রাজনীতি-হরতাল এবং তরুণ সমাজ by মোহীত উল আলম
শিক্ষকেরা সম্ভবত তরুণদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবেন। হরতাল এলেই বেশির ভাগ শিক্ষক ভ্রু কুঞ্চিত করেন। কারণ, তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা আবার না পড়ার গাড্ডায় পড়ে যাবে। না পড়তে পড়তে তারা জ্ঞানবিমুখ হবে। তাদের মধ্যে তুলনামূলক চিন্তার বিকাশ লাভ করবে না। তারা ভাববে না, পড়াটাই বুঝি মানবজীবনের ধর্ম, না জানাটাই বুঝি আসল কথা।
হরতাল দেনেওয়ালাদের প্রতি একজন শিক্ষক হিসেবে আমার বিনীত আবেদন, হরতাল চলুক, ঠিক আছে, কিন্তু সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত খোলা থাকুক। এটা কি বলা যায় না যে, বিশেষ একটি সমীকরণ থেকে, অর্থাৎ মৌলিক অধিকার প্রয়োগের দিক থেকে, একজন রিকশাওয়ালা ও একজন শিক্ষার্থীর (শিক্ষার্থী বলতে শিক্ষককেও বোঝাচ্ছি। কারণ, একজন শিক্ষকও একজন শিক্ষার্থী বটে) মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একজন রিকশাওয়ালা যদি তাঁর দিনাতিপাতের জন্য হরতালের সময় রিকশা চালাতে পারেন, সেই একই অনুপাতে একজন শিক্ষার্থীর আহার হচ্ছে তার জ্ঞানার্জন। সে কেন তার আহার থেকে বঞ্চিত হবে? রিকশা চালনা যদি নাগরিক অধিকার হিসেবে রিকশাওয়ালার মৌলিক অধিকার হয়, তা হলে একজন শিক্ষার্থীর রাইট টু এডুকেশন বা শিক্ষা গ্রহণের অধিকারও তার মৌলিক অধিকার। সে কেন তার স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়তে পারবে না? হরতাল দেনেওয়ালারা যদি রিকশাওয়ালার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেন, তা হলে তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকারও নিশ্চিত করা। এই অনুরোধ করা যায় কি না যে, দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থাকে হরতালমুক্ত করুন।
একজন রিকশাওয়ালার দিনাতিপাত পরিশ্রম হচ্ছে তাঁর নিজের ও পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। তাঁর কাজের পরিণতি ওই ক্ষুন্নিবৃত্তির মধ্যেই শেষ। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান আহরণ পর্ব তার নিজের জন্য তো বটেই, দেশের জন্য ও ভবিষ্যতের জন্যও কার্যকর। অন্য যেকোনো ক্ষতির চেয়ে শিক্ষার ক্ষতিটা সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী। আমাদের প্রতিটি বর্তমান হরতাল ভবিষ্যতের বৃহত্তর হরতালের পটভূমি তৈরি করে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিটি বর্তমান হরতাল, আজকের শিক্ষার্থী-প্রজন্মের জন্য জ্ঞানার্জনের পথে যে বাধার সৃষ্টি করল, সেটাই ভবিষ্যতে সাহারা মরুভূমির মতো জ্ঞানহীন পরিবেশের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ যে নানাভাবে পিছিয়ে আছে, তার বড় কারণ হলো শিক্ষাবিহীনতা। আজকে আমরা কথায় কথায় বলি, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিচ্ছু জানে না...না জানে বাংলা, না জানে ইংরেজি, না জানে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, এমনকি আচার-আচরণও জানে না। অথচ আমরা যদি হিসাব করি, আজকের শিক্ষার্থী-প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে আসা পর্যন্ত কতটা দিন নষ্ট করেছে হরতালের জন্য, তাহলে বুঝতে পারব তাদের জ্ঞানের খামতি কেন হচ্ছে।
আমরা নারী নির্যাতনের কথা বলি; বিশেষ করে, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা বলি, এবং এটাও জানি যে, কম-বেশি শতকরা ৮০টি পরিবারের এই অবস্থা, যেখানে স্ত্রী বা মা নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। ঠিক সেভাবে আমি বলতে চাই, হরতাল হচ্ছে শিক্ষার্থী নির্যাতনের একটি পন্থা। কেমন করে এ তুলনাটা মনে এল সেটা বলি। মৌচাকে ঢিল নামক মাসিকটির জুলাই ২০১১ সংখ্যায় একজন পাঠকের একটি চিঠি পড়ে জানলাম, তাঁর বাবা তাঁর মায়ের ওপর এত অত্যাচার করতেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর মা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর বাবাকে চিকিৎসার কথা বললে তিনি বললেন, ‘আমার হাতে টাকা-পয়সা নেই। তোর মাকে বল বাবার বাড়িতে চলে যেতে।’ আমিও আমার খুব কাছের কয়েকটি পরিবারকে লক্ষ করে দেখেছি, যেখানে স্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার পর একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বা নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। তখন স্বামীপ্রবর বলে বেড়ান যে, কী করব ভাই, জীবনে শান্তি নেই। বউটা অসুস্থ, মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হয়।
ঠিক একই অবস্থা হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। হরতালে হরতালে তাদের মাজা ভাঙার ব্যবস্থা আমরাই করি, আর পরে মন্তব্য করতে থাকি যে, এখনকার প্রজন্ম কিচ্ছু জানে না। বাচ্চাকে যদি বাটার আর চিজ খাইয়ে মোটা করতে থাকেন, তারপর যদি বলেন যে, আমার বাচ্চাটা কেন এত মোটা হলো জানি না, তা হলে কী করে হবে। ওই মোটা বাচ্চার বাবা বাচ্চার মাকে হয়তো বলছেন, দেখো তো, অমুকের বাচ্চাটা কত সুন্দর, পাতলা-পুতলা, দৌড়ঝাঁপ করছে।
রাজনীতিতে শ্রেণী কথাটা খুব জনপ্রিয়। ওই শ্রেণী ধরেই হরতালকে দেখার আরেকটা প্রেক্ষাপট তৈরি হলো। আমরা সবাই জানি, রাজনৈতিক এলিট এবং নেতা যাঁরা হরতাল দেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ছেলেমেয়ে বাংলাদেশে পড়ে না, পড়লেও এমন ব্যবস্থায় তারা আছে যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলেও তারা ঘরে বসেই লেখাপড়ার উপকরণ-সমৃদ্ধ থাকতে পারে। অর্থাৎ, বাসার পাঠাগার, বই, ইন্টারনেট, পেনড্রাইভ, মডেম, প্রিন্টার—সব তাদের ধনিক বা সচ্ছল পরিবারের ঘরের গণ্ডিতে প্রাপ্তব্য হবে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ, আইটি ব্যবহারের সুযোগ বা স্কুলের কেবল বেঞ্চিটিতে বসতে পারাও অনেক সময় একটি পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার চোখ খুলে গেছিল যখন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন, একবার মুহসীন হলে আমার এক সহপাঠী ডাইনিং হলে ক্রোধান্বিত হয়ে একটি কাচের প্লেট ছুড়ে ভেঙে ফেলেছিল। পরে আমাকে আরেক সহপাঠী, যে কিনা তার একই গ্রামের ছেলে, জানিয়েছিল যে ওই প্লেট ছোড়া ছেলেটার দেশের বাড়ির অবস্থা এত খারাপ যে, তাকে মাটিতে বসে সানকিতে করে ভাত খেতে হয়। ওই সহপাঠী মেধার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। পাকা ভবনে থাকার অভিজ্ঞতা তার ওই প্রথম। চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়াও।
তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে দরিদ্র জনগণের শিক্ষা লাভ করার একটা দরজা খোলা থাকে, সেটা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হলে ওই গরিব ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। অর্থাৎ শ্রেণীগতভাবে দেখলে হরতাল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীকুলকে যতটা ক্ষতি করে, হরতাল ডাকনেওয়ালাদের পরিবারের সন্তানাদির শিক্ষার ততটা ক্ষতি করে না। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি, প্যারাডক্সিকালি, হরতাল অস্ত্র হিসেবে একটি স্বার্থবাদী অস্ত্র, এবং দরিদ্র শিক্ষার্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটা ব্যবহূত হচ্ছে। আরও কৌশলীভাবে, শ্রেণীগত চৈতন্য নিয়ে বললে বলতে হয়, হরতাল হচ্ছে খুব সুকৌশলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও দরিদ্র করে রাখার একটি উপায়।
কেউ কেউ বলতে পারেন, জ্ঞানার্জনের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকা না-থাকার সম্পর্ক কী! মানুষ বনে বা গুহায় বসেও তো জ্ঞানার্জন বা গবেষণা করতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল তো স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। আমি কিছুদিন আগে রবীন্দ্রবিষয়ক একটি কলামে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম যে আজকের দিনে হলে তাঁরা সবাই স্কুল, কলেজ বা চাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিও পার হতেন। ঠিক সে রকম অনেক রিকশাওয়ালার ছেলে বা মেয়ে অতীব দরিদ্র সত্ত্বেও যে জিপিএ-৫ পায়, সেটাও ব্যতিক্রম। আমি ব্যতিক্রমী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ লেখা লিখছি না। কথা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার অন্যতম উপকরণ। একজনকে শিশু বয়স থেকে পরিণত বয়সে এনে শিক্ষিত করে পৃথিবীর পথে ছেড়ে দেওয়াটাই হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব।
আমাদের শিক্ষার্থীরা যে কেবল নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে, তা তো নয়। তারা অন্যান্য দেশের সমপর্যায়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। প্রযুক্তির বিশ্বায়নের যুগে কেউ যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের পথে এক মুহূর্ত থেমে থাকতে বলে বা থামাতে চায়, তাহলে সেখানে আমাদের প্রতিবাদ রইল। কারণ, এর ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করার রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি।
সমাজে বিকল্পভাবে সময় কাটানোর কোনো অভাব নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি অনির্ধারিতভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন চঞ্চল তরুণ সমাজ যে বই নিয়ে বাসায় পড়তে বসবে, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা করবে কি, রাস্তার মোড়ে গিয়ে দল বেঁধে আড্ডা দেবে, কিংবা তাস খেলবে, কিংবা ওয়েবসাইটে গিয়ে নানা রকম ছবি দেখবে। আর কেউ কেউ হয়তো নিছক ঘুমাবে। আরও কেউ কেউ হয়তো অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ, তারা গঠনমূলক কোনো কাজে ব্যাপৃত থাকবে না। সেটা তাদের নিজেদের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি।
তবে হরতালের আঘাতের মূল জায়গাটা আরও নির্মম। হরতাল কর্মসূচি আক্ষরিক অর্থে কার্যকর করতে প্রয়োজন হয় সেই যুবশক্তির, যারা রাস্তায় পিকেটিং করতে পারবে, পুলিশের সঙ্গে কিক-বক্সিং খেলতে পারবে। তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কর্মী—যাদের অনেকে নানা পেশার লোক বা নিছক বেকার হলেও বেশির ভাগ হলো ছাত্রছাত্রী, যারা কোনো একটা ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। হরতাল দেনেওয়ালাদের এই যুবশক্তিটা খুব কাজে লাগে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারা হলো মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু এখানেও একটা বুমেরাংয়ের মতো ব্যাপার আছে, সেটা হলো যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের চোখে তারা হলো অশুয়া গোত্র। এ জন্য তাদের লাঠিপেটা করা, গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে পুলিশের মধ্যে অতি উৎসাহ লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, ক্ষমতার বাইরে থাকলে পিকেটারদের প্রয়োজন, আর ক্ষমতায় থাকলে তাদের দমন করা প্রয়োজন।
এই যুব পিকেটারদের বয়স ও শিক্ষার স্তর দেখে বলা যায়, এরাও যেকোনো উদ্দেশ্য ছাড়া পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে তা নয়। তাদেরও নানা রকমের স্বার্থবুদ্ধি কাজ করে। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ, সাংঘর্ষিক, পিচ্ছিল ও ক্ষমতার রাজনীতির পথে তাদের হয় হাতেখড়ি। তাদের ক্ষমতাশীল দল ও বিরোধী দলগুলো নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। তবে লক্ষ করার ব্যাপার হলো, তারা অনেকেই পরবর্তী সময়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে পরিণত হয়।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
একজন রিকশাওয়ালার দিনাতিপাত পরিশ্রম হচ্ছে তাঁর নিজের ও পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। তাঁর কাজের পরিণতি ওই ক্ষুন্নিবৃত্তির মধ্যেই শেষ। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান আহরণ পর্ব তার নিজের জন্য তো বটেই, দেশের জন্য ও ভবিষ্যতের জন্যও কার্যকর। অন্য যেকোনো ক্ষতির চেয়ে শিক্ষার ক্ষতিটা সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী। আমাদের প্রতিটি বর্তমান হরতাল ভবিষ্যতের বৃহত্তর হরতালের পটভূমি তৈরি করে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিটি বর্তমান হরতাল, আজকের শিক্ষার্থী-প্রজন্মের জন্য জ্ঞানার্জনের পথে যে বাধার সৃষ্টি করল, সেটাই ভবিষ্যতে সাহারা মরুভূমির মতো জ্ঞানহীন পরিবেশের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ যে নানাভাবে পিছিয়ে আছে, তার বড় কারণ হলো শিক্ষাবিহীনতা। আজকে আমরা কথায় কথায় বলি, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিচ্ছু জানে না...না জানে বাংলা, না জানে ইংরেজি, না জানে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, এমনকি আচার-আচরণও জানে না। অথচ আমরা যদি হিসাব করি, আজকের শিক্ষার্থী-প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে আসা পর্যন্ত কতটা দিন নষ্ট করেছে হরতালের জন্য, তাহলে বুঝতে পারব তাদের জ্ঞানের খামতি কেন হচ্ছে।
আমরা নারী নির্যাতনের কথা বলি; বিশেষ করে, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা বলি, এবং এটাও জানি যে, কম-বেশি শতকরা ৮০টি পরিবারের এই অবস্থা, যেখানে স্ত্রী বা মা নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। ঠিক সেভাবে আমি বলতে চাই, হরতাল হচ্ছে শিক্ষার্থী নির্যাতনের একটি পন্থা। কেমন করে এ তুলনাটা মনে এল সেটা বলি। মৌচাকে ঢিল নামক মাসিকটির জুলাই ২০১১ সংখ্যায় একজন পাঠকের একটি চিঠি পড়ে জানলাম, তাঁর বাবা তাঁর মায়ের ওপর এত অত্যাচার করতেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর মা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর বাবাকে চিকিৎসার কথা বললে তিনি বললেন, ‘আমার হাতে টাকা-পয়সা নেই। তোর মাকে বল বাবার বাড়িতে চলে যেতে।’ আমিও আমার খুব কাছের কয়েকটি পরিবারকে লক্ষ করে দেখেছি, যেখানে স্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার পর একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বা নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। তখন স্বামীপ্রবর বলে বেড়ান যে, কী করব ভাই, জীবনে শান্তি নেই। বউটা অসুস্থ, মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হয়।
ঠিক একই অবস্থা হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। হরতালে হরতালে তাদের মাজা ভাঙার ব্যবস্থা আমরাই করি, আর পরে মন্তব্য করতে থাকি যে, এখনকার প্রজন্ম কিচ্ছু জানে না। বাচ্চাকে যদি বাটার আর চিজ খাইয়ে মোটা করতে থাকেন, তারপর যদি বলেন যে, আমার বাচ্চাটা কেন এত মোটা হলো জানি না, তা হলে কী করে হবে। ওই মোটা বাচ্চার বাবা বাচ্চার মাকে হয়তো বলছেন, দেখো তো, অমুকের বাচ্চাটা কত সুন্দর, পাতলা-পুতলা, দৌড়ঝাঁপ করছে।
রাজনীতিতে শ্রেণী কথাটা খুব জনপ্রিয়। ওই শ্রেণী ধরেই হরতালকে দেখার আরেকটা প্রেক্ষাপট তৈরি হলো। আমরা সবাই জানি, রাজনৈতিক এলিট এবং নেতা যাঁরা হরতাল দেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ছেলেমেয়ে বাংলাদেশে পড়ে না, পড়লেও এমন ব্যবস্থায় তারা আছে যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলেও তারা ঘরে বসেই লেখাপড়ার উপকরণ-সমৃদ্ধ থাকতে পারে। অর্থাৎ, বাসার পাঠাগার, বই, ইন্টারনেট, পেনড্রাইভ, মডেম, প্রিন্টার—সব তাদের ধনিক বা সচ্ছল পরিবারের ঘরের গণ্ডিতে প্রাপ্তব্য হবে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ, আইটি ব্যবহারের সুযোগ বা স্কুলের কেবল বেঞ্চিটিতে বসতে পারাও অনেক সময় একটি পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার চোখ খুলে গেছিল যখন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন, একবার মুহসীন হলে আমার এক সহপাঠী ডাইনিং হলে ক্রোধান্বিত হয়ে একটি কাচের প্লেট ছুড়ে ভেঙে ফেলেছিল। পরে আমাকে আরেক সহপাঠী, যে কিনা তার একই গ্রামের ছেলে, জানিয়েছিল যে ওই প্লেট ছোড়া ছেলেটার দেশের বাড়ির অবস্থা এত খারাপ যে, তাকে মাটিতে বসে সানকিতে করে ভাত খেতে হয়। ওই সহপাঠী মেধার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। পাকা ভবনে থাকার অভিজ্ঞতা তার ওই প্রথম। চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়াও।
তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে দরিদ্র জনগণের শিক্ষা লাভ করার একটা দরজা খোলা থাকে, সেটা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হলে ওই গরিব ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। অর্থাৎ শ্রেণীগতভাবে দেখলে হরতাল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীকুলকে যতটা ক্ষতি করে, হরতাল ডাকনেওয়ালাদের পরিবারের সন্তানাদির শিক্ষার ততটা ক্ষতি করে না। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি, প্যারাডক্সিকালি, হরতাল অস্ত্র হিসেবে একটি স্বার্থবাদী অস্ত্র, এবং দরিদ্র শিক্ষার্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটা ব্যবহূত হচ্ছে। আরও কৌশলীভাবে, শ্রেণীগত চৈতন্য নিয়ে বললে বলতে হয়, হরতাল হচ্ছে খুব সুকৌশলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও দরিদ্র করে রাখার একটি উপায়।
কেউ কেউ বলতে পারেন, জ্ঞানার্জনের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকা না-থাকার সম্পর্ক কী! মানুষ বনে বা গুহায় বসেও তো জ্ঞানার্জন বা গবেষণা করতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল তো স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। আমি কিছুদিন আগে রবীন্দ্রবিষয়ক একটি কলামে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম যে আজকের দিনে হলে তাঁরা সবাই স্কুল, কলেজ বা চাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিও পার হতেন। ঠিক সে রকম অনেক রিকশাওয়ালার ছেলে বা মেয়ে অতীব দরিদ্র সত্ত্বেও যে জিপিএ-৫ পায়, সেটাও ব্যতিক্রম। আমি ব্যতিক্রমী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ লেখা লিখছি না। কথা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার অন্যতম উপকরণ। একজনকে শিশু বয়স থেকে পরিণত বয়সে এনে শিক্ষিত করে পৃথিবীর পথে ছেড়ে দেওয়াটাই হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব।
আমাদের শিক্ষার্থীরা যে কেবল নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে, তা তো নয়। তারা অন্যান্য দেশের সমপর্যায়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। প্রযুক্তির বিশ্বায়নের যুগে কেউ যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের পথে এক মুহূর্ত থেমে থাকতে বলে বা থামাতে চায়, তাহলে সেখানে আমাদের প্রতিবাদ রইল। কারণ, এর ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করার রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি।
সমাজে বিকল্পভাবে সময় কাটানোর কোনো অভাব নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি অনির্ধারিতভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন চঞ্চল তরুণ সমাজ যে বই নিয়ে বাসায় পড়তে বসবে, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা করবে কি, রাস্তার মোড়ে গিয়ে দল বেঁধে আড্ডা দেবে, কিংবা তাস খেলবে, কিংবা ওয়েবসাইটে গিয়ে নানা রকম ছবি দেখবে। আর কেউ কেউ হয়তো নিছক ঘুমাবে। আরও কেউ কেউ হয়তো অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ, তারা গঠনমূলক কোনো কাজে ব্যাপৃত থাকবে না। সেটা তাদের নিজেদের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি।
তবে হরতালের আঘাতের মূল জায়গাটা আরও নির্মম। হরতাল কর্মসূচি আক্ষরিক অর্থে কার্যকর করতে প্রয়োজন হয় সেই যুবশক্তির, যারা রাস্তায় পিকেটিং করতে পারবে, পুলিশের সঙ্গে কিক-বক্সিং খেলতে পারবে। তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কর্মী—যাদের অনেকে নানা পেশার লোক বা নিছক বেকার হলেও বেশির ভাগ হলো ছাত্রছাত্রী, যারা কোনো একটা ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। হরতাল দেনেওয়ালাদের এই যুবশক্তিটা খুব কাজে লাগে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারা হলো মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু এখানেও একটা বুমেরাংয়ের মতো ব্যাপার আছে, সেটা হলো যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের চোখে তারা হলো অশুয়া গোত্র। এ জন্য তাদের লাঠিপেটা করা, গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে পুলিশের মধ্যে অতি উৎসাহ লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, ক্ষমতার বাইরে থাকলে পিকেটারদের প্রয়োজন, আর ক্ষমতায় থাকলে তাদের দমন করা প্রয়োজন।
এই যুব পিকেটারদের বয়স ও শিক্ষার স্তর দেখে বলা যায়, এরাও যেকোনো উদ্দেশ্য ছাড়া পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে তা নয়। তাদেরও নানা রকমের স্বার্থবুদ্ধি কাজ করে। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ, সাংঘর্ষিক, পিচ্ছিল ও ক্ষমতার রাজনীতির পথে তাদের হয় হাতেখড়ি। তাদের ক্ষমতাশীল দল ও বিরোধী দলগুলো নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। তবে লক্ষ করার ব্যাপার হলো, তারা অনেকেই পরবর্তী সময়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে পরিণত হয়।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments