বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. অশোক কান্তি সান্যাল-মানুষ বাঁচাতেই মাটিকে বাঁচাতে হবে
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সম্মেলন। তাতে অংশ নিয়েছিলেন জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (জেডএসআই) সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট প্রাণীবিজ্ঞানী ড. অশোক কান্তি সান্যাল।
তিনি একনাগাড়ে চার দশক জেডএসআইয়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে ভারতের প্রাণীসম্পদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে বাংলার প্রাণসম্পদের প্রতিও রয়েছে তাঁর বিশাল আগ্রহ। সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনের ফাঁকে কথা হয়েছিল এই নিবেদিতপ্রাণ প্রাণীবিজ্ঞানীর সঙ্গে। তারই একটি সংক্ষিপ্ত অংশ কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য নিবেদন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফরহাদ মাহমুদ
কালের কণ্ঠ : আপনি বক্তৃতায় 'মা, মাটি ও মানুষ' স্লোগানটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমে এই তিনের সম্পর্কের কথাই শুনতে চাই আপনার কাছ থেকে।
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় স্লোগান হচ্ছে এই 'মা, মাটি ও মানুষ'। এর সুদূরপ্রসারী ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখানে মা বলতে বোঝানো হয়েছে মাতৃভূমিকে, মাটি বলতে মৃত্তিকা এবং মানুষ তো আছেই। এদের একটির ওপর অপরটি নির্ভরশীল। একটি ছাড়া অপরটি সজীব থাকতে পারে না। অন্যভাবে বলতে পারি, মাতৃভূমি ও মৃত্তিকার যে সমষ্টিগত প্রকাশ, তার ওপরই মানবসম্পদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হলে মা ও মাটিকে অবহেলা করা যাবে না_এটাই এই স্লোগানের মূল কথা।
বাস্তবে পৃথিবীর সব প্রাণসম্পদই মাটি বা মৃত্তিকার ওপর নির্ভরশীল। এই মাটি যদি নষ্ট হয়ে যায়, ঠিকমতো ফসল না ফলাতে পারে, বৃক্ষের জন্ম ও জীবন দিতে না পারে_তাহলে মানুষ জীবন ধারণ করতে পারবে কি? তাই বলা হয়, মাটির কাছেই রয়েছে মানুষসহ সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি। সেই মাটির নিজেরও সুস্থ থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমরা নানাভাবে মাটির সেই সুস্থতাকেই নষ্ট করে ফেলছি, আর এটাকেই বলা হয় মৃত্তিকা দূষণ। এটি যদি খুব বেশি হয়, মাটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আমাদের ফসল ও গাছপালা উপহার দিতে না পারে, তাহলে কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকাটাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কালের কণ্ঠ : মৃত্তিকা দূষণ কেন হয়, কী কী উপায়ে হয় এবং তার প্রতিকারই বা কী?
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : মাটি বহুবিধ উপায়ে দূষণের শিকার হয়। কিছু প্রাকৃতিক কারণও থাকে, তবে অধিকাংশই ঘটে মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের কারণে। পৃথিবীতে আজ যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাও কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শিতার কারণে। মাটিতে যেসব উপাদান থাকে, তার একটি হলো পানি। এই পানি হচ্ছে স্বাভাবিক বা প্রকৃতিতে বিদ্যমান পানি। গাছপালা, উদ্ভিদ বা ফসলাদি মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু কলকারখানা থেকে রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত যে পানি মাটিতে গিয়ে মিশে, সেই পানিতে গাছপালা বা ফসলের বৃদ্ধি সম্ভব নয়। আমরা বিজ্ঞানীরা জানি, এক মুঠো মাটিতে কয়েক লাখ আণুবীক্ষণিক জীব বা জীবাণু রয়েছে। কেঁচো ও মাটির নিচে বসবাসকারী নানা রকম প্রাণী রয়েছে। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবরা মাটির গুণাগুণ বা উর্বরা শক্তি জোগায়। গাছের পাতা, পচনশীল দ্রব্য কিংবা প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃতদেহ এবং জৈব বর্জ্য প্রতিনিয়ত মাটিতে জমা হচ্ছে। অণুজীবরা সেগুলো পচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং তা থেকে মাটি পুনরায় তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। এই প্রক্রিয়া আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত বর্জ্য পানিতে এসব অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে বর্জ্য পানি যে মাটিতে গিয়ে পড়ে, সেই মাটির অণুজীবরা মরে যায়। এতে সেই মাটির উর্বরা শক্তিও ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সেই মাটি ফসল ফলাতে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহারেও মাটির অণুজীবরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি ধরে রাখতে পারে না। তখন কৃষককে কেবলই বেশি করে সারনির্ভর হতে হয়, অন্যদিকে মাটির উর্বরা শক্তিও ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। আবার মানুষের জীবনে বিলাসিতা অনেক বেড়ে গেছে। আজকাল দালানকোঠার কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, দালানকোঠার এই ইট জোগাতে গিয়ে আমরা মাটির কত ক্ষতি করছি। ইটখোলার জন্য মাটির উপরিভাগ কেটে আনা হয়। অথচ মাটির উপরিভাগেই থাকে অণুজীবসহ উপকারী কীটপতঙ্গ, যেগুলো উপরের মাটিকে ফসলের উপযোগী করে তোলে। সেই মাটি কেটে নিয়ে এলে যে মাটি থাকে, সেই মাটি উর্বরা শক্তি পেতে অনেক সময় লেগে যায়। আবার নানাভাবে মাটির যে স্বাভাবিক পানি সরবরাহ তাকেও আমরা বাধাগ্রস্ত করি। এটিও মাটির জৈব গুণাগুণ নষ্ট করে। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো বনজ সম্পদ ধ্বংস করা। এর ফলে মাটির ক্ষয় অনেক বেড়ে যায়। মাটিতে থাকা নানা রকম খনিজ ধুয়ে চলে যায়। বর্জ্য পদার্থ বা সলিড ওয়েস্টের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ আছে অপচনশীল। এগুলো মাটির জীবনচক্রকে নানাভাবে ব্যাহত করে। আবার উপরিস্তরে জমা হয়ে মাটির জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে সেই মাটি সহজেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। এভাবে জেনে হোক, না জেনে হোক_আমরা প্রতিনিয়ত মাটির ক্ষতি করছি। এর পরিণতি কখনোই ভালো হতে পারে না। কাজেই মাটিকে তার স্বাভাবিক গুণাবলিসহ বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাটি সংরক্ষণ করতে হবে। মাটির ক্ষতি হয় এমন সব কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। মাটিতে প্রাণসম্পদকে রক্ষা করতে হবে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে। কোথাও মাটি বেশি পরিমাণে দূষিত হয়ে পড়লে তা থেকে মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে।
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও জীবাণু সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। মাটির জলচক্রকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে কেবল পানি তুলেই গেলাম, মাটিতে পানির অনুপ্রবেশ বা রিচার্জ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল করলাম না_তার পরিণতি কিন্তু ভালো হবে না। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কেবলই নিচে নেমে যাবে এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া দেখা দেবে।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘদিন প্রাণসম্পদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের অবস্থাও কমবেশি আপনার জানা আছে। বাংলাদেশে প্রাণসম্পদ সংরক্ষণে কী কী করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : মাটি, পানি, উদ্ভিদ, প্রাণী_সবকিছু নিয়েই একটি দেশের প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এর একটির সঙ্গে অপরটির নিবিড় যোগাযোগ ও নির্ভরশীলতা রয়েছে। কাজেই সামগ্রিকভাবেই এদের সংরক্ষণ প্রয়োজন। একটি দেশের জীবসম্পদ কী আছে, তারা কী অবস্থায় আছে_তা তো অবশ্যই জানতে হবে। জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা জেডএসআইয়ে আমরা সে কাজটিই দীর্ঘদিন থেকে করে আসছি। আমি নিজেই সেখানে ৪০ বছর কাজ করার পর অবসর নিয়েছি। বর্তমানে সেখানে প্রায় সাত শ বৈজ্ঞানিক আছেন। বাংলাদেশে জুলজিক্যাল সার্ভে নামে কোনো পৃথক সংগঠন না থাকলেও বিজ্ঞানীরা নানা পর্যায় থেকে অনুরূপ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং যথাসম্ভব এই গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। প্রাণীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাঁরা গবেষণা করবেন, তাঁদেরও এসব তথ্যের প্রয়োজন হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরাই এসব তথ্যকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর আমরা যেহেতু একই পরিবেশ ও প্রতিবেশের বাসিন্দা, তাই এসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের তথা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনেক উপকারে আসবে।
ভারতের যে প্রাণী সংরক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে, সেখানে এককোষী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণী পর্যন্ত সব প্রাণীকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। শুধু প্রাণীকে বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচিয়ে রাখা নয়, প্রাণীরা যাতে বেঁচে থাকতে পারে, সে রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা আবাসযোগ্যতা সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। আমি এখনো পশ্চিমবঙ্গে সে ধরনের কিছু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমি আশা করি, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও অনুরূপভাবে এ কাজগুলো করে যাবেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের পাঠকদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : কালের কণ্ঠ এবং এর পাঠকদেরও জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : আপনি বক্তৃতায় 'মা, মাটি ও মানুষ' স্লোগানটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমে এই তিনের সম্পর্কের কথাই শুনতে চাই আপনার কাছ থেকে।
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় স্লোগান হচ্ছে এই 'মা, মাটি ও মানুষ'। এর সুদূরপ্রসারী ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখানে মা বলতে বোঝানো হয়েছে মাতৃভূমিকে, মাটি বলতে মৃত্তিকা এবং মানুষ তো আছেই। এদের একটির ওপর অপরটি নির্ভরশীল। একটি ছাড়া অপরটি সজীব থাকতে পারে না। অন্যভাবে বলতে পারি, মাতৃভূমি ও মৃত্তিকার যে সমষ্টিগত প্রকাশ, তার ওপরই মানবসম্পদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হলে মা ও মাটিকে অবহেলা করা যাবে না_এটাই এই স্লোগানের মূল কথা।
বাস্তবে পৃথিবীর সব প্রাণসম্পদই মাটি বা মৃত্তিকার ওপর নির্ভরশীল। এই মাটি যদি নষ্ট হয়ে যায়, ঠিকমতো ফসল না ফলাতে পারে, বৃক্ষের জন্ম ও জীবন দিতে না পারে_তাহলে মানুষ জীবন ধারণ করতে পারবে কি? তাই বলা হয়, মাটির কাছেই রয়েছে মানুষসহ সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি। সেই মাটির নিজেরও সুস্থ থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমরা নানাভাবে মাটির সেই সুস্থতাকেই নষ্ট করে ফেলছি, আর এটাকেই বলা হয় মৃত্তিকা দূষণ। এটি যদি খুব বেশি হয়, মাটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আমাদের ফসল ও গাছপালা উপহার দিতে না পারে, তাহলে কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকাটাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কালের কণ্ঠ : মৃত্তিকা দূষণ কেন হয়, কী কী উপায়ে হয় এবং তার প্রতিকারই বা কী?
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : মাটি বহুবিধ উপায়ে দূষণের শিকার হয়। কিছু প্রাকৃতিক কারণও থাকে, তবে অধিকাংশই ঘটে মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের কারণে। পৃথিবীতে আজ যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাও কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শিতার কারণে। মাটিতে যেসব উপাদান থাকে, তার একটি হলো পানি। এই পানি হচ্ছে স্বাভাবিক বা প্রকৃতিতে বিদ্যমান পানি। গাছপালা, উদ্ভিদ বা ফসলাদি মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু কলকারখানা থেকে রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত যে পানি মাটিতে গিয়ে মিশে, সেই পানিতে গাছপালা বা ফসলের বৃদ্ধি সম্ভব নয়। আমরা বিজ্ঞানীরা জানি, এক মুঠো মাটিতে কয়েক লাখ আণুবীক্ষণিক জীব বা জীবাণু রয়েছে। কেঁচো ও মাটির নিচে বসবাসকারী নানা রকম প্রাণী রয়েছে। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবরা মাটির গুণাগুণ বা উর্বরা শক্তি জোগায়। গাছের পাতা, পচনশীল দ্রব্য কিংবা প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃতদেহ এবং জৈব বর্জ্য প্রতিনিয়ত মাটিতে জমা হচ্ছে। অণুজীবরা সেগুলো পচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং তা থেকে মাটি পুনরায় তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। এই প্রক্রিয়া আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত বর্জ্য পানিতে এসব অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে বর্জ্য পানি যে মাটিতে গিয়ে পড়ে, সেই মাটির অণুজীবরা মরে যায়। এতে সেই মাটির উর্বরা শক্তিও ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সেই মাটি ফসল ফলাতে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহারেও মাটির অণুজীবরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি ধরে রাখতে পারে না। তখন কৃষককে কেবলই বেশি করে সারনির্ভর হতে হয়, অন্যদিকে মাটির উর্বরা শক্তিও ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। আবার মানুষের জীবনে বিলাসিতা অনেক বেড়ে গেছে। আজকাল দালানকোঠার কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, দালানকোঠার এই ইট জোগাতে গিয়ে আমরা মাটির কত ক্ষতি করছি। ইটখোলার জন্য মাটির উপরিভাগ কেটে আনা হয়। অথচ মাটির উপরিভাগেই থাকে অণুজীবসহ উপকারী কীটপতঙ্গ, যেগুলো উপরের মাটিকে ফসলের উপযোগী করে তোলে। সেই মাটি কেটে নিয়ে এলে যে মাটি থাকে, সেই মাটি উর্বরা শক্তি পেতে অনেক সময় লেগে যায়। আবার নানাভাবে মাটির যে স্বাভাবিক পানি সরবরাহ তাকেও আমরা বাধাগ্রস্ত করি। এটিও মাটির জৈব গুণাগুণ নষ্ট করে। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো বনজ সম্পদ ধ্বংস করা। এর ফলে মাটির ক্ষয় অনেক বেড়ে যায়। মাটিতে থাকা নানা রকম খনিজ ধুয়ে চলে যায়। বর্জ্য পদার্থ বা সলিড ওয়েস্টের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ আছে অপচনশীল। এগুলো মাটির জীবনচক্রকে নানাভাবে ব্যাহত করে। আবার উপরিস্তরে জমা হয়ে মাটির জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে সেই মাটি সহজেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। এভাবে জেনে হোক, না জেনে হোক_আমরা প্রতিনিয়ত মাটির ক্ষতি করছি। এর পরিণতি কখনোই ভালো হতে পারে না। কাজেই মাটিকে তার স্বাভাবিক গুণাবলিসহ বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাটি সংরক্ষণ করতে হবে। মাটির ক্ষতি হয় এমন সব কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। মাটিতে প্রাণসম্পদকে রক্ষা করতে হবে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে। কোথাও মাটি বেশি পরিমাণে দূষিত হয়ে পড়লে তা থেকে মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে।
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও জীবাণু সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। মাটির জলচক্রকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে কেবল পানি তুলেই গেলাম, মাটিতে পানির অনুপ্রবেশ বা রিচার্জ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল করলাম না_তার পরিণতি কিন্তু ভালো হবে না। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কেবলই নিচে নেমে যাবে এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া দেখা দেবে।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘদিন প্রাণসম্পদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের অবস্থাও কমবেশি আপনার জানা আছে। বাংলাদেশে প্রাণসম্পদ সংরক্ষণে কী কী করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : মাটি, পানি, উদ্ভিদ, প্রাণী_সবকিছু নিয়েই একটি দেশের প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এর একটির সঙ্গে অপরটির নিবিড় যোগাযোগ ও নির্ভরশীলতা রয়েছে। কাজেই সামগ্রিকভাবেই এদের সংরক্ষণ প্রয়োজন। একটি দেশের জীবসম্পদ কী আছে, তারা কী অবস্থায় আছে_তা তো অবশ্যই জানতে হবে। জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা জেডএসআইয়ে আমরা সে কাজটিই দীর্ঘদিন থেকে করে আসছি। আমি নিজেই সেখানে ৪০ বছর কাজ করার পর অবসর নিয়েছি। বর্তমানে সেখানে প্রায় সাত শ বৈজ্ঞানিক আছেন। বাংলাদেশে জুলজিক্যাল সার্ভে নামে কোনো পৃথক সংগঠন না থাকলেও বিজ্ঞানীরা নানা পর্যায় থেকে অনুরূপ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং যথাসম্ভব এই গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। প্রাণীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাঁরা গবেষণা করবেন, তাঁদেরও এসব তথ্যের প্রয়োজন হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরাই এসব তথ্যকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর আমরা যেহেতু একই পরিবেশ ও প্রতিবেশের বাসিন্দা, তাই এসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের তথা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনেক উপকারে আসবে।
ভারতের যে প্রাণী সংরক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে, সেখানে এককোষী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণী পর্যন্ত সব প্রাণীকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। শুধু প্রাণীকে বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচিয়ে রাখা নয়, প্রাণীরা যাতে বেঁচে থাকতে পারে, সে রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা আবাসযোগ্যতা সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। আমি এখনো পশ্চিমবঙ্গে সে ধরনের কিছু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমি আশা করি, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও অনুরূপভাবে এ কাজগুলো করে যাবেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের পাঠকদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ড. অশোক কান্তি সান্যাল : কালের কণ্ঠ এবং এর পাঠকদেরও জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।
No comments