মত ও মন্তব্য-বৈঠক, আলোচনার বিকল্প নেই by হারুন হাবীব
দেশের রাজনীতির দুই প্রধান ধারার প্রতিপক্ষরা এখন অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে। বিরোধী দলের ১২ মার্চের ঢাকা সমাবেশ বা 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি নিয়ে প্রধান বিরোধী দল এবং তার ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক সহযোগীরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে।
অন্যদিকে সরকার এবং আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধপন্থী মহাজোটের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সহযোগীরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে। বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও ব্যক্ত হচ্ছে। যে ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি চলছে তাতে বলতেই হবে, দেশে একধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সহাবস্থান ও সুস্থতার জন্য শুভ নয়। বিরোধী দল যখন জোর করে সরকার উৎখাতের কথা বলে তখন ক্ষমতাসীন দল, যারা বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে, তারা বসে থাকে না- এটাই স্বাভাবিক। কাজেই মহাজোট বিরোধী দলের এই ব্যাপক আয়োজনকে সহজভাবে দেখছে না। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে তারা বিশাল জনসমাবেশ ঘটিয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে ৪০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক সে ভাষণের মধ্য দিয়েই কার্যত ঘোষিত হয় ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, যার পরিণতি এই বাংলাদেশ।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, মানুষের ভোটে বা ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজপথ বা সমাবেশের শক্তির মহড়া দিয়ে সরকার পতনের আয়োজন করা হয়। এ প্রবণতা গণতন্ত্র বা স্থীতিশীলতাকে কতটা সহায়তা করে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এর পরও দেশের প্রত্যেক শান্তিপ্রিয় মানুষ আশা করে, এ সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে, নাশকতা বা গোলযোগের যে আশঙ্কা ব্যক্ত হচ্ছে, তা অমূলক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের অভিযোগের তালিকা নতুন করে তুলে ধরে লাভ নেই। পত্রিকা পাঠক বা টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতা সবাই সেসব অভিযোগ বিলক্ষণ জানে। তবে তাদের দাবিনামার মূল কথা- এ সরকারের পতন। কিন্তু কিভাবে? নির্বাচনের তো এখনো প্রায় দুই বছর বাকি! বলতেই হয়, রাজপথের আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটবে- এমন ধ্যান-ধারণা বাদ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সুস্থ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মিত হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তিন বছর পেরিয়ে চার বছরে পা দিয়েছে। নানা সমালোচনা আছে সরকারের। সাফল্য যেমন আছে, আছে ব্যর্থতাও। বিরোধী দল ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করবে, এমনকি তুলোধুনা করবে, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু দেশের সব অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী জনগোষ্ঠী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে বাধ্য যে বর্তমান সরকার বিরোধীরা শেখ হাসিনা সরকারের তাৎক্ষণিক পতন চায় মূলত তিনটি প্রধান কারণে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের শীর্ষ সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের যে বিচার চলছে, তা তারা বন্ধ বা ভণ্ডুল করতে চায়। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলো তারা অকার্যকর করতে চায়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যেসব মূল নীতি বা চেতনা আগে হরণ করা হয়েছিল, সেগুলো তারা আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে এনে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঘোচাতে চায়।
এর পরও বলব, গণতন্ত্রের সুবাদেই বিরোধী দল সভা-সমাবেশ করে সরকারের সমালোচনা করতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারে, যাতে আগামী নির্বাচনে তারা প্রার্থিত ভোট লাভ করতে পারে। সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে হবে ভোট বা নির্বাচন দিয়েই, শক্তির অন্য কোনো মহড়া দিয়ে নয়। কাজেই কী করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পাদন করা যায়, তা নিয়েই সব মহলকে ভাবতে হবে। আমরা সবাই জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সুপ্রিম কোর্ট অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এরপর ক্ষমতাসীন মহাজোট সংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রহিত করেছে। বিরোধী দলগুলো বলছে এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। রাজনীতিক মহল, এমনকি সিভিল সোসাইটির একটি অংশেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রহিত করা নিয়ে সরকারের সমালোচনা আছে। এসব বিতর্কের সূত্র ধরেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন পরিচালনার প্রস্তাব এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে ব্যবস্থা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সে কারণেই প্রয়োজন আলোচনা বা দুই পক্ষের বৈঠক। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সংসদে যাচ্ছে না। গেলে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। এর পরও বলব, সংসদের ভেতর-বাইরে এ আলোচনা হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদের পর একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কাজেই সরকার এবং বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং এককালের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি দেশের চলমান সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে খোলামেলা মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই শ্রদ্ধেয় মানুষটির মন্তব্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেছেন, 'গণতন্ত্রে ভিন্ন মত থাকে, সমাধানের পথও থাকে। আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ করে দেবে, তার আশায় বসে থাকা উচিত হবে না।' সে কারণে এই বিবেকবান মানুষটি চান বাংলাদেশ তার সংকটের সমাধান নিজের থেকেই করুক। তাঁর নিজের ভাষায়, "আমি 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সমাধান চাই।"
অনেকেই আছেন, যাঁরা দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিকেই কেবল আমাদের রাজনীতির মূল সংকট বলে ভেবে থাকেন। অনেক বিদেশিও আছেন, তাঁরা এ মত পোষণ করেন। আমার কাছে এটি বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক সংকটের অতিসরলীকরণ একটি ধারণা মাত্র। অতীত বেশি না ঘেটেও বলা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপ্রেমীরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে। এরপর ১৯৭৫ সালে তারা হত্যা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দুই যুগ ধরে তারা বাংলাদেশকে পুরাতন পাকিস্তানি চিন্তাধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সফলও হয় তারা বহুলাংশে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের আদিকথা বেশ গভীরে প্রোথিত। লক্ষ করার মতো ব্যাপার এই যে বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ, যার স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এর পরও বলা উচিত, আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক বা সামাজিক সম্পর্ক থাকাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাঞ্ছনীয়। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দিতা থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত শত্রুতার ধারাটি দূর করা সম্ভব হলে দেশ উপকৃত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর থেকে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছিল, তা কয়েক যুগ ধরে চলেছে। একদিকে ঘাতক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হয়েছে, জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী মানুষ নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমি বলতে বাধ্য যে আমাদের নতুন প্রজন্মের বড় অংশ আজ মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণ করে। তারা তাদের জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র আবিষ্কার করতে চায়, সত্য ইতিহাস আবিষ্কার করতে চায়। সে কারণেই তারা মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হয়ে যারা নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, নির্বিচারে নারী নির্যাতন করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, লুণ্ঠন-অপহরণ করেছে, সেই সব যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধীর বিচার চায়। তাদের এ দাবি মানবতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে। বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশ অনেক সংকটের মাঝ দিয়ে পথ চলেছে। এ সংকট থেকে জাতিকে বের করে আনা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব মূলত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের, অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের নয়। আমি বরাবরই আশাবাদী মানুষ। কাজেই মনে করি, সব সংকটের পরও সমাধান খুঁজতে হবে নিজেদেরকেই। সবাইকে বুঝতে হবে, সংকট যতই তীব্র হোক, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের দামে কেনা এ দেশটি আমাদের। বুঝতে হবে, স্বাধীনতার পর ৪০টি বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু প্রার্থিত উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। গণতন্ত্রে ভিন্ন মত থাকবে, সংকটও থাকবে। সে সংকট উত্তরণে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। পৃথিবীর কম দেশ আছে, যারা আমাদের মতো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে, একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এটিও লক্ষ করা গেছে যে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে, তখনই দেশের বাইরের দিকে রাজনীতিবিদসহ কিছু মানুষ তাকিয়ে থাকেন। বিদেশিরা নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক বন্ধু। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তা জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানিত করে না। সংকট যখন একান্তই আমাদের, তখন এর সমাধান আমাদেরই খুঁজতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের সংকটের সমাধান করে দেবেন বলে যাঁরা মনে করেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ দেখি না। যদি তা-ই হয় তবে তা হবে নিজেদের চূড়ান্ত অযোগ্যতা এবং দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সভ্য, গণতান্ত্রিক এ পদ্ধতি থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করতে পারি না। বাইরের বা বিদেশিদের কোনো ফর্মুলায় দেশীয় সংকটের সমাধান কেবল অবাঞ্ছিত নয়, অকল্যাণকরও। যত দ্রুত এ উপলব্ধি আমাদের রাজনীতিবিদদের আসবে, তত দ্রুত আমরা প্রার্থিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথে এগিয়ে যাব।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, মানুষের ভোটে বা ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজপথ বা সমাবেশের শক্তির মহড়া দিয়ে সরকার পতনের আয়োজন করা হয়। এ প্রবণতা গণতন্ত্র বা স্থীতিশীলতাকে কতটা সহায়তা করে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এর পরও দেশের প্রত্যেক শান্তিপ্রিয় মানুষ আশা করে, এ সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে, নাশকতা বা গোলযোগের যে আশঙ্কা ব্যক্ত হচ্ছে, তা অমূলক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের অভিযোগের তালিকা নতুন করে তুলে ধরে লাভ নেই। পত্রিকা পাঠক বা টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতা সবাই সেসব অভিযোগ বিলক্ষণ জানে। তবে তাদের দাবিনামার মূল কথা- এ সরকারের পতন। কিন্তু কিভাবে? নির্বাচনের তো এখনো প্রায় দুই বছর বাকি! বলতেই হয়, রাজপথের আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটবে- এমন ধ্যান-ধারণা বাদ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সুস্থ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মিত হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তিন বছর পেরিয়ে চার বছরে পা দিয়েছে। নানা সমালোচনা আছে সরকারের। সাফল্য যেমন আছে, আছে ব্যর্থতাও। বিরোধী দল ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করবে, এমনকি তুলোধুনা করবে, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু দেশের সব অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী জনগোষ্ঠী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে বাধ্য যে বর্তমান সরকার বিরোধীরা শেখ হাসিনা সরকারের তাৎক্ষণিক পতন চায় মূলত তিনটি প্রধান কারণে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের শীর্ষ সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের যে বিচার চলছে, তা তারা বন্ধ বা ভণ্ডুল করতে চায়। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলো তারা অকার্যকর করতে চায়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যেসব মূল নীতি বা চেতনা আগে হরণ করা হয়েছিল, সেগুলো তারা আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে এনে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঘোচাতে চায়।
এর পরও বলব, গণতন্ত্রের সুবাদেই বিরোধী দল সভা-সমাবেশ করে সরকারের সমালোচনা করতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারে, যাতে আগামী নির্বাচনে তারা প্রার্থিত ভোট লাভ করতে পারে। সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে হবে ভোট বা নির্বাচন দিয়েই, শক্তির অন্য কোনো মহড়া দিয়ে নয়। কাজেই কী করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পাদন করা যায়, তা নিয়েই সব মহলকে ভাবতে হবে। আমরা সবাই জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সুপ্রিম কোর্ট অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এরপর ক্ষমতাসীন মহাজোট সংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রহিত করেছে। বিরোধী দলগুলো বলছে এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। রাজনীতিক মহল, এমনকি সিভিল সোসাইটির একটি অংশেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রহিত করা নিয়ে সরকারের সমালোচনা আছে। এসব বিতর্কের সূত্র ধরেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন পরিচালনার প্রস্তাব এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে ব্যবস্থা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সে কারণেই প্রয়োজন আলোচনা বা দুই পক্ষের বৈঠক। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সংসদে যাচ্ছে না। গেলে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। এর পরও বলব, সংসদের ভেতর-বাইরে এ আলোচনা হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদের পর একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কাজেই সরকার এবং বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং এককালের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি দেশের চলমান সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে খোলামেলা মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই শ্রদ্ধেয় মানুষটির মন্তব্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেছেন, 'গণতন্ত্রে ভিন্ন মত থাকে, সমাধানের পথও থাকে। আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ করে দেবে, তার আশায় বসে থাকা উচিত হবে না।' সে কারণে এই বিবেকবান মানুষটি চান বাংলাদেশ তার সংকটের সমাধান নিজের থেকেই করুক। তাঁর নিজের ভাষায়, "আমি 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সমাধান চাই।"
অনেকেই আছেন, যাঁরা দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিকেই কেবল আমাদের রাজনীতির মূল সংকট বলে ভেবে থাকেন। অনেক বিদেশিও আছেন, তাঁরা এ মত পোষণ করেন। আমার কাছে এটি বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক সংকটের অতিসরলীকরণ একটি ধারণা মাত্র। অতীত বেশি না ঘেটেও বলা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপ্রেমীরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে। এরপর ১৯৭৫ সালে তারা হত্যা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দুই যুগ ধরে তারা বাংলাদেশকে পুরাতন পাকিস্তানি চিন্তাধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সফলও হয় তারা বহুলাংশে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের আদিকথা বেশ গভীরে প্রোথিত। লক্ষ করার মতো ব্যাপার এই যে বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ, যার স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এর পরও বলা উচিত, আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক বা সামাজিক সম্পর্ক থাকাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাঞ্ছনীয়। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দিতা থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত শত্রুতার ধারাটি দূর করা সম্ভব হলে দেশ উপকৃত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর থেকে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছিল, তা কয়েক যুগ ধরে চলেছে। একদিকে ঘাতক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হয়েছে, জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী মানুষ নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমি বলতে বাধ্য যে আমাদের নতুন প্রজন্মের বড় অংশ আজ মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণ করে। তারা তাদের জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র আবিষ্কার করতে চায়, সত্য ইতিহাস আবিষ্কার করতে চায়। সে কারণেই তারা মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হয়ে যারা নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, নির্বিচারে নারী নির্যাতন করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, লুণ্ঠন-অপহরণ করেছে, সেই সব যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধীর বিচার চায়। তাদের এ দাবি মানবতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে। বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশ অনেক সংকটের মাঝ দিয়ে পথ চলেছে। এ সংকট থেকে জাতিকে বের করে আনা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব মূলত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের, অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের নয়। আমি বরাবরই আশাবাদী মানুষ। কাজেই মনে করি, সব সংকটের পরও সমাধান খুঁজতে হবে নিজেদেরকেই। সবাইকে বুঝতে হবে, সংকট যতই তীব্র হোক, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের দামে কেনা এ দেশটি আমাদের। বুঝতে হবে, স্বাধীনতার পর ৪০টি বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু প্রার্থিত উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। গণতন্ত্রে ভিন্ন মত থাকবে, সংকটও থাকবে। সে সংকট উত্তরণে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। পৃথিবীর কম দেশ আছে, যারা আমাদের মতো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে, একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এটিও লক্ষ করা গেছে যে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে, তখনই দেশের বাইরের দিকে রাজনীতিবিদসহ কিছু মানুষ তাকিয়ে থাকেন। বিদেশিরা নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক বন্ধু। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তা জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানিত করে না। সংকট যখন একান্তই আমাদের, তখন এর সমাধান আমাদেরই খুঁজতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের সংকটের সমাধান করে দেবেন বলে যাঁরা মনে করেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ দেখি না। যদি তা-ই হয় তবে তা হবে নিজেদের চূড়ান্ত অযোগ্যতা এবং দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সভ্য, গণতান্ত্রিক এ পদ্ধতি থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করতে পারি না। বাইরের বা বিদেশিদের কোনো ফর্মুলায় দেশীয় সংকটের সমাধান কেবল অবাঞ্ছিত নয়, অকল্যাণকরও। যত দ্রুত এ উপলব্ধি আমাদের রাজনীতিবিদদের আসবে, তত দ্রুত আমরা প্রার্থিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথে এগিয়ে যাব।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট
No comments