বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৩৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। কাজী কামালউদ্দীন, বীর বিক্রম অনন্য সাহসী এক গেরিলা যোদ্ধা এই প্রতিবেদনের জন্য কাজী কামালউদ্দীনের কাছে তথ্য জানতে ফোন করলেই বলতেন, ‘কী হবে আর লিখে? এই বাংলাদেশের জন্যতো আমি যুদ্ধ করিনি।
দেশ মানে কী শুধু পতাকা আর মাটি?’ ক্ষোভ প্রশমিত হলে বলতেন, ‘আমি এখন অসুস্থ। অনেকে লিখেছে। সেসব দেখে তুমি একটা কিছু লিখে দাও।’ সাহসী গেরিলা যোদ্ধা কাজী কামালউদ্দীন কয়েক দিন আগে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন। নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।
কাজী কামালউদ্দীন ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডিতে গেরিলা অপারেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সেই অপারেশনের বর্ণনা আছে হাবিবুল আলমের (বীর প্রতীক) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘...২৮ নম্বরে (ধানমন্ডি) গিয়ে প্লান করলাম একটা অ্যাকশন করা দরকার খুব সিরিয়াস টাইপের এবং ইট শ্যুড রিয়েলি বদার দ্য আর্মি। এ প্লানটা করতে গিয়ে ঠিক করলাম যে, দলের সদস্য সংখ্যা ছয়জনের বেশি হবে না। কাজী (কাজী কামালউদ্দীন), বদি, স্বপন, জুয়েল, রুমি এবং আমি। পাকিস্তান আর্মির মনোবলে চিড় ধরাবার জন্য এই অ্যাকশনের পরিকল্পনা।
‘২০ নম্বর রোডে চাইনিজ অ্যামবেসির সামনে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ থাকত। ১৮ নম্বর রোডে জাস্টিস আবদুল জব্বার খানের বাসার পাশের বাসার সামনে ৮-১০ জন পাকিস্তানি সেনা দাঁড়িয়ে থাকত।
‘আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে সকাল থেকে আমরা খুব ওরিড এবং আপসেট ছিলাম। কারণ এবার আমাদের টার্গেট ছিল অ্যাটাক অন দ্য মুভ। খুবই বিপদজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বাট ইট ক্যান পে ব্যাক কোয়াইট এ লট। অপারেশনের জন্য গাড়ি দরকার। গাড়ি ম্যানেজ করার ভার পড়ল আমার ও বদির ওপর।
‘আমরা সাদা মাজদা গাড়ি নিয়ে এলাম। মাজদা রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ গাড়ি। ঠিক হলো আমি স্টিয়ারিং হুইলটি নেব। আমার অস্ত্র যাবে বদির হাতে। স্বপন বসবে ঠিক আমার পেছনে। কাজী বসবে পেছনে আরেক পাশে। রুমি মাঝখানে। বদি সামনে।
‘গাড়ি নিয়ে যখন ২০ নম্বরের সামনে গেলাম, দেখলাম নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে কোনো পুলিশ বা পাকিস্তানি ফোর্স নেই। ওই চাইনিজ অ্যামবেসির সামনে! আমরা গাড়ি টার্ন করে ১৮ নম্বরে ঢুকলাম। জাস্টিস জব্বার খানের আগের বাড়িটিতে দেখলাম প্রায় আটজন পাকিস্তান আর্মি বসে আড্ডা মারছে। কেউ দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে টার্ন নিলাম। কাজী ও বদিকে ফায়ার করতে বলা হলো। আটজনই পড়ে গেল। আমরা খুব আনন্দিত হলাম যে, এত সহজে আটজন শেষ!
‘৭ নম্বর দিয়ে বেরিয়ে পাঁচ নম্বরের সামনে আসতেই দেখি সামনে লাইন ধরে পাকিস্তান আর্মির গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মানে চেক হচ্ছে। আমরা কিছুটা চিন্তিত, নার্ভাস এবং উত্তেজিত। রাস্তাটা পুরো কর্ডন করা। ওরা গাড়িটাকে থামাতে বলল। আমি প্রথমে ডান দিকে পরে ডান দিকে টার্ন নিলাম। বদি, কাজী ও স্বপন ফায়ার ওপেন করল। এখানে যারা ছিল একজনও যদি বাঁচত! আমার যতদূর মনে হয় একজনও বাঁচেনি।’
কাজী কামালউদ্দীন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি বাস্কেট বলও খেলতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে ভারতের মেলাঘরে যান। সেখানে তাঁদেরসহ ঢাকার আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করা হয় ক্র্যাক প্লাটুন। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে গেরিলা অপারেশন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য কাজী কামালউদ্দীনকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৬। তাঁর প্রকৃত নাম কাজী কামালউদ্দীন আহমেদ।
কাজী কামালউদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার সাকাশ্বর গ্রামে। তবে বসবাস করতেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম কাজী রইসউদ্দীন আহমেদ, মা সুরাইয়া বেগম। স্ত্রী খাদিজা কামাল। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: শহীদ শাফী ইমাম রুমী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা ২০১০, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
কাজী কামালউদ্দীন ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডিতে গেরিলা অপারেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সেই অপারেশনের বর্ণনা আছে হাবিবুল আলমের (বীর প্রতীক) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘...২৮ নম্বরে (ধানমন্ডি) গিয়ে প্লান করলাম একটা অ্যাকশন করা দরকার খুব সিরিয়াস টাইপের এবং ইট শ্যুড রিয়েলি বদার দ্য আর্মি। এ প্লানটা করতে গিয়ে ঠিক করলাম যে, দলের সদস্য সংখ্যা ছয়জনের বেশি হবে না। কাজী (কাজী কামালউদ্দীন), বদি, স্বপন, জুয়েল, রুমি এবং আমি। পাকিস্তান আর্মির মনোবলে চিড় ধরাবার জন্য এই অ্যাকশনের পরিকল্পনা।
‘২০ নম্বর রোডে চাইনিজ অ্যামবেসির সামনে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ থাকত। ১৮ নম্বর রোডে জাস্টিস আবদুল জব্বার খানের বাসার পাশের বাসার সামনে ৮-১০ জন পাকিস্তানি সেনা দাঁড়িয়ে থাকত।
‘আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে সকাল থেকে আমরা খুব ওরিড এবং আপসেট ছিলাম। কারণ এবার আমাদের টার্গেট ছিল অ্যাটাক অন দ্য মুভ। খুবই বিপদজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বাট ইট ক্যান পে ব্যাক কোয়াইট এ লট। অপারেশনের জন্য গাড়ি দরকার। গাড়ি ম্যানেজ করার ভার পড়ল আমার ও বদির ওপর।
‘আমরা সাদা মাজদা গাড়ি নিয়ে এলাম। মাজদা রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ গাড়ি। ঠিক হলো আমি স্টিয়ারিং হুইলটি নেব। আমার অস্ত্র যাবে বদির হাতে। স্বপন বসবে ঠিক আমার পেছনে। কাজী বসবে পেছনে আরেক পাশে। রুমি মাঝখানে। বদি সামনে।
‘গাড়ি নিয়ে যখন ২০ নম্বরের সামনে গেলাম, দেখলাম নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে কোনো পুলিশ বা পাকিস্তানি ফোর্স নেই। ওই চাইনিজ অ্যামবেসির সামনে! আমরা গাড়ি টার্ন করে ১৮ নম্বরে ঢুকলাম। জাস্টিস জব্বার খানের আগের বাড়িটিতে দেখলাম প্রায় আটজন পাকিস্তান আর্মি বসে আড্ডা মারছে। কেউ দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে টার্ন নিলাম। কাজী ও বদিকে ফায়ার করতে বলা হলো। আটজনই পড়ে গেল। আমরা খুব আনন্দিত হলাম যে, এত সহজে আটজন শেষ!
‘৭ নম্বর দিয়ে বেরিয়ে পাঁচ নম্বরের সামনে আসতেই দেখি সামনে লাইন ধরে পাকিস্তান আর্মির গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মানে চেক হচ্ছে। আমরা কিছুটা চিন্তিত, নার্ভাস এবং উত্তেজিত। রাস্তাটা পুরো কর্ডন করা। ওরা গাড়িটাকে থামাতে বলল। আমি প্রথমে ডান দিকে পরে ডান দিকে টার্ন নিলাম। বদি, কাজী ও স্বপন ফায়ার ওপেন করল। এখানে যারা ছিল একজনও যদি বাঁচত! আমার যতদূর মনে হয় একজনও বাঁচেনি।’
কাজী কামালউদ্দীন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি বাস্কেট বলও খেলতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে ভারতের মেলাঘরে যান। সেখানে তাঁদেরসহ ঢাকার আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করা হয় ক্র্যাক প্লাটুন। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে গেরিলা অপারেশন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য কাজী কামালউদ্দীনকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৬। তাঁর প্রকৃত নাম কাজী কামালউদ্দীন আহমেদ।
কাজী কামালউদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার সাকাশ্বর গ্রামে। তবে বসবাস করতেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম কাজী রইসউদ্দীন আহমেদ, মা সুরাইয়া বেগম। স্ত্রী খাদিজা কামাল। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: শহীদ শাফী ইমাম রুমী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা ২০১০, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments