গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকল্প নেই-সমাবেশ ঠেকানোর অগণতান্ত্রিক চেষ্টা কেন?

'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ'- সরকারি দল ও বিরোধী দলের অঘোষিত রণপ্রস্তুতি দেখে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার এই পঙ্ক্তিটিই উচ্চারণ করতে হচ্ছে। বিরোধী দল একটি সমাবেশ করবে, আর তাকে ঠেকাতে গিয়ে সরকারি দলের নেতানেত্রীদের লাগামহীন কথাবার্তা, কর্মকাণ্ড জনমনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফেলেছে।


বাস মালিকরা দূরপাল্লার বাস চালানো বন্ধ করে দিয়ে অগণিত মানুষকে নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে। কয়েকটি রুটে লঞ্চ মালিকরাও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে অনেকে ঢাকায় এসে আটকে গেছেন, ফিরতে পারছেন না। আবার অনেকে জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে পারছেন না। এদিকে একজন প্রতিমন্ত্রীর অপরিচিত লোকজনকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণায় আতঙ্ক কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কে কার অপরিচিত এবং কে কাকে ধরিয়ে দেবে- সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখার মতো কথা বলার আগে কি তাঁরা একবারও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের দিকটি ভেবে দেখেছেন?
আমরা ভেবে পাই না, বিএনপির মহাসমাবেশ হলে কি এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো? তাতে কি আওয়ামী লীগের ক্ষমতা চলে যেত? তাহলে কেন আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা এই সমাবেশকে ঘিরে এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলছেন কিংবা উদ্ভট আচরণ করছেন? সমাবেশ করা তো বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার। তাতে বাধা দেওয়ার বিষয়টি দেশের কোনো নাগরিকই সমর্থন করবে না। তবে হ্যাঁ, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা যে নাশকতার আশঙ্কা করছেন- তাকেও আমরা ছোট করে দেখছি না। আমরাও চাই না, দেশে আবার কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক। কিন্তু সে জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ কর্মীদের দিয়ে তা মোকাবিলা করতে গেলে কিংবা পাল্টা কর্মসূচি নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যেতে পারে এবং হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকিই বেশি থাকবে। আর রাজনৈতিকভাবে সেটা কাম্যও নয়। এটা ঠিক, বিগত সময়ে কাকরাইল-বিজয়নগর এলাকায় জামায়াত-শিবিরের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা যেভাবে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কিংবা বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বাধা দেওয়ার অজুহাতে যেভাবে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল, সারা দেশে যানবাহনে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল এবং পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়েছিল, সেগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। সারা দেশের মানুষ তাদের সেসব কর্মকাণ্ড ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু এবার সরকারি দল আগাম অবান্তর কথাবার্তা বলে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড চালিয়ে জনগণের আবেগ বা সেন্টিমেন্টকে কেবল আহতই করেছে।
আসলে আমাদের রাজনীতির কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি, এই সত্যটাকেই নির্দেশ করে সরকারি ও বিরোধী দলের বর্তমান কর্মকাণ্ড। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা করবে- এই সত্যটিকেই মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। আর সে কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতি করা সত্ত্বেও বিএনপি বর্তমান সংসদকে মেনে নিতে পারেনি। তিন বছর ধরেই বিএনপির সংসদ সদস্যরা নানা অজুহাতে সংসদের অধিবেশন বর্জন করে চলেছেন। প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে 'টেনে নামানোর' লক্ষ্যে তাঁরা হরতালসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছেন। এটি একদিকে যেমন জনগণের ম্যান্ডেটকে অসম্মান করা, অন্যদিকে জনগণের অধিকারকেও অস্বীকার করার শামিল। সরকারি দলেরও উচিত, রাজনৈতিক পরিমিতিবোধের মধ্যে থাকা এবং সেভাবেই সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন করা কিংবা অসহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো স্বীকৃত পন্থা নয়।

No comments

Powered by Blogger.