সমতলের আদিবাসী-প্রান্তিক মানুষের অনন্ত ভূমিযুদ্ধ by জোবাইদা নাসরীন
পেছনের দিকে তাকিয়েই আমরা সামনে আগাই। ব্রিটিশদের কাছে পরাধীনতার কালে সাঁওতাল হুল সেদিনের মহাজনের বুকে শূল হয়ে যেমন বিঁধেছিল, আজকের মহাজনকেও একইভাবে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে আদিবাসী মানুষেরা।দেড় শ বছরেরও বেশি আগের সেই হুল ছিল ভূমি বাঁচানো, ভূমির অধিকার ও ফসলের অধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলন।
যে ভূমি রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সিধু, কানহু, চান্দ, ভাইরো, ফুলমণিসহ আরও অনেক সাঁওতাল যোদ্ধা, সে ভূমির ওপর অধিকার সাঁওতালরা পায়নি। সময় বদলেছে। ‘দিনবদলের’ কথাও খুব প্রচারিত। তবু এ দেশে শেষ হয়নি আদিবাসীদের ভূমির লড়াই। শাসন-শোষণের মালিকানা পাল্টেছে মাত্র, কিন্তু এর ধরন রয়েছে আগের মতোই। ইউরোপীয় প্রভুরা চলে গেছে, কিন্তু মুক্তি মেলেনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের। এখনো তারা প্রতিবাদ করছে পূর্বসূরিদের মতো। এখনো সাঁওতালরা প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তীর-ধনুক। নতুন যুগের অস্ত্র ও ষড়যন্ত্রের দাপট মোকাবিলায় এখনো তাদের সেই একই হাতিয়ার।
ভূমির লড়াই চলছেই। ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট ভূমি দখলের প্রতিবাদ করলে দিনাজপুরের ভীমপুরে হত্যা করা হয় আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু উত্তরবঙ্গেই ভূমিকে কেন্দ্র করে ২০ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয় আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬০ জন নারী এবং অপহূত হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি। আদিবাসীদের ভূমি দখল এবং তাদের ওপর নানামুখী চাপের কারণে গত ১০ বছরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা থেকে প্রায় ২৩০টি পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছে। দেশান্তরি হওয়ার কথাও ভাবছে অনেকে। এদের কোনো তালিকা নেই সরকারের কাছে। এমনকি নেই তাদের পুনর্বাসন করার কোনো ধরনের উদ্যোগ।
মহাজন কিংবা ইংরেজ প্রভুদের প্রত্যক্ষ শাসন না থাকলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি হাতছাড়া হয়েই চলেছে। তাদের অনেকেরই জমির রাষ্ট্রস্বীকৃত দলিল ছিল না; এর কোনো প্রয়োজনও ছিল না তাদের জীবনে। এতে তাদের ভূমি দখল সহজ হয়, তৈরি করা যায় জাল দলিল। বাঙালি ও আদিবাসীদের জমির মালিকানার ধরন ভিন্ন হওয়ায় ‘সংখ্যালঘুত্বের’ কারণে তারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। এ কারণেই সমতলের আদিবাসীরা দাবি তুলেছে তাদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে চলছে আদিবাসীদের নিয়ে অধিপতির নানা ডিসকোর্স। তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার চেষ্টা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ ধরনের ডিসকোর্স থেকে রাষ্ট্র ও উন্নয়ন-অধিপতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিংবা ভাবনা স্পষ্ট হয়। ভূমি থেকে উচ্ছেদ দিয়েই সবখানে শুরু হয়েছে তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচার। অন্য মানুষ সংস্কৃতি ও জীবনের জয়গান গেয়েছে তাদের সংস্কৃতির ওপর ভর করে, অথচ তাদের অধিকার না দিয়ে। তাই আজ পৃথিবীর দেশে দেশে সর্বক্ষেত্রে এসব মোকাবিলায় আদিবাসী রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে।
আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেখানকার আদিবাসীদের নিশ্চিহ্নকরণের ইতিহাস। স্বীকৃতির জন্য, অস্তিত্বের প্রশ্নে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আমেরিকা, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় আদিবাসীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন কতগুলো বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে দুটো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। প্রথমটি একদমই অধিকারভিত্তিক। আর দ্বিতীয়টি আগাগোড়াই রাজনৈতিক এবং পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদিবাসী বিষয়ে বিভিন্ন এনজিও ও জাতিসংঘের অধিকারভিত্তিক ধারার বাইরেও আদিবাসীরা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব খোঁজার তাগিদে নতুন পাটাতন নির্মাণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই পাটাতনকে বলা হয়ে থাকে ‘চতুর্থ বিশ্ব’।
প্রকৃতির ওপর পুঁজিবাদী শোষণের জীবন্ত প্রতিবাদও করে চলেছে এই আদিবাসী মানুষ তাদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। দেশে দেশে তারা প্রশ্ন তুলেছে পুঁজিবাদী অভিঘাতের বিরুদ্ধে। ভূমি থেকে কেন মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেন মানুষ বনের অধিকার পাচ্ছে না? কেন তাদের জীবন আর তাদের নিজের থাকছে না; কেন সেটি পুঁজিবাদী দুনিয়ার? কেন ভূমিনির্ভর, প্রকৃতিনির্ভর মানুষদের টিকে থাকা এত কঠিন? শুধু ব্রিটিশদের কাছেই পরাধীনতা নয়, এই উচ্ছেদ যে নব্য-পরাধীনতা, তার ইঙ্গিত তারা দিয়ে এসেছে সব সময়। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের মূলধারায় সেই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।
অথচ, এই আমরাই যখন দাতা সংস্থাগুলো থেকে, জাতিসংঘ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি প্রভৃতির কথা শুনি, সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠি। কোনটি বিবেচনায় আনব আর কোনটি আনব না, সেটি অবশ্যই ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। আমরা নিজেদের সুবিধামাফিক কোনো কোনো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই এর বিরুদ্ধে কথা বলি। অথচ এসবের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা নিজেদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে কথা বলে চলেছে অবিরত। প্রকৃতি রক্ষায় এখন আমরা শুধু এই মানুষদের জ্ঞান শুনতে চাই; তাদের কৌশল জানতে চাই না। প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস ভুলে আধুনিক পুঁজিবাদী মানুষ তাকে শুধু শোষণই করে। আদিবাসীদের জীবনযাপন থেকে তারা কিছু শিখতে চায় না। কিন্তু এখন সময় এসেছে, ‘অসভ্য’, ‘বন্য’, ‘অনাধুনিক’ মানুষ শেখাবে বাঁচার মন্ত্র ‘সভ্য’, ‘সংস্কৃত’, ‘আধুনিক’ মানুষকে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গড়ে উঠছে যে নতুন জলবায়ু আন্দোলন, তাতে বারবার প্রতিধ্বনি শুনি ‘আদিবাসী মানুষের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা বড্ড প্রয়োজন’।
এই ভূমির অধিকারের স্বীকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচিতির রাজনীতি জড়িত, যে কারণে আমরা দেখি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও তাদের এই পরিচয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে কি এ দেশও আমেরিকার মতো আদিবাসীদের পরিচিতি নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের জয়গান গাইবে?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaida Nasreen@gmail.com
ভূমির লড়াই চলছেই। ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট ভূমি দখলের প্রতিবাদ করলে দিনাজপুরের ভীমপুরে হত্যা করা হয় আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু উত্তরবঙ্গেই ভূমিকে কেন্দ্র করে ২০ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয় আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬০ জন নারী এবং অপহূত হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি। আদিবাসীদের ভূমি দখল এবং তাদের ওপর নানামুখী চাপের কারণে গত ১০ বছরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা থেকে প্রায় ২৩০টি পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছে। দেশান্তরি হওয়ার কথাও ভাবছে অনেকে। এদের কোনো তালিকা নেই সরকারের কাছে। এমনকি নেই তাদের পুনর্বাসন করার কোনো ধরনের উদ্যোগ।
মহাজন কিংবা ইংরেজ প্রভুদের প্রত্যক্ষ শাসন না থাকলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি হাতছাড়া হয়েই চলেছে। তাদের অনেকেরই জমির রাষ্ট্রস্বীকৃত দলিল ছিল না; এর কোনো প্রয়োজনও ছিল না তাদের জীবনে। এতে তাদের ভূমি দখল সহজ হয়, তৈরি করা যায় জাল দলিল। বাঙালি ও আদিবাসীদের জমির মালিকানার ধরন ভিন্ন হওয়ায় ‘সংখ্যালঘুত্বের’ কারণে তারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। এ কারণেই সমতলের আদিবাসীরা দাবি তুলেছে তাদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে চলছে আদিবাসীদের নিয়ে অধিপতির নানা ডিসকোর্স। তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার চেষ্টা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ ধরনের ডিসকোর্স থেকে রাষ্ট্র ও উন্নয়ন-অধিপতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিংবা ভাবনা স্পষ্ট হয়। ভূমি থেকে উচ্ছেদ দিয়েই সবখানে শুরু হয়েছে তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচার। অন্য মানুষ সংস্কৃতি ও জীবনের জয়গান গেয়েছে তাদের সংস্কৃতির ওপর ভর করে, অথচ তাদের অধিকার না দিয়ে। তাই আজ পৃথিবীর দেশে দেশে সর্বক্ষেত্রে এসব মোকাবিলায় আদিবাসী রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে।
আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেখানকার আদিবাসীদের নিশ্চিহ্নকরণের ইতিহাস। স্বীকৃতির জন্য, অস্তিত্বের প্রশ্নে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আমেরিকা, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় আদিবাসীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন কতগুলো বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে দুটো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। প্রথমটি একদমই অধিকারভিত্তিক। আর দ্বিতীয়টি আগাগোড়াই রাজনৈতিক এবং পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদিবাসী বিষয়ে বিভিন্ন এনজিও ও জাতিসংঘের অধিকারভিত্তিক ধারার বাইরেও আদিবাসীরা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব খোঁজার তাগিদে নতুন পাটাতন নির্মাণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই পাটাতনকে বলা হয়ে থাকে ‘চতুর্থ বিশ্ব’।
প্রকৃতির ওপর পুঁজিবাদী শোষণের জীবন্ত প্রতিবাদও করে চলেছে এই আদিবাসী মানুষ তাদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। দেশে দেশে তারা প্রশ্ন তুলেছে পুঁজিবাদী অভিঘাতের বিরুদ্ধে। ভূমি থেকে কেন মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেন মানুষ বনের অধিকার পাচ্ছে না? কেন তাদের জীবন আর তাদের নিজের থাকছে না; কেন সেটি পুঁজিবাদী দুনিয়ার? কেন ভূমিনির্ভর, প্রকৃতিনির্ভর মানুষদের টিকে থাকা এত কঠিন? শুধু ব্রিটিশদের কাছেই পরাধীনতা নয়, এই উচ্ছেদ যে নব্য-পরাধীনতা, তার ইঙ্গিত তারা দিয়ে এসেছে সব সময়। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের মূলধারায় সেই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।
অথচ, এই আমরাই যখন দাতা সংস্থাগুলো থেকে, জাতিসংঘ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি প্রভৃতির কথা শুনি, সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠি। কোনটি বিবেচনায় আনব আর কোনটি আনব না, সেটি অবশ্যই ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। আমরা নিজেদের সুবিধামাফিক কোনো কোনো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই এর বিরুদ্ধে কথা বলি। অথচ এসবের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা নিজেদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে কথা বলে চলেছে অবিরত। প্রকৃতি রক্ষায় এখন আমরা শুধু এই মানুষদের জ্ঞান শুনতে চাই; তাদের কৌশল জানতে চাই না। প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস ভুলে আধুনিক পুঁজিবাদী মানুষ তাকে শুধু শোষণই করে। আদিবাসীদের জীবনযাপন থেকে তারা কিছু শিখতে চায় না। কিন্তু এখন সময় এসেছে, ‘অসভ্য’, ‘বন্য’, ‘অনাধুনিক’ মানুষ শেখাবে বাঁচার মন্ত্র ‘সভ্য’, ‘সংস্কৃত’, ‘আধুনিক’ মানুষকে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গড়ে উঠছে যে নতুন জলবায়ু আন্দোলন, তাতে বারবার প্রতিধ্বনি শুনি ‘আদিবাসী মানুষের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা বড্ড প্রয়োজন’।
এই ভূমির অধিকারের স্বীকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচিতির রাজনীতি জড়িত, যে কারণে আমরা দেখি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও তাদের এই পরিচয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে কি এ দেশও আমেরিকার মতো আদিবাসীদের পরিচিতি নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের জয়গান গাইবে?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaida Nasreen@gmail.com
No comments