দলতন্ত্র-জয়-জিন্দাবাদ ঝগড়াপুরী রাজনীতি! by ফারুক ওয়াসিফ

ঝগড়াপুরে রাজনৈতিক সাঁকো: রাজধানীতে যখন দুই দলের বিবাদ চরমে ওঠে, তখন কুষ্টিয়ার এক গহিন গ্রামে নদীর ওপর পাশাপাশি নির্মিত হয় দুটো দলীয় সাঁকো। ‘মহাজোটের সাঁকো’ বনাম ‘ঐক্যজোটের সাঁকো’। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, এমন রাজনৈতিক সাঁকোও দুনিয়ায় আর আছে কি না সন্দেহ। গ্রামবাসীর হয়েছে মহা জ্বালা।


বাজারটা নদীর ওপারে, সাঁকো দুটি ছাড়া তাঁদের আর নদী-পারানির উপায় নেই। মৃত্তিকাপাড়া গ্রামের সব মানুষ, এমনকি শিশু, এমনকি বোধবুদ্ধিহীন প্রতিবন্ধী, এমনকি গরু-ছাগল-ভেড়া-কুকুর-হাঁস-মুরগিসহ পায়ে হাঁটা সব প্রাণীকেই সাঁকো দুটির একটিতে উঠতেই হবে। আর ওঠা মানেই গায়ে দলের সিল পড়ে যাওয়া। রাজনৈতিক সাঁকোর কল্যাণে সেই গ্রামের সবকিছুই এখন অতিমাত্রায় ‘রাজনৈতিক’!
সাঁকো দুটি তৈরির ইতিহাসটাও নির্মল নয়। সদ্য শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী পরাজিত হন। পরাজয়ের শোধ নিতে তিনি লোকজন দিয়ে গ্রামের বাঁশঝাড় উজাড় করে প্রথম সাঁকোটি বানান এবং ঘোষণা দেন, এ দিয়ে কেবল মহাজোটের সমর্থকেরাই পার হবে। অন্যপক্ষই বা কম কিসে। ঝাড়ে আরও কিছু বাঁশ সম্ভবত অবশিষ্ট ছিল। সেগুলো সাবাড় করে মহাজোটের সাঁকোর পাশেই তৈরি হলো ঐক্যজোটের সাঁকো। যথারীতি এই সাঁকোয় মহাজোটের সমর্থকদের ওঠা বারণ। ঝগড়ার সাঁকো এভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্কের সাঁকোটা ভেঙে দিল। জয় ঝগড়াতন্ত্র!
গ্রামটিতে মানুষসহ কিছু দোপেয়ে ও চারপেয়ে প্রাণীও আছে, যারা ‘জোটনিরপেক্ষ’। এখন তাদের কী উপায়? আগে গ্রামের মানুষ এজমালিভাবে নিজেদের দরকারের রাস্তাঘাট-সাঁকো বা মসজিদ-বিদ্যালয় বানিয়ে নিতে পারত। দলবাজির চাপে সেসব সামাজিক উদ্যোগের বেলা শেষ। এই অবস্থায় কে বানাবে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়কি সাঁকো? সাঁতরানোই কি তাঁদের বিকল্প? মুশকিল হলো, কচুরিপানায় ভরা কালীনদীতে সাঁতরানো অসম্ভব। আর সাঁকো ছাড়লেও, দলবাজেরা তো আপনাকে ছাড়বে না। দুই নৌকায় মতো দুই সাঁকোতে পা রাখাও বিপদের। মৃত্তিকাপাড়ায়, না চাইলেও আপনাকে মহাজোট বা ঐক্যজোট করতেই হবে। দলতন্ত্র জিন্দাবাদ!
অভিনন্দন মৃত্তিকাপাড়ার জোটনেতাদের। নদীটাকে কচুরিমুক্ত করা বা একটা ভালো স্কুল বানানোর প্রতিযোগিতা করতে পারেননি আপনারা। আপনাদের প্রতিযোগিতা কেবল মন্দের। তা-ই যদি, তাহলে গ্রামের নামটিও বদলে ফেলুন। ঝগড়া-সংস্কৃতিকে অক্ষয় করতে নাম রাখুন ঝগড়াপুর। দুঃখিত, মৃত্তিকাপাড়ার সাধারণ মানুষ। ঝগড়া শিখুন, সাঁকোর পর সাঁকো বানান, গ্রামের বাঁশ-কাঠ নিঃশেষ করে চলুন। জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন, জনগণ যেমন, তেমন নেতাই তারা পায়। তাই আমরা না বদলালে রাজনীতিটা বদলাবে কী করে? একটা মানবিক রাজনৈতিক সাঁকো তাই দরকার।
ঝগড়াপুরের গণতন্ত্র: মৃত্তিকাপাড়া গ্রামের এ গল্পই এখন জাতীয় গল্প। দেশময় এ রকম দুটি সাঁকোর বাইরে চলাচলের উপায় নেই। একদা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। জবাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নিরপেক্ষ কেউ না কেউ আছে নিশ্চয়। কারও কথাই ফেলনা ছিল না। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের আড়াই বছরের মাথায় যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, তখন মনে হচ্ছে, তথাকথিত ‘নিরপেক্ষতার’ দিনও বুঝি শেষ। সত্যিকার নিরপেক্ষতা যেন রাজনৈতিক অপরাধ। ঝগড়াপুরী গণতন্ত্রে দ্বিদলীয় ঝগড়ার কোনো না কোনো পক্ষে আপনাকে যেতেই হবে। আর দেশটাকে, সমাজটাকে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে, ব্যবসা-বাণিজ্য-সংস্কৃতিসহ সবকিছুকেই ভাগ করে ফেলতে হবে। বানাতে হবে যার যার নিজস্ব ক্ষমতার সাঁকো। আওয়ামী বা বিএনপির সাঁকোয় দেশ ভরে যাবে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার সাঁকো পারাপার হয়ে পড়বে কঠিন।
মোগল রাজপণ্ডিত আবুল ফজল বাংলা অঞ্চলের নাম দিয়েছিলেন ‘বুলঘাখানা’ বা ‘চির-অশান্তির দেশ’। আমাদের ভাষায়সেটাই ঝগড়াপুর। এই অবস্থায় জাতীয় স্বার্থের খোঁজ থাকে না, রাষ্ট্রের বিকাশ, অর্থনীতির সমৃদ্ধি, নাগরিক অধিকার, জনকল্যাণ—সবকিছুই ক্ষমতা ও দখলকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় রাজনীতির দোনলা বন্দুকের সামনে বিপন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের বাইরে দেশের বা মানুষের পক্ষ নিতে চাওয়া বা থাকতে চাওয়া দলীয় সংস্কৃতির বাইরে, অতি কঠিন। জয় ঝগড়াপুরীয় গণতন্ত্র!
পরের ধনে পোদ্দারি: প্রায় একই রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল খাগড়াছড়ির দীঘিনালায়। গত ১৭ এপ্রিলের প্রথম আলোর একটি শিরোনাম ‘মামলায় মামলায় দুজনই ফতুর’। এক খণ্ড জমি নিয়ে ২০ বছর ধরে মামলাযুদ্ধ চালাচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব বয়সের দুই প্রতিবেশী। ২০ বছর আগের তিন হাজার টাকার জমির বিবাদে এ পর্যন্ত তাঁদের খরচ ৪৫ লাখ টাকা। দুজনই প্রায় নিঃস্ব; উভয়েউভয়কে জেলের ভাত খাইয়েছেন, এটাই তাঁদের গর্ব। আমৃত্যু এই ঝগড়া চালিয়ে যাওয়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা তাঁদের। পড়শিরা বিমুখ, ছেলেমেয়েরাও চরম নাখোশ। কিন্তু যে সম্পত্তির জন্য জানবাজি তাঁদের, তার আদি মালিক কি তাঁরা? খাগড়াছড়ির ওই প্রত্যন্ত এলাকার সব জমি তো আগে পাহাড়িদেরই ছিল। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোই যায়। দুই বৃদ্ধ আমাদের দুই রাজনৈতিক ধারার প্রতীক। ক্ষমতার বিবাদে তাঁরা পরস্পরকে নিঃশেষ করতে চাইবেন, এমনকি নিজের পায়েও কুড়াল মারবেন, তবু কেউ কাউকে স্বীকার করবেন না। এই আত্মঘাতী সংঘাতে জনগণেরও ছাড়ান নাই। ক্ষমতার উৎস নাকি জনগণ, তাদের নামেই করা হয় সবকিছু। কিন্তু জনগণ আসলেই কি কিছু পায়? দিনের শেষে নেতাদের হাতে কিছু থাকে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রাত কাটায়। পরের ধনে পোদ্দারি জিন্দাবাদ!
অন্ধদের স্কুল কখন ছুটি হবে?: সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি গল্প আমাদের সঙ্গে মেলে: শীতের বিকেল। এক বিড়াল পেটপূর্তির পরে ফুটপাতে চোখ বুজে ওম নিচ্ছিল। কোথা থেকে তাড়া খাওয়া এক ইঁদুর এসে তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগাল। তার কথা শুনে বিড়ালের তো আক্কেল গুড়ুম। পুঁচকে ইঁদুর বলে কিনা ‘ও বিড়াল, আমাকে খাও’। বিড়ালের পেটে আর জায়গা নেই, ক্ষুধা লাগতেও দেরি আছে। তা ছাড়া রোদ পোহাতেই তার ভালো লাগছে এখন। কিন্তু ইঁদুরও নাছোড়বান্দা, বিড়ালের পেটে সে যাবেই যাবে। অনেক টানাটানির পর অবশেষে একটা রফা হলো। বিড়ালটা আপাতত ঝিমাবে, তবে মুখটা খোলা থাকবে। আর ইঁদুরটা নিজের মাথা দিয়ে রাখবে তার সেই খোলা মুখে। তারপর, ওই যে অন্ধ শিশুদের স্কুল দেখা যায়, সেখানে ছুটির ঘণ্টা বাজবে। তা শুনে অন্ধ ছেলেমেয়েরা এলোমেলো পায়ে এই পথ দিয়েই তো যাবে। তাদের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ফুটপাতে পেতে রাখা বিড়ালের লেজে পা দেবে। যদি দেয়, তাহলেই কেবল বিড়ালটা ইঁদুরের মাথাটা খপ করে খেয়ে ফেলবে। একটা সমাধান হলো ভেবে ইঁদুর খুশি, বিড়ালও খুশি। তারা অপেক্ষা করতে লাগল, কখন অন্ধদের স্কুল ছুটি হয়? কখন সেখানে পাগলা ঘণ্টা বাজে?
ইঁদুরদের ভবিষ্যৎ: পাঠক, পুঁচকে ইঁদুর আমরা, রাজনীতির দাপুটে বিড়ালদের গ্রাসের মধ্যে মাথা দিয়ে বসে থাকা আর কত কাল? শুনেছি, ইঁদুরের উপদ্রবে কোনো এক শহর নাকি পরিত্যক্ত হয়েছিল। হয়তো একদিন আমরা ঝগড়াপুরকে বদলে ফেলব। এই নামটাও তখন পরিত্যক্ত হবে। তখন হয়তো মাটির দেশের প্রিয় গ্রামটাকে আবার ডাকতে পারব মৃত্তিকাপুর বলে। কালী নদীতে তখন থাকবে সব মানুষের একটাই মানবিক সাঁকো, নদীতেও তখন আর দুর্নীতির কচুরি জমতে পারবে না। অন্ধদের বিদ্যালয়েহঠাৎ পাগলা ঘণ্টাও তখন আর বাজবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.