ড্রোন-নামহীনতার অবসান by জিগমুন্ট বাউম্যান

গত ১৯ জুন একই দিনে দুটি আপাতসম্পর্কহীন খবর প্রকাশিত হলো। অবশ্য কারও নজর এড়িয়ে গেলে তাকে মাফ করা যেতে পারে...যেকোনো খবরের মতোই খবর দুটি এল ‘তথ্য-সুনামি’তে ভেসে। পাঠক বা শ্রোতাকে আমোদ দেওয়া এবং স্পষ্ট করার পাশাপাশি অস্পষ্ট ও বিভ্রান্ত করার যে খবরের বন্যা, তাতে মাত্র ছোট্ট দুই ফোঁটা।


একটার লেখক এলিজাবেথ বুমিলার ও থম শংকর। তাঁরা জানাচ্ছেন, জানালার চৌকাঠে আরামে বসে থাকা ফড়িং কিংবা হামিংবার্ডের মতো আকৃতিতে নামিয়ে আনা ড্রোনের সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা। উভয় ধরনের ড্রোনের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন এগুলো—বায়বাকাশ প্রকৌশলী গ্রেগ পার্কারের ভাষায়—‘খোলা চোখে ধরা না পড়ে’। দ্বিতীয় খবরটির লেখক ব্রায়ান স্টেলটার। তিনি বলেছেন, ইন্টারনেট এমন এক স্থান, ‘যেখানে নামহীনতার মৃত্যু ঘটে’। এই দুই বার্তার মূল সুরের ভেতর ঐক্য আছে: ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আকর দুই বৈশিষ্ট্য—অদৃশ্যতা ও স্বতন্ত্রতা—অবসানের ইশারা উভয় লেখাতেই দেওয়া হয়েছে। যদি অদৃশ্যতা ও স্বতন্ত্রতা পরস্পর সম্পর্কহীনভাবে নির্মিত হয় এবং একে অন্যের অস্তিত্বের কথা না-ও জানো, তবু সেটা প্রযোজ্য।
পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন এখন গোয়েন্দা তৎপরতা বা হামলা চালানোর কাজ করছে। ‘প্রেডাটর’ ড্রোন হামলা চালানোয় ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করেছে (‘২০০৬ সালের পর আমেরিকার ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে ১৯০০ জনের বেশি বিদ্রোহী নিহত হয়েছে’)। এমন ড্রোন এখন ক্ষুদ্র পাখির আকার পেতে যাচ্ছে। বরং পতঙ্গের আকার দেওয়া গেলে আরও ভালো (পাখির ডানার নড়াচড়ার চেয়ে পতঙ্গের ডানা ঝাপটানোকে নকল করা প্রযুক্তিগতভাবে বাহ্যত সহজতর)। প্রাগ্রসর বিমান চালনা প্রযুক্তির ওপর পিএইচডিরত শিক্ষার্থী মেজর মাইকেল এল অ্যান্ডারসনের মতে, বাতাসে ভেসে থাকতে পারার দক্ষতার জন্য প্রসিদ্ধ হক মথের (hawk moth) নভোদক্ষতার চমৎকারিত্ব আয়ত্ত করাকে লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ধরে এগোচ্ছে নতুন ড্রোন নকশার কাজ। যদিও এখনো সেটা অর্জিত হয়নি, তবে অ্যান্ডারসনের মতে, নিশ্চিতভাবেই খুব শিগগির সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এই লক্ষ্য বেছে নেওয়ার কারণ, ‘আমাদের জবরজং আকাশযানগুলোর পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব’ তার সব অনেক পেছনে ফেলে এটির এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা।
নতুন প্রজন্মের ড্রোন নিজে অদৃশ্য থাকবে, অথচ বাকি সবকিছুই দেখতে পারার সুযোগ সৃষ্টি করবে। নিজে নিরাপদ থাকবে, অথচ বাকি সবকিছুই অরক্ষিত করে তুলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল একাডেমির নৈতিকতাবিশারদ অধ্যাপক পিটার বাকেরের মতে, সেসব ড্রোনের মধ্য দিয়ে সূচিত হবে ‘বীর-যুগোত্তর কালের’ যুদ্ধ। তবে, অন্য কয়েকজন ‘সামরিক নৈতিকতাবিশারদের’ মতে, ‘আমেরিকার জনগণ ও আমেরিকার যুদ্ধের মধ্যে বর্তমানে যে বিপুল বিচ্ছেদ আছে’, সেটা আরও বিস্তৃততর করবে এসব ড্রোন। ঘুরিয়ে বললে, যে জাতির নামে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া, সেই জাতির কাছেই যুদ্ধকে প্রায় অদৃশ্য বানিয়ে ফেলার (সে দেশের কারও জীবন ঝুঁকিতে পড়ে না) দিকে আরেকটি উল্লম্ফন (বাধ্যতামূলকভাবে সবার সেনাবাহিনীতে কাজ করার ব্যবস্থা পাল্টে পেশাদারি সেনাবাহিনী গঠনের পর এটা সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন)। আর যুদ্ধ পরিচালনার কাজটি তখন আরও সহজ হয়ে যাবে। নিজ পক্ষে আনুষঙ্গিক ক্ষতি বা কল্যাটরাল ড্যামেজ না ঘটা এবং যুদ্ধের ফলে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বকে রাজনৈতিক খেসারত দেওয়ার প্রশ্ন একেবারেই না থাকায় যুদ্ধ আরও বেশি প্রলুব্ধকর ব্যাপারে পরিণত হবে।
পরবর্তী প্রজন্মের ড্রোন সবকিছুই দেখবে, অথচ নিজে নিরাপদে অদৃশ্য থেকে যাবে। আক্ষরিক অর্থেও যেমন, রূপকার্থেও তেমনি। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে বাস করে কোনো লুকানোর জায়গা পাওয়া যাবে না। কেউ এর বাইরে থাকবে না। এমনকি ড্রোনকে কাজে পাঠাবেন যেসব যন্ত্রকারিগর, তাঁদেরও নিজের চলাফেরার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে। আর এ জন্য তাঁরা কোনো বস্তুকেই নজরদারির আওতার বাইরে রাখতে পারবেন না—তা যত জোরালো চাপই থাক না কেন: ‘নতুন ও উন্নততর’ ড্রোন নিজে নিজে উড়তে পারার মতো করে প্রোগ্রাম করা হবে—নিজের পছন্দমাফিক যাত্রাপথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। পরিকল্পিতসংখ্যক ড্রোন মাঠে নামানোর পর এদের পাঠানো তথ্যের সীমা হবে আকাশসমান বিস্তৃত।
আসলে দূর থেকে এবং স্বাধীনভাবে কর্মক্ষম নতুন নজরদারি বা গোয়েন্দা প্রযুক্তির যে দিকটির বিষয়ে এর পরিকল্পনাবিদ ও উল্লিখিত লেখকদ্বয়ও সবচেয়ে উদ্বিগ্ন, তা হলো ‘উপাত্তের সুনামি’। বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরগুলোর কর্মীরা এখনই উপাত্তের বন্যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন—তাঁদের আত্মস্থকরণের ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে পড়া এবং এভাবেই তাঁদের (কিংবা যে কারোরই) নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার বুকে হামলার পর থেকে ড্রোনের পাঠানো গোয়েন্দা তথ্য বিমানবাহিনীর কর্মীদের প্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বেড়েছে ৩,১০০%। আর প্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রতিদিন তথ্যভান্ডারে যুক্ত হচ্ছে দেড় হাজার ঘণ্টা ভিডিও ও দেড় হাজার ছবি। ড্রোন সংবেদনার সীমিত ‘সোডা স্ট্র’ দৃষ্টি যখন একবার প্রদক্ষিণেই পুরো শহরের তথ্য পেতে সক্ষম ‘গোর্গন স্টেয়ার’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে (এটা আসন্ন), তখন একটা ড্রোনের পাঠানো তথ্য সামলাতে দরকার পড়বে দুই হাজার বিশ্লেষক। বর্তমানে ১৯ জনে সেই কাজ করছে। এর মানে, উপাত্তের তলাবিহীন পাত্র হতে ‘কৌতূহলোদ্দীপক’, ‘প্রাসঙ্গিক’ জিনিসটা বের করে আনার কাজ হবে কঠোর শ্রমসাধ্য; ব্যয়সাপেক্ষও বটে। বলছি না যে সম্ভাব্য কৌতূহলোদ্দীপক কোনো জিনিস সেই পাত্রে ধরা না পড়ে থাকতে পারবে। কেউ কোনো দিন জানবেও না, কখন হামিংবার্ড তার জানালার চৌকাঠে এসে বসে।
ইন্টারনেটের সুবাধে ‘নামহীনতার অবসান’ ঘটার গল্পটি সামান্য আলাদা। আমাদের গোপনীয়তার অধিকার আমরা স্বেচ্ছায়ই বিসর্জন দিই। কিংবা হয়তো এর বিনিময়ে যে বিস্ময় আমাদের সামনে অবারিত হয়, তার যৌক্তিক মূল্য হিসেবে আমরা শুধু গোপনীয়তা হারানোতে সম্মতি দিই। কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যকে কসাইখানায় বলি হতে দেওয়ার চাপ এত প্রচণ্ড, আর ভেড়ার পালের অবস্থার সঙ্গে এর এত সাদৃশ্য যে মাত্র কজন ব্যতিক্রমী বিপ্লবী, দৃঢ়চেতা, লড়াকু ও দৃঢ়সংকল্প ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মানুষই তা প্রতিরোধের আন্তরিক চেষ্টা চালাবে। অবশ্য কোনো না কোনোভাবে আমাদের নামে মাত্র হলেও দেওয়া হয় একটা বেছে নেওয়ার সুযোগ; এবং অন্তত দ্বিমুখী চুক্তির আভাস আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে অভিযোগ করা ও প্রতিবাদের অন্তত আনুষ্ঠানিক অধিকার। ড্রোনের ক্ষেত্রে সেই সুযোগটাও কখনোই দেওয়া হয় না।
বিষয়টা এ রকম: পৃথিবীতে আসামাত্র আমরা ভাগ্যের হাতে জিম্মি হয়ে গেলাম। ব্রায়ান স্টেলটার যেমন দেখেছেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২০০ কোটি মানুষের সামষ্টিক বুদ্ধিবৃত্তি এবং ওয়েবসাইটে এত এত মানুষের হাতের যে ডিজিটাল ছাপ পড়ে, তা মিলেমিশে আমরা এমন এক দিকে যাত্রা করছি, যেখানে প্রতিটি অস্বস্তিকর ভিডিও, প্রতিটি অন্তরঙ্গ আলোকচিত্র, প্রতিটি অমার্জিত ই-মেইল তার উৎসের আপনকার গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়, উৎসের চাওয়া না-চাওয়ার পরোয়া না করেই।’ ভেনকুবার শহরে রাজপথের দাঙ্গা অনুসরণকারী মুক্ত আলোকচিত্রী রিচ ল্যামের একটি ছবিতে আবেগে চুম্বনরত এক দম্পতিকে তাঁর খুঁজে পেতে মাত্র একদিন লেগেছিল।
যা কিছু ব্যক্তিগত, তা সব এখন জনসম্মুখে সাধিত হওয়া সম্ভব; সম্ভব তা জনগণের ভোগের নিমিত্তে ব্যবহূত হওয়াও। আর সময়ের শেষ পর্যন্ত তা প্রাপ্তিসাধ্য থেকে যায়। কেননা, ইন্টারনেটের অগুনতি সার্ভারের কোনো একটাতে একবার রেকর্ড হলে তা ইন্টারনেটকে ‘ভুলিয়ে দিতে পারা যায় না’। ‘বিস্তৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সস্তা সেলফোন ক্যামেরা, ওয়েবে বিনা মূল্যে আলোকচিত্র ও ভিডিও হোস্টিংয়ের সুযোগ এবং হয়তো এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—কোন বিষয়টি প্রকাশ্য এবং কোনটি ব্যক্তিগত হওয়া উচিত, সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে নামহীনতার এই ক্ষয়।’ এর সঙ্গে যোগ করে বলি: প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত ব্যাপার বাছাই করার সুযোগ জনগণের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, আর তাতে মানুষ প্রবল উৎসাহসহকারে সহযোগিতা করছে, আর কান ফাটানো তালি দিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনের এতিয়েঁ দুলা বোয়েতি হয়তো প্রলুব্ধ হতেন স্বতঃপ্রণোদিত সেবার কথা নয়, নিজে নিজে করার (ডিআইওয়াই) কথা বলতে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জিগমুন্ট বাউম্যান: পোলিশ সমাজতাত্ত্বিক।

No comments

Powered by Blogger.