রুস্তামজি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব না নিলে বাঙালির প্রতিরোধ আন্দোলন এভাবে সফল হতো না। তাঁর ভাষায়, তাজউদ্দীন ছিলেন একজন হতভাগ্য মানুষ। স্বাধীনতার পর মুজিব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো দিন তাঁর কাছে জানতে চাননি, সেই জটিল ১০ মাস তিনি কীভাবে কাজ করেছেন। জেলখানায় মুজিব নগর সরকারের অপর তিন সহকর্মীসহ তাজউদ্দীন আহমদের নিহত হওয়ার ঘটনাও রুস্তামজিকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।
রুস্তামজি চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সার্কিট হাউসেও এক বিকেল কাটান, যে কক্ষে জিয়া ১৯৮১ সালে নিহত হন সেই কক্ষেই তাঁরা পুরোনো স্মৃতিচারণা করেছিলেন। সেদিন সেই আলোচনায় ছিলেন একাত্তরের বিজয়ী বীরেরা। রুস্তামজির ভাষায়, ‘গল্প কখনোই শেষ হয় না। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশ সব সময় একটি মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যে দেশটি তার জন্মমুহূর্তে অপরিসীম বেদনা ও অভূতপূর্ব রক্তপাত প্রত্যক্ষ করেছে।’ [শেষ]
No comments