চারদিক-সেবকনিবাস by আকমল হোসেন

মৌলভীবাজার-শমশেরনগর সড়কের মাতারকাপন এলাকার চক্ষু হাসপাতালের পূর্বদিকের দক্ষিণমুখী রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের ডানদিকে চোখে পড়ে একটি পুকুর। সেই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে একটি দ্বিতল ভবন। ওই ভবনের পাশ দিয়ে আরেকটু সামনে এগোলেই চোখের সামনে খুলে যায় ভিন্ন এক উদ্যান।


বিশাল উঠোনজুড়ে সারি সারি ফুলের বাগান। গোলাপ, গাঁদা, রঙ্গন—আরও অনেক মৌসুমি ফুল। সবুজ চিকন-গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুলগুলো রোদে চকচক করছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে। মন কেমন এক ভালো লাগায় ভরে ওঠে। যে কেউ ভাবতেই পারেন, এটি হয়তো কারও কোনো শৌখিন বাগানবাড়ি।
ফুলবাগানের পশ্চিম দিকে একটি ও দক্ষিণ দিকে একটি টিনশেডের পাকা দালান এবং পূর্বদিকে দ্বিতল ভবন। সেই দালানগুলোতে অনেক মানুষের বাস। এদের সঙ্গে কথা বলার পরই হয়তো ভুল ভাঙবে। এটি কোনো শখের বাগানবাড়ি নয়। এখানে একদল মানুষ থাকে। যাদের কাজ হচ্ছে শহর নোংরা-আবর্জনামুক্ত রেখে মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখা। রাত গভীর হতে থাকলেই এরা শহরের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঝাড়ু হাতে ছড়িয়ে পড়ে। কোথায় কোথায় ময়লা জমেছে, তা ঝেড়েমুছে ভাগাড়ে নিয়ে ফেলে। আর তখনই হয়তো ধারণাটা পাল্টাতে থাকবে—সুইপারপল্লি বা ধাঙড়পল্লি বলতে গা ঘিনঘিন করা একধরনের ভাপসা গন্ধময় পরিবেশের সঙ্গে এত দিনের যে পরিচয়, এ স্থানটি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর এ পল্লিটির নামও ভিন্ন—সেবক নিবাস। এখানে যারা থাকে, তাদের পরিচিতিটাও আর সুইপার নয়—সেবক।
সেবকনিবাসের বাসিন্দা শুকলাল বাসফর (৫৫) বললেন, ‘এখানে থাকার পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক ভালো। সুন্দর পরিবেশে আছি আমরা। আগের জায়গায় মাছি আর মাছি ছিল। গন্ধে থাকা যাইত না। এখন ঘরের বারান্দায় বসে খাওয়া যায়। টয়লেট পরিষ্কার। আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু এ রকম কোথাও থাকার জায়গা দেখিনি।’ চন্দ্রা বাসফরও (২৫) একই কথা বললেন, ‘এক বছর অইল আছি। আগের চেয়ে অনেক ভালো।’ আলাপ করে জানা গেছে, প্রায় চার একর জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে এই সেবকনিবাস। এখানে এ পর্যন্ত একটি দ্বিতল ভবন ও তিনটি টিনশেডের দালান আছে। এতে ৩২টি পরিবার বসবাস করছে। লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই শ। এখানে বিদ্যুৎ আছে। পানির ব্যবস্থা আছে। এরা আগে মৌলভীবাজার শহরের ক্লাব রোডসহ বিভিন্ন স্থানে থাকত। একদম ঘিঞ্জি জায়গা ছিল। একজনের শ্বাস পড়ত আরেকজনের ওপর। এখনো শহরে ২০-২৫ পরিবার আছে। পর্যায়ক্রমে তাদেরও সেবকনিবাসে নিয়ে আসা হবে। এ জন্য আরও একটি ভবন তৈরি করা হবে। হরিজনদের নেতা ও সেবকনিবাসের বাসিন্দা কান্তিলাল বাসফর (৫৮) বলেন, ‘আমরা এখন ভালো ও সুন্দর পরিবেশে আছি। এখানে মদ, গাঁজা বেচাবিক্রি হয় না।’ দেখা গেছে, খালি জায়গায় মৌসুমি সবজির চাষও করেছে অনেকে। বাঁধাকপি, টমেটো, মুলা, এটা-ওটা সেই সবজি খেতে।
এই সেবকনিবাসের শিশুদের পড়ালেখার জন্য একটি স্কুল আছে। মহিলাদের জন্য আছে সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কেন্দ্রের প্রশিক্ষক মুকুল বাসফর (৭০) বললেন, ‘এই সেবকনিবাস হওয়ায় অনেক লাভ হইছে। আগে এ সুযোগ ছিল না। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আমিই প্রশিক্ষণ দিই। স্কুলে পোলাপানরা শিখতে পারছে।’ স্কুলের শিক্ষিকা চঞ্চলা বাসফর (২২) জানালেন, চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের এখানে পড়ালেখা করানো হচ্ছে। তবে তিনি বললেন, ‘খাতা ও কলমের জন্য আমাদের কষ্ট হয়। আমাদের পক্ষে সব সময় তা কিনে আনা সম্ভব হয় না।’
জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট এ সেবকনিবাসটি উদ্বোধন করা হয়। মৌলভীবাজার পৌরসভার উদ্যোগে এ সেবকনিবাসটি তৈরি হয়েছে। পৌর মেয়র ফয়জুল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এরা সমাজের নিচুস্তরের মানুষ। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে। নোংরা, ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকত। থাকার জায়গা ছিল না। আমরা উদ্যোগ নিয়ে এই সেবকনিবাস গড়ে তুলেছি। এখানে তারা সমাজের আর দশজনের মতো থাকতে পারছে। এই পরিবেশ তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। বাংলাদেশের আর কোথাও এ রকম কোনো সেবকনিবাস নেই। আমরাই প্রথম এ রকম একটা উদ্যোগ নিয়েছি।’
শহর থেকে বাইরে গড়ে তোলা এই সেবকনিবাস সমাজের নিচুতলার মানুষ বলে পরিচিত লোকগুলোকে একটা সুন্দর আশ্রয় দিলেও কিছু কষ্টও তৈরি করেছে। তারা জানাল, প্রতিদিন শহরে নিজের টাকায় আসা-যাওয়া করতে হয়। এতে ৩০-৪০ টাকা খরচ হয়ে যায়। দুই হাজার টাকা বেতন থেকে এই টাকা চলে গেলে অনেক টানাটানিতে পড়তে হয় তাদের। শহরে যাওয়া-আসার ব্যবস্থাটা পৌর কর্তৃপক্ষ করে দিলে তাদের অনেক উপকার হয়। শহরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ যাদের, তারা এখন ফুলের গন্ধে বাস করে। আয়োজনটি ছোট পরিসরে এবং ক্ষুদ্র হলেও কোথাও যেন প্রচলিত চিন্তায় বড় একটা পরিবর্তনেরই আভাস। উঁচু আর নিচু বলে কোনো ভেদ নেই, হয়তো সবাই মানুষ—একদিন এ ধারণাটা এখানেও বড় হয়ে ধরা দেবে।
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.