ভিন্নমত-হসপিটাল কিভাবে ইমারজেন্সি রোগী ফেরত দেয়? by আবু আহমেদ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানজিলা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তিনটি হাসপাতালে গিয়েছেন। কিন্তু কোনো হাসপাতালই তাঁকে ইমারজেন্সিতে চিকিৎসা দেয়নি। দুটি হাসপাতাল নাকি ফিরিয়েই দিয়েছে! শেষ পর্যন্ত চার ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তানজিলা মারা গেলেন।


তানজিলার সঙ্গে তাঁর মা-বাবা কেউ ছিলেন না। পথচারী বা অন্য কেউ থাকতে পারেন। তাঁরাই তাঁকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়িয়েছেন। যে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছেন তিনি নিজে কোনো চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন না। ভাগ্যটা ভালো হয়, কেউ যদি তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কতিপয় মানুষ তো এগিয়ে আসছেন, কিন্তু হাসপাতাল এগিয়ে এলো না! অথচ হাসপাতাল নাকি রোগীর চিকিৎসা দেয়। যদি তাই হয়, তাহলে তানজিলার চেয়ে চিকিৎসা পাওয়ার দিক থেকে আর কারা বেশি উপযুক্ত রোগী? হাসপাতাল যদি রোগী চিকিৎসা দেওয়ার আগেই অর্থের বিষয়টা মাথায় আনে, তাহলে তানজিলার মতো রোগীরা হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত রোগী নন। কারণ তাঁর সঙ্গে তো তাঁর টাকাওয়ালা গার্ডিয়ান নেই! তাহলে রোগী মরে যাবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি শুধুই টাকার চিন্তা করতে থাকবে! কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে। একটা লোক গেল মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। হাসপাতালের নার্স দেখে রোগীর সঙ্গে কেউ আছে কি না। কেউ না থাকলে, আর যদি বোঝে যে রোগীও নিজে কোনো ব্যয় করতে পারবে না, তাহলে সেই মারাত্মক আহত রোগীটা ওদের করিডোরেই পড়ে থাকবে। এক সময় মরে যাবে। তারপর লাশ মর্গে। এরপর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের হাতে তুলে দেওয়া হবে। অথচ এই রোগীটাকে যথাসময়ে অল্প টাকার চিকিৎসা দিলে সে বেঁচে যেত। রোগীকেই যদি হাসপাতাল অর্থের কারণে চিকিৎসা না দেয়, তাহলে সে হাসপাতাল এই সমাজে থাকবে কেন? বড় জটিল রোগের চিকিৎসা অর্থ বাদে হাসপাতাল দেবে না, সেটা মানা যায়, কিন্তু দুর্ঘটনায় আহত হয়ে যে রোগী ইমারজেন্সিতে গেল, তাঁকে কি করে হাসপাতাল ফেরত দেয়? যে যে হাসপাতাল এসব করেছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। অন্তত ইমারজেন্সির ক্ষেত্রে বলা হোক আগে চিকিৎসা, পরে টাকা। আর টাকা কোনো দরিদ্র রোগী না দিতে পারলে সেই ব্যয় হাসপাতাল নিজে বহন করলে অসুবিধা কোথায়? কোনো আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তি বিনা অর্থে কোনো হাসপাতালের চিকিৎসাই নেবেন না। কিন্তু যে গরিব লোকটা রাস্তায় অথবা অন্যভাবে মারাত্মক আহত হলো, সে তো নিকটবর্তী হাসপাতালেই যাবে। আর ওই হাসপাতাল যদি তাঁকে ফেরত দেয় সে গরিব বলে, তাহলে এর থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কি হতে পারে? আজকাল আরো জটিল কোনো রোগী যদি বেশি মুমূর্ষু হয়, তাহলে হাসপাতাল তাকে ভর্তি করতে চায় না। কারণ হলো, হাসপাতালের ধারণা, রোগী মরে যাবে এবং তাতে তাদের বদনাম হবে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে মৃত্যুপথের যাত্রী ওই রোগীগুলোর জন্য শেষ চিকিৎসা বলতে কি কিছু পাওয়া যাবে না? আজকে যে হাসপাতালগুলো রোগী চিকিৎসার নামে শত শত কোটি টাকা ব্যবসার ফাঁদ ফেলেছে, এ ব্যাপারে সরকার আদৌ সজাগ আছে কি না? সরকার সজাগ থাকলে চিকিৎসার নামে এগুলোতে কিভাবে অপচিকিৎসা হচ্ছে, কিভাবে গলাকাটা ফি এবং রুম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কোনো কোনো হাসপাতালে রোগীদের দাঁড়ানোর জন্য পর্যন্ত জায়গা নেই। কিন্তু অধ্যাপক ডাক্তাররা ৫ থেকে ৮টা পর্যন্ত রোগী দেখছেন। যে হাসপাতালে ডাক্তার দেখতে গিয়ে তিন ঘণ্টা নোংরা ও শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, এমন পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে রোগী আরো রোগগ্রস্ত হলো, সে হাসপাতালকে শাসনে আনার কোনো পদক্ষেপ সরকার থেকে কেউ কি কোনোদিন দেখেছেন? আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানে কী কোনো হাসপাতাল রোগীপ্রতি ভর্তি ও বেড বাবদ প্রতিদিন কত করে নিচ্ছে? কার কাছে অভিযোগ করবে রোগীরা।
অভিযোগ করার যে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। আজকে কেউ যদি মনে করেন হাসপাতাল শুধু রোগীর চিকিৎসা করছে, তাহলে সেটা ভুল করবেন। হাসপাতাল হাজার হাজার রোগীর সৃষ্টিও করছে। কিভাবে? সেটা জানার কথা ডাক্তারদের। তাঁদেরই তো প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, হাসপাতাল সেবার নামে অতি মুনাফার এই ব্যবসার বিরুদ্ধে এবং অতি চিকিৎসা ও অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে। কিন্তু দুঃখ হলো তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই সিসটেমের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। রোগী তো একজন ভালো ডাক্তার তালাশ করেন। সেই ভালো ডাক্তারকে হাসপাতালের সাইনবোর্ডের মাধ্যমে চিনতে হবে কেন?
লেখক : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবদ

No comments

Powered by Blogger.