ষড়্ঋতু-বসন্তবিলাস by মাহবুব আলম

বসন্ত আসে শীতের বিদায়-বার্তা নিয়ে। যাই যাই করেও ভোরের কুয়াশার চলে যেতে মৃদু অনিচ্ছা। বাতাসের হালকা শিরশিরে ভাব কখন যেন উধাও। বেলা বাড়ার সঙ্গে দেখা যায় দূরে দাঁড়িয়ে আছে ‘রুদ্র তাপস গ্রীষ্ম’, শহরের বাইরে গেলে চোখ আটকে যায় সরষেখেতের হলুদ বিস্তীর্ণ গালিচায়। সবুজ খেতের এক পাশে টুকটুকে লাল লঙ্কার স্তূপ।


রবি ফসল ঘরে উঠছে। কৃষকের মুখে চওড়া হাসি, ঘরে ঘরে আনন্দ—গ্রাম-বাংলায় এখন উৎসব। সেই উৎসবের আনন্দে স্কুলের ছেলেমেয়েরা গাইছে। ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’। এখন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
ডেনমার্কের রাজপুত্র ছাড়া যেমন হ্যামলেট নাটক অকল্পনীয়, তেমনি কোকিল, পলাশ, শিমুলবিহীন বসন্তও যেন অসম্পূর্ণ। কেমন আছে আমাদের রাজধানীতে ঋতুরাজের এই তিন রাজদূত। সুখের বিষয়, যথেচ্ছ বৃক্ষনিধনের পরও এই শহরে যেখানে একটু ফাঁকা জায়গায় দু-চারটি বড় গাছের বিক্ষিপ্ত ঝটলা, সেখানে কোকিল হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠে দুপুরে বা বিকেলে। পয়লা বসন্তের দিন একটি কর্তব্যনিষ্ঠ কোকিলের ডাক শুনেছি, ভোরের রোদ একটু চড়ে ওঠার পরই। এই অভাবনীয় সুখবরের কৃতিত্বের ভাগ পরোক্ষভাবে হলেও দেওয়া যায় ঢাকার বহুল নিন্দিত আবাসিক বায়সকুলকে। যত দিন কাক আছে, কাছে কোকিলও থাকবে। কেনা জানে কাকের বাসাই অনাদিকাল থেকে কোকিলের নিখরচার নিরাপদ মাতৃসদন।
এই শহরে শিমুল প্রায় বিরল দর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনো টিকে আছে কয়েকটি। কয়েক বছর আগেও ঢাকায় বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দেখা যেত সারা গায়ে-মাথায় লাল আগুনের শোভা নিয়ে রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে শিমুলগাছ। তারা এখন হত। গ্রামাঞ্চলেও শিমুলগাছের সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। বসন্ত বন্দনার পরিবর্তে এখন তারা ইটের ভাটার ক্ষুধা মেটাতেই ব্যস্ত। ঢাকায় পলাশেরও দিন ফুরিয়ে এসেছে। তবে ভালো করে খুঁজলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বা রমনা পার্কে দু-চারটে পলাশ এখনো চোখে পড়বে। সেই ১৯৮৫ সালে বৃক্ষপ্রেমিক ওয়াহিদুল হক তাঁর চেতনা ধারায় এসো বইয়ে অনবদ্য গদ্যে লিখে গেছেন পলাশের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কাহিনি। পলাশ ছিল লিটন হলের একপাশে গোটা দুই আর পলাশি ব্যারাকের নাম সার্থক করার জন্য তার কাছে গোটা কয়েক। পলাশ প্রিয়ার পূজায় যত ফুল লাগে, তার জন্য যেতে হতো কুর্মিটোলার পথে। অথচ এত নিরবচ্ছিন্ন বৃক্ষ হননের পরও চট্টগ্রাম পলাশের শহর, তার নাম পলাশি হলেই ভালো হতো।
বসন্ত রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ঋতু। এর প্রাণ প্রাচুর্য আর সৃজনশীলতা কবিকে সেই প্রথম বয়সেই আকর্ষণ করেছিল। ১৯০২ সালে বসন্ত যাপন প্রবন্ধে কবির এই ঋতুটির প্রতি মুগ্ধতা এবং কৃতজ্ঞতা চোখে পড়ে। ‘বসন্তে সমস্ত বনে উপবনে ফুল ফুটিবার সময় উপস্থিত হয়, তখন তাহাদের প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব তখন তাহাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না; যেখানে দুটো ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কেবল এই অজস্রতার স্রোত রোধ করিবে। সে আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না; আমরা কি বসন্তের নিগূঢ় রসসঞ্চারবিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নই।’
১৯৩২ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে দোলের দিন সকালের নাচ-গানের অনুষ্ঠানটি বসন্তোৎসব নামে চিহ্নিত করে তাকে শান্তিনিকেতনের আনুষ্ঠানিক উৎসবের অন্তর্গত করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বসন্তোৎসব নামের (১৯১৫-এ লেখা) নাটকটি নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ফাল্গুনী। এই নাটকেই ঠাকুরদার ভূমিকায় কবি গাইলেন—‘আজ দখিনা দুয়ার খোলা, এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত।’ রবীন্দ্রনাথ বসন্তকে ‘আমার বসন্ত’ বলে আহ্বান করেছিলেন তাঁর বসন্তোৎসব নাটকে। বয়স তখন তাঁর ৫০। তাঁর প্রচলিত বসন্তোৎসবই পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বসন্ত নিয়ে ব্যঙ্গকৌতুক করতেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তর দফতর-এ। বঙ্কিমের কমলাকান্ত বসন্তের কোকিলকে সামনে রেখে সমাজের সুবিধাবাদী আর সুযোগসন্ধানী মানুষদের কৌতুক বাণে ধরাশয়ী করেছেন। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণে শীতের হিমের প্রকোপে মানুষ-প্রাণী যখন অতিষ্ঠ, তখন কোকিলের সাড়াশব্দটিও পাওয়া যায় না। কোকিলের মাজামাজা কালো কালো দুলালী ধরনের শরীরখানি তখন চোখে পড়ে না বলে কমলাকান্ত ক্ষুব্ধ। তাঁর খেদের কারণ, ‘যখন ফুল ফুটে...এ সংসার সুখের স্পর্শে শিউরে ওঠে তখন কোকিল রসিকতা আরম্ভ করে।’ তার ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। তাদের ওপর যারা কমলাকান্তর দৃষ্টিতে মানুষ-কোকিল।
কমলাকান্তর মানুষ-কোকিল সেদিনের মতো আজও আছে। কোকিলের বংশ বৃদ্ধি হয়েছে কি না তা হলফ করে বলার সুযোগ নেই, কিন্তু আমাদের সমাজে মানুষ-কোকিলের যে বাড়বৃদ্ধি হয়েছে, তাতে নেই কোনো সন্দেহ। এই কোকিলের দেখা মেলে সব ঋতুতেই, শুধু বসন্তে নয়। আধুনিক বিশ্বের কোনো দেশের নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভকে প্রায়ই সে দেশে বসন্ত সমাগমের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার গণতন্ত্রের দাবিকে আজ পৃথিবী ‘আরব-বসন্ত’ নামে গৌরবান্বিত করেছে।
রাজনৈতিক আন্দোলনে বসন্ত শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬৮ সালে, তদানীন্তন চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষের সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোকে কেন্দ্র করে। সেই পরাজিত ও ক্ষণস্থায়ী আন্দোলন আজও ইতিহাসে ‘প্রাগ-বসন্ত’ নামে পরিচিত। প্রাগ শহরে এই আন্দোলনের শুরু কিন্তু জানুয়ারি মসের ঘোর শীতে, বসন্তে নয়। তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের সূত্রপাতও জানুয়ারি মাসে, যাকে বসন্ত দিন বলা যায় না কোনোমতেই। তবু সেখানে মুক্তির বসন্ত বাতাস বইতে শুরু করে সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে। তাই বসন্তের সঙ্গে এই প্রতীকী তুলনা যথার্থ। সত্যিকার বসন্ত তো ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়, মানুষের মনে।
বসন্তের রূপ, বর্ণ-স্পর্শ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এই বসন্ত দিনেই আমরা পাই মহান ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। ’৭১-এর বসন্তেই ডাক এসেছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের। আমাদের রক্তস্নাত স্বাধীনতার দৃপ্ত পতাকা তুলে ধরা হয় প্রতিবছর বসন্তের ২৬ মার্চে। বসন্ত আমাদের জন্য শুধু আলো-হাসির ঋতু নয়, এ আমাদের সফলতার ঋতু, ত্যাগের ঋতু, পরিপূর্ণতার ঋতু, অঙ্গীকার আর শপথের ঋতু।
মাহবুব আলম: প্রাবন্ধিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.